সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগে ধস নেমেছে

Slider অর্থ ও বাণিজ্য


সঞ্চয়পত্র বিনিয়োগে ধস নেমেছে। সর্বশেষ অক্টোবর মাসে সঞ্চয়পত্র কেনার চেয়ে ভাঙানোর পরিমাণ ছিল অনেক বেশি, প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা। আগের মাস সেপ্টেম্বরেও কেনার চেয়ে ভাঙানোর পরিমাণ ছিল বেশি। তবে অক্টোবরে এসে ভাঙানোর প্রবণতা বেড়ে যায় অনেক বেশি। ফলে চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) নিট বিনিয়োগের পরিমাণ ঋণাত্মক ধারায় চলে গেছে। অর্থাৎ এ সময়ে মোট বিক্রির চেয়ে ভাঙানোর পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৬৩৩ কোটি টাকা। অথচ গত অর্থবছরের একই সময়ে নিট বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ৯ হাজার ৩২৫ কোটি টাকা।

নিম্ন মধ্যবিত্ত, সীমিত আয়ের মানুষ, মহিলা, প্রতিবন্ধী ও অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য সঞ্চয়পত্রের বিভিন্ন প্রকল্প চালু রয়েছে। সামাজিক সুরক্ষার কথা বিবেচনায় নিয়ে সঞ্চয়পত্রে তুলনামূলক বেশি মুনাফা (সুদ) দেয় সরকার। তবে সাম্প্রতিক সময়ে সঞ্চয়পত্র বিক্রিতে নানা কড়াকড়ি আরোপ করে সরকার। এ ছাড়া উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষ সঞ্চয়ে সামর্থ্য হারাচ্ছে। ফলে সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রিতে ধস নেমেছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, করোনার পর অর্থনীতিতে চাহিদা বৃদ্ধি এবং রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে পণ্য ও সেবার দামে লাগামহীন ঊর্ধ্বগতিতে জীবন যাপনের খরচ বেড়ে গেছে মানুষের, যার প্রভাব পড়ছে সঞ্চয়ের ওপর। বিশেষ করে নির্দিষ্ট আয়ে যাদের সংসার চলে, তাদের অনেকেই এখন সঞ্চয় ভেঙে খাচ্ছেন। ফলে নির্দিষ্ট মেয়াদপূর্তির আগেও অনেকে সঞ্চয়পত্র ভেঙে সংসার চালাচ্ছেন। কেউ মেয়াদপূর্তিতেও পুনর্বিনিয়োগ না করে টাকা তুলে নিচ্ছেন। আবার যাদের কিছু সঞ্চয় আছে তারাও কড়াকড়ির কারণে সঞ্চয়পত্রে টাকা খাটাতে আগ্রহী হচ্ছেন না।

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ও অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর আমাদের সময়কে বলেন, মূলত তিনটি কারণে সঞ্চয়পত্র থেকে মানুষ মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। প্রথম কারণ হলো- এখন মানুষের হাতে টাকা-পয়সা কম। ফলে সংসার চালাতে সঞ্চয়ে হাত দিচ্ছেন তারা। দ্বিতীয় হলো- ৫ লাখ টাকার বেশি সঞ্চয়পত্র বিনিয়োগে আয়কর রিটার্নের স্লিপ জমা করতে হচ্ছে। কিন্তু বিনিয়োগকারীদের অনেকেই এ ঝামেলায় যেতে চান না। তৃতীয়ত বিভিন্ন প্রকার সঞ্চয়পত্রের বিনিয়োগ সীমা কমিয়ে আনা হয়েছে। ফলে যাদের আগে থেকে বেশি বিনিয়োগ ছিল, তারা মেয়াদপূর্তিতে নতুন করে বিনিয়োগ করতে পারছেন না। এছাড়া প্রবাসী বন্ডে বিনিয়োগ সীমা কমিয়ে আনা ও এনআইডি শর্তের কারণে সেখানে কম বিনিয়োগ হয়েছে। যদিও সম্প্রতি প্রবাসী বন্ডের বিনিয়োগ সীমা ও এনআইডি শর্ত প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে।

প্রতি অর্থবছরের বাজেটে নিট বিক্রি হিসেবে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়ে থাকে। চলতি অর্থবছরের সঞ্চয়পত্র বিক্রি থেকে নিট ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৩৫ হাজার কোটি টাকা। এটি গত অর্থবছরের চেয়ে ৩ হাজার কোটি টাকা বেশি।

জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের প্রতিবেদন বলছে, সর্বশেষ অক্টোবর মাসে সঞ্চয়পত্রের নিট বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ঋণাত্মক ৯৬৩ কোটি ১৬ লাখ টাকা। অর্থাৎ পুরো মাসজুড়ে মোট যে পরিমাণ সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে, একই সময়ে তার চেয়ে ৯৬৩ কোটি ১৬ লাখ টাকা বেশি ভাঙানো হয়েছে। আগের মাস সেপ্টেম্বর মাসেও নিট বিনিয়োগের পরিমাণ ঋণাত্মক ধারায় ছিল, যার পরিমাণ প্রায় ৭৩ কোটি টাকা। যদিও অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে সঞ্চয়পত্রের নিট বিনিয়োগের পরিমাণ কিছুটা ইতিবাচক ধারায় ছিল। এর মধ্যে গত আগস্টে সঞ্চয়পত্রের নিট বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল মাত্র ৮ কোটি টাকা। আর জুলাই মাসে ছিল ৩৯৩ কোটি টাকা। আগে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের মূল বা আসল পরিশোধের পর যা থাকে তা নিট বিক্রি হিসেবে পরিগণিত হয়। এই নিট বিক্রিকে সরকারের ঋণ বলা হয়।

প্রতিবেদনে আরও দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) সঞ্চয়পত্রের নিট বিনিয়োগ ঋণাত্মক ধারায় নেমে গেছে, এর পরিমাণ প্রায় ৬৩২ কোটি ৬৩ লাখ টাকা। অথচ গত অর্থবছরের একই সময়ে নিট বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ৯ হাজার ৩২৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে অক্টোবর মাসে ৭৬৬ কোটি ৫২ লাখ টাকা, সেপ্টম্বরে ২ হাজার ৮২৫ কোটি ৫৬ লাখ টাকা, আগস্টে ৩ হাজার ৬২৮ কোটি ৫৮ লাখ এবং জুলাইয়ে ২ হাজার ১০৪ কোটি টাকার নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছিল।

গত অর্থবছরও সঞ্চয়পত্র থেকে তুলনামূলক কম ঋণ পেয়েছিল সরকার। পুরো অর্থবছরে ৩২ হাজার কোটি টাকা লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে নিট বিনিয়োগ হয় ১৯ হাজার ৯১৫ কোটি টাকা। অথচ করোনার পরও ২০২০-২১ অর্থবছরে সঞ্চয়পত্রের নিট বিনিয়োগ হয়েছিল প্রায় ৪২ হাজার কোটি টাকা। এটি তার আগের অর্থবছরে ছিল মাত্র ১৪ হাজার ৪২৮ কোটি টাকা।

ব্যাংকগুলোর আমানতের সুদের হার কম এবং পুঁজিবাজারে দীর্ঘ মন্দার কারণে বেশ কয়েক বছর ধরে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছিল সঞ্চয়পত্র বিক্রি। এতে সরকারের ঋণের বোঝা অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়। বিক্রির চাপ কমাতে ২০১৯ সালের জুলাই থেকে বিভিন্ন কড়াকড়ি আরোপ করে আসছে সরকার। সর্বশেষ চলতি অর্থবছরে পাঁচ লাখ টাকার বেশি সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ থাকলে আয়কর রিটার্নের সনদ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এর আগে গত বছরের ২১ সেপ্টেম্বর থেকে ১৫ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সব ধরনের সঞ্চয়পত্রের সুদের হার ২ শতাংশের মতো কমিয়ে দেয় সরকার। তার আগে ২০২০ সালের ডিসেম্বরে সঞ্চয়পত্রের বিনিয়োগ সীমা কমিয়ে আনা হয়। এ ছাড়া ২০১৯ সালের ১ জুলাই থেকে মুনাফার ওপর উৎসে করের হার ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হয়। এসব কড়াকড়ির প্রভাব পড়েছে সঞ্চয়পত্রে বিক্রির ওপর।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *