রেকর্ড বইয়ে মেসি-ঝড়

Slider খেলা


কাতার বিশ^কাপের ফুটবলে সৌদি আরবের বিপক্ষে মহাঅঘটনের শিকার হয়েছিল আর্জেন্টিনা। ওই একটা হার নাড়িয়ে দিয়েছিল দলের ভিত। গ্রুপপর্বের শুরুতে কাতারের মহাযজ্ঞ থেকে ছিটকে যাওয়ার আশঙ্কাতেও তো পড়েছিল লাতিন আমেরিকান জায়ান্টরা। প্রায় অবিশ^াস্য সেই হারের ওপর দাঁড়িয়ে আর্জেন্টাইনরা যেভাবে প্রত্যাবর্তন করেছে, সেটির বিশেষণ হতে পারে এক কথায় অসাধারণ। হার দিয়ে স্বপ্নযাত্রা শুরু করা দলটা কিনা সবার আগে টিকিট কাটল কোয়ার্টার ফাইনালের; এমনকি স্বপ্নের মঞ্চ ফাইনালেরও!

দুর্দান্ত এই রথযাত্রার নায়ক লিওনেল মেসি। আন্তর্জাতিক ফুটবল ক্যারিয়ারে স্বপ্নের ফর্মে আছেন তিনি। গোল করেই চলেছেন আর্জেন্টিনা অধিনায়ক। প্রতিটি ম্যাচে তার মাঠে নামাই যেমন একটা রেকর্ড। গোল করা মানেই যেন নতুন নতুন কীর্তি। মঙ্গলবার রাতে প্রথম সেমিফাইনালে ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে তো রীতিমতো রেকর্ড বইয়ে ঝড় তুললেন মেসি। ছাড়িয়ে গেলেন পূর্বসূরি ও আর্জেন্টাইন কিংবদন্তি গ্যাব্রিয়েল বাতিস্তুতাকে। টানা তৃতীয় ম্যাচে গোল করে পিএসজি সুপারস্টার উঠে গেলেন অনন্য উচ্চতায়।

মেসির দুর্দান্ত পারফরম্যান্সের সুবাদে ক্রোয়াটদের ৩-০ গোলে উড়িয়ে স্বপ্নের মঞ্চের টিকিট কেটেছে লাতিন আমেরিকার শেষ প্রতিনিধি আর্জেন্টিনা। ম্যাচে জোড়া গোল করেছেন জুলিয়ান আলভারেজ। তার দ্বিতীয় গোলটার উৎস মেসি নিজেই। ক্রোয়েশিয়ার রক্ষণভাগকে ঘোল খাইয়ে সতীর্থকে যেভাবে বলটা বাড়িয়েছেন, সেটি সম্ভবত কার ক্যারিয়ারের সেরা অ্যাসিস্ট। খুব স্বাভাবিকভাবেই আলভারেজকে ছাপিয়ে ম্যাচের নায়কবনে গেলেন আর্জেন্টাইন খুদে জাদুকর।

ক্রোয়েশিয়া অধিনায়ক লুকা মদ্রিচের সঙ্গে টস করতে নেমেই বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ ম্যাচ খেলা জার্মানির কিংবদন্তি ফুটবলার লোথার ম্যাথুসের পাশে নাম লেখালেন আর্জেন্টিনা দলপতি। বৈশ্বিক আসরে মেসি-ম্যাথুস দুজনের ম্যাচ সংখ্যাই এখন সমান ২৫টি। আগামী রবিবার ফাইনালে মাঠে নামলেই পিএসজি সুপারস্টার গড়বেন নতুন এক ইতিহাস। সেই ম্যাচের প্রতিপক্ষ ফ্রান্স নাকি মরক্কো এটি ইতোমধ্যে জেনে গেছে আর্জেন্টিনা।

লুসাইল আইকনিক স্টেডিয়ামে ম্যাচের ৩৪ মিনিটে গোল করে মেসি গড়েছেন সবচেয়ে কাক্সিক্ষত রেকর্ডটা। স্পট কিক থেকে জালের ঠিকানা খুঁজে নেন তিনি। এবারের বিশ্বকাপে চারটি পেনাল্টির তিনটিতেই গোল করলেন ৩৫ বছর বয়সী এ তারকা। যদিও এবারের পেনাল্টিটা লাতিন আমেরিকান জায়ান্টরা প্রাপ্য কিনা সেই বিতর্কও ইতোমধ্যে শুরু হয়ে গেছে।

পঞ্চম বিশ্বকাপ খেলতে আসে মেসির গোল সংখ্যা এখন ১১। স্পট কিক থেকে ক্রোয়াটদের জাল কাঁপিয়ে তিনি ছাড়িয়ে গেছেন বিশ্বকাপের ইতিহাসে আর্জেন্টিনার সর্বোচ্চ গোলদাতা গ্যাব্রিয়েল বাতিস্তুতাকে। তিন বিশ্বকাপ খেলে ডিয়েগো ম্যারাডোনাকে ছাড়িয়ে গেছেন তিনি। ছিয়াশির বিশ^জয়ের নায়কের বিশ^কাপ গোল সংখ্যা ছিল ৮টি। পূর্বসূরিকে ছাড়িয়ে যাওয়া বাতিস্তুতার গোল ম্যারাডোনার চেয়ে দুটি বেশি। রেকর্ডটা যে ভেঙে যাচ্ছে সেটি তিনি আঁচ করেছিলেন আগে থেকেই। উত্তরসূরি মেসিকে তাই অগ্রিম শুভেচ্ছা বার্তা পাঠিয়ে রেখেছিলেন আর্জেন্টিনার সাবেক স্ট্রাইকার।

সব মিলিয়ে এবারের প্রতিযোগিতায় ৩৫ বছর বয়সী মেসির গোল হলো পাঁচটি। এই গোলে তিনি ছুঁঁয়ে ফেললেন এই বিশ্বকাপের সর্বোচ্চ গোলদাতা ফ্রান্সের স্ট্রাইকার কিলিয়ান এমবাপ্পেকে। গত আসরের সেরা তরুণ অবশ্য এক ম্যাচ কম খেলেছেন। মেসি ম্যাচ খেলেছেন ছয়টি। এর মধ্যে কেবল পোল্যান্ড ম্যাচেই গোল পাননি তিনি। ওই ম্যাচে পেনাল্টি মিস করেন আর্জেন্টিনা দলপতি। স্পট কিক থেকে গোলের সেই সুযোগটা হাতছাড়া না করলে বিশ্বকাপের ইতিহাসে প্রথম ফুটবলার হিসেবে টানা ছয় ম্যাচে গোলের বিরল কীর্তি গড়তে পারতেন তিনি। কার্যত বিশ্বকাপে ধারাবাহিক তিন ম্যাচে জালের ঠিকানা খুঁজে নিলেন আর্জেন্টাইন খুদে জাদুকর। নিঃসন্দেহে মেগা এই টুর্নামেন্টে গোল্ডেন বল ও বুট দুটোতেই এমবাপ্পের সঙ্গে লড়াইটা হবে মেসির। তবে আর্জেন্টিনা দলপতির গোল্ডেন বল জেতা একপ্রকার নিশ্চিত হয়ে গেল পরশু রাতের পারফরম্যান্সের কারণে।

কেবল নিজে গোল করেই নয়, ৬৯ মিনিটে সতীর্থ জুলিয়ান আলভারেজকে দিয়েও করিয়েছেন একটি। সব মিলিয়ে কাতারের ফুটবল মহাযজ্ঞে তিনটি অ্যাসিস্ট হয়ে গেল তার। প্রতিযোগিতার চলমান আসরে সর্বোচ্চ তিনটি অ্যাসিস্ট ছিল ইংল্যান্ড অধিনায়ক হ্যারি কেনের। যদিও ইংলিশরা টুর্নামেন্ট থেকে ছিটকে গেছে কোয়ার্টার ফাইনাল রাউন্ডে। তবে আলভারেজকে দিয়ে গোল করিয়ে ডিয়েগো ম্যারাডোনার আরও একটি রেকর্ডে ভাগ বসিয়েছেন মেসি। ১৯৬৬ সালের পর থেকে বিশ^কাপে সর্বোচ্চ ৮টি অ্যাসিস্ট করেছিলেন ম্যারাডোনা। পরশু রাতে তাকে ছুঁয়ে ফেলেছেন মেসি।

বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার অধিনায়ক হিসেবে সর্বোচ্চ ম্যাচ খেলার রেকর্ডটা আরও দূরে নিয়ে গেলেন মেসি। এ পর্যন্ত বিশ্বমঞ্চে দেশকে ১৮ বার নেতৃত্ব দেওয়া হয়ে গেল তার। এবার তার সামনে বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ ম্যাচ খেলার হাতছানি। যেটি ফাইনালেই হয়তো হয়ে যাবে। আর্জেন্টিনা সেমিফাইনাল নিশ্চিত করায় ম্যাথুসের রেকর্ডটা অবশ্য আগেই নড়বড়ে হয়ে উঠেছিল। কেবল ম্যাথুস নন, জার্মানির আরেক কিংবদন্তি মিরোসøাভ ক্লোসার দারুণ একটা রেকর্ডেও এদিন ভাগ বসিয়েছেন মেসি। বিশ্বকাপে ২৩ ম্যাচ খেলে সর্বোচ্চ ১৭টিতে জিতেছিলেন জার্মানদের সাবেক স্ট্রাইকার। তাকে ছুঁতে অবশ্য মেসিকে দুই ম্যাচ বেশি খেলতে হয়েছে। এবারের আসরে আর্জেন্টিনা চ্যাম্পিয়ন হলে ক্লোসার রেকর্ড ভেঙে ফেলবেন মেসি।

গোল কিংবা ম্যাচ খেলার রেকর্ড ছাড়া আরও একটা বড় কীর্তির হাতছানি এখন আর্জেন্টিনা অধিনায়কের সামনে। সেটি হলো বিশ্বকাপে সবচেয়ে বেশি সময় মাঠে থাকার রেকর্ড। কার্যত যা চারটি বিশ্বকাপ খেলা ইতালির পাওলো মালদিনির দখলে। দেশের হয়ে তিনি মোট খেলেছেন ২২১৭ মিনিট। জার্মানির ম্যাথুস মাঠে ছিলেন ২১০৪ মিনিট। ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষের ম্যাচে দ্বিতীয়জনকে ছাড়িয়ে গেছেন মেসি। বিশ্বকাপে মাঠে তার উপস্থিতি এখন ২১৩৭ মিনিট। ফাইনালে ৮১ মিনিট পর্যন্ত মাঠে থাকলে মেসি পেছনে ফেলবেন মালদিনিকে।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *