আমদানি পণ্যে নির্ভরতা কমাতে দেশবাসীর প্রতি প্রধানমন্ত্রীর আহ্বান

Slider জাতীয়


প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশবাসীকে তাদের নিজেদের জন্য খাদ্য উৎপাদন বাড়ানোর আহ্বান পুনর্ব্যক্ত করেছেন এবং যেকোনো সংকট মোকাবিলায় রফতানি বৃদ্ধির পাশাপাশি আমদানি পণ্যের ওপর নির্ভরতা কমানোর আহ্বান জানিয়েছেন।

তিনি বলেন, ‘আমদানি পণ্যের উপর নির্ভরতা কমাতে হবে এবং আমাদের সকলেরই এ চেষ্টা করা উচিত।’

রোববার (৭ নভেম্বর) রাতে প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা শেখ হাসিনা একাদশ জাতীয় সংসদের ২০তম অধিবেশনে তার সমাপনী ভাষণে এ আহ্বান জানান। স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী এ সময় অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের খাদ্য উৎপাদন আরও বাড়াতে হবে। নিজেদের উৎপাদনটাকে ধরে রাখতে হবে। আর আমদানিকৃত পণ্যের ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে হবে। সেই চেষ্টাই আমাদের করতে হবে। সাথে সাথে রফতানি বাড়াতে হবে এবং যেজন্য সরকার বিভিন্ন দেশে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

‘বিশ্ব মন্দার মধ্যেও সরকার অর্থনীতিটাকে ধরে রাখতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে এবং এ জন্য সকলকে কৃচ্ছতা সাধন করতে, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি ও পানির ব্যবহারে মিতব্যয়ী হতে হবে। প্রতিটি পরিবারকে এ বিষয়ে সচেতন হতে হবে। কেননা ইউরোপের অনেক উন্নত দেশে রেশনিং চলছে এবং এই শীতে বিদ্যুৎ ব্যবহার সীমিত রাখতে তারা নতুন পরিকল্পনা করছে। কাজেই আমাদের সাশ্রয়ী হতে হবে এবং আগে থেকেই যে কোনো অবস্থার জন্য তৈরি থাকতে হবে,’ বলেন তিনি।
প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ‘আমাদের এই মুহূর্তে যে জিনিসটার খুব বেশি প্রয়োজন নেই সেই বিলাসদ্রব্য আমদানি আমাদের কমাতে হবে। আর এর ওপর আমাদের ট্যাক্সও বসাতে হবে বেশি করে।’

বিদেশি ঋণ প্রসঙ্গে বিরোধী দলের উপনেতার বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি বলেন, আমাদের মোট সরকারি ঋণ জিডিপির ৩৬ শতাংশ। আর বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ জিডিপির ১৩ দশমিক ৫ শতাংশ। আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর অন্তত এতটুকু বলতে পারি আমরা কোনো দিনও ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হইনি। আমরা নিয়মিত ঋণ পরিশোধ করে যাচ্ছি। আমরা ঋণ খেলাপি (লোন ডিফল্টার) হইনি কখনো। আর ভবিষ্যতেও ইনশাল্লাহ হব না।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিশ্বব্যাপী বিপর্যস্ত অর্থব্যবস্থা থেকে বাংলাদেশ আলাদা নয়। বাংলাদেশকেও তার ফল ভোগ করতে হচ্ছে এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মূল্যস্ফীতি ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। মুদ্রার বিপরীতে ডলারের মূল্যবৃদ্ধি এই সংকটকে আরো ঘণীভূত করেছে। কারণ প্রতিনিয়ত ডলারের দাম বেড়ে যাচ্ছে। কাজেই আমাদের মত তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলো যাদের খাদ্য পণ্য, জ্বালানি এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি করতে হচ্ছে তারাও সংকটে পড়েছে। এরপরেও আমি বলব আমাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।

দেশের মানুষের কল্যাণের কথা চিন্তা করে তাদের চাহিদা সরকার পূরণের চেষ্টা করে যাচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, তারপরেও চাপ রয়েছে কেননা পণ্য উৎপাদনেও ভতুর্কির পরিমাণ অস্বাভাবিক রকম বেড়ে গেছে।

তার সরকার করোনার মধ্যে ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকার বাজেট দিতে সক্ষম হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, মাথাপিছু আয় হয়েছে ২ হাজার ৮২৪ মার্কিন ডলার যেটা বিএনপি আমলে (২০০৫-০৬) অর্থবছরে ছিল ৫৪৩ মার্কিন ডলার। পাশাপাশি বাজেটে উন্নয়ন খাতে সরকার ২ লাখ ৪৬ হাজার ৬৬ কোটি টাকা বরাদ্দ করতে সক্ষম হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী বাজেটের খাত ওয়ারি বরাদ্দের পরিমাণ বিশ্ব মূল্যস্ফীতির কারণে বেড়ে গেছে উল্লেখ করে বেশ কিছু পরিসংখ্যান তুলে ধরেন।

তিনি বলেন, বিদ্যুৎ খাতে আমাদের ভর্তুকি ধরা ছিল ১৭ হাজার কোটি টাকা, আজকে সেখানে অতিরিক্ত চাহিদা তৈরি হয়ে প্রয়োজন হয়েছে ৩২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। সম্পূর্ণ বিদ্যুৎ দিতে গেলে এই ভতুর্কি দিতে হবে।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, জ্বালানি তেলে অতিরিক্ত ভতুর্কি লাগছে ১৯ হাজার ৫৫৮ কোটি টাকা। খাদ্য আমদানিতে অতিরিক্ত ভতুর্কির প্রয়োজন হচ্ছে ৪ হাজার কোটি টাকা। টিসিবি বা অন্যান্য জনবান্ধব কর্মসূচিতে ভর্তুকি লাগছে ৯ হাজার কোটি টাকার। কেননা এক কোটি মানুষকে বিশেষ কার্ড দিয়ে সরকার স্বল্পমূল্যে খাদ্য পণ্য সরবরাহ করছে। সারও কৃষি পণ্য আমদানিতে অতিরিক্ত ভর্তুকি লাগছে ৪০ হাজার ২৪৭ কোটি টাকার। তার মানে এক লাখ ৫ হাজার ১০৫ কোটি টাকার শুধু ভর্তুকির চাহিদা বেড়েছে।

সরকার প্রধান এ সময় বিশ্ব বাজারে পণ্য মূল্য বৃদ্ধির কিছু উদাহরণ টেনে বলেন, ডিজেলের ব্যারেল প্রতি মূল্য ১৩২ ডলার বা তার বেশি থেকে প্রায় ১৭০ হয়েছে। গ্যাস সরবরাহে নভেম্বর মাসে ভোক্তা পর্যায়ে প্রতি ঘন মিটারেই ১০ টাকা ৬০ পয়সা হারে ভর্তুকি গুণতে হচ্ছে। এলএনজিকে প্রতি ঘনমিটারে ভর্তুকি দিতে হচ্ছে ৪৮ টাকা। সেভাবে ইউরিয়া সার ৭৫ টাকায় ক্রয় করে ২২ টাকায়, টিএসপি ৫৯ টাকায় করে কৃষক পর্যায়ে ২২ টাকায় এবং অন্যান্য সারও এভাবে উচ্চমূল্যে ক্রয় করে ন্যায্যমূল্যে কৃষক সরবরাহ করতে ভর্তুকি বহুগুণে বেড়ে গেছে।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, গত এক বছরে বিশ্ব বাজারে চিনি, মশুর ডালসহ অন্যান্য খাদ্য পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি হয়েছে ২০ থেকে ৩০ শতাংশ। যার অধিকাংশই আমাদের আমদানি করে স্থানীয় চাহিদা মেটাতে হয়। আন্তর্জাতিক বাজারে একই সময়ে চাল, গম, আটার মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ। আন্তর্জাতিক পণ্য পরিবহনের ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ৪০ শতাংশ।
প্রধানমন্ত্রী এত কিছুর পরও দেশে ১৫ লাখ ৭৩ হাজার ৪৮৫ মেট্রিক টন খাদ্য মজুদ রয়েছে বলেও দেশবাসীকে আশ্বস্ত করেন।

‘কাজেই আমাদের চিন্তার কিছু নাই। ইতোমধ্যে ৫ লাখ ৩০ হাজার মেট্রিক টন চাল আগাম আমদানির পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার। এ জন্য ভারত, মিয়ানমার, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া সকল দেশের সঙ্গেই আলোচনা চলছে এবং কিছু চুক্তিও হয়েছে’, বলেন তিনি।

সরকারপ্রধান আরও বলেন, ইতোমধ্যে ৯ লাখ ৫০ হাজার মেট্রিক টন গম আমদানির কার্যক্রম চলছে এবং চুক্তিকৃত চাল, গম ইতোমধ্যেই দেশে আসা শুরু হয়েছে। এক্ষেত্রে রাশিয়া তার বাধাটা সরিয়ে নেওয়ায় ইউক্রেনসহ ঐ অঞ্চল থেকে পণ্য আমদানি শুরু হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী রিজার্ভ নিয়ে বিরোধী দলের উপনেতার বক্তব্য প্রসঙ্গে বলেন, উনি একটি হিসাব দেখিয়েছেন যেখানে শুধু খরচটাই দেখিয়েছেন। কিন্তু আয়টা যুক্ত করেননি। আমাদের কিছু আয় আছে, সেটাও বাস্তব।

তিনি বলেন, চলতি অর্থবছরে জুলাই-অক্টোবরে রফতানি আয় বেড়েছে ১৬ দশমিক ৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৭ শতাংশ বেশি। আর একই সময়ে (চলতি অর্থবছরে জুলাই-অক্টোবরে) প্রবাসী আয় (রেমিট্যান্স) এসেছে ৭ দশমিক ২০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। যা গত বছরের এই সময়ের চেয়ে ২ শতাংশ বেশি। একই সময়ে আমদানি ঋণপত্র খোলা হয়েছে ২২ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলার, যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ১১ দশমিক ৭ কম। কেননা যখন ডলারের দাম কম ছিল তখন ঋণপত্র খোলার দায়টা এখন আমাদের নিতে হচ্ছে। কারণ এখন ডলারের দাম বেড়ে গেছে। সেটা পরিশোধটাও অতিরিক্ত চাপ। তবে, অতীতের ঋণপত্র খোলার যে ঘাটতি বা চাপ সেটা ২০২২ সালের ডিসেম্বর নাগাদ শেষ হয়ে যাবে বলেও তিনি আশার কথা বলে উল্লেখ করেন। জানুয়ারি ২০২৩ থেকে ডলারের সংকট নিরসনেও তার সরকার বিশেষ ভাবে দৃষ্টি দিয়েছে বলেও তিনি জানান।

রিজার্ভের হিসাব প্রসঙ্গে জানান, ৯৬ সালের ২৩ জুন সরকার গঠনের সময় তিনি রিজার্ভ পেয়েছিলেন ২ দশমিক ১২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। তার সরকার ক্ষমতায় এসেই সেই রিজার্ভকে প্রায় ৪ বিলিয়নের কাছাকাছিতে উন্নীত করে। এরপর দ্বিতীয়বার সরকারে আসে ৬ জানুয়ারি ২০০৯ তারিখে, তখন রিজার্ভ ছিল ৫ দশমিক ৩৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ৮ জানুয়ারি ২০১৪ তারিখ যখন টানা দ্বিতীয় এবং মোট তৃতীয় বারের মত আওয়ামী লীগ সরকারের আসে তখন রির্জার্ভ বেড়ে দাঁড়ায় ১৭ দশমিক ৪৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। অর্থাৎ আওয়ামী লীগ সরকার ৫ বিলিয়ন থেকে ১৭ বিলিয়নে উন্নীত করেছে। এরপর চতুর্থ দফা এবং টানা তৃতীয় দফায় সরকার গঠনের সময় ৭ জানুয়ারি ২০১৯ রিজার্ভ বেড়ে দাঁড়ায় ৩২ দশমিক ০৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার হয় এবং ৩০ জুন ২০২০ তারিখে ৩৬ দশমিক ০৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার হয়।

তিনি আরও বলেন, ৩০ জুন ২০২১ তারিখে ৪৬ দশমিক ৩৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং ৩০ জুন ২০২২ তারিখে তা ৪১ দশমিক ৮৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে দাঁড়ায়। করোনার সময় আমদামি-রফতানিসহ অন্যান্য ব্যয় প্রায় বন্ধ থাকায় তা প্রায় ৪৮ বিলিয়নে উঠে গিয়েছিল। পরবর্তীতে আমদানি বৃদ্ধি, সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প বস্তবায়ন এবং ক্যাপিটাল মেশিনারিজ আমদানির ফলে রিজার্ভ কিছুটা কমে বর্তমাতে ৩ নভেম্বর ৩৫ দশমিক ৭২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে এসে দঁড়িয়েছে।

শেখ হাসিনা বলেন, আমাদের যে রিজার্ভ আছে সেই রিজার্ভে অন্তত ৫ মাসের আমদানি করা সম্ভব। আন্তর্জাতিক মানদন্ডে যদি ৩ মাসের আমদানি পরিমাণ রিজার্ভ থাকে তাহলে সেটাই যথেষ্ট। এটা হলো বাস্তবতা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *