ঘর নেই রুপনার, বাড়ির রাস্তা নেই ঋতুর

Slider ফুলজান বিবির বাংলা


সাফ নারী চ্যাম্পিয়নশিপের সেরা গোলরক্ষক রুপনা চাকমার নৈপুণ্য দেখেছে পুরো দেশ। এই খেলোয়াড়ের মা কালাসোনা চাকমার লড়াইটাও কম নয়। দরজাহীন এক কক্ষের কুঁড়েঘরে বৃষ্টি ঠেকাতে বুক আগলে দিতে হয় তাকে। আর সদ্য ভাই হারানোর কষ্ট লুকিয়ে মাঠ দাপিয়ে বেড়িয়েছেন মিডফিল্ডার ঋতুপর্ণা চাকমা। এমনই এক দুর্গম গ্রামে তার বাড়ি যেখানে যাওয়ার কোনো রাস্তাই নেই। বাড়িতে ফিরতে তাকে ধরতে হয় ক্ষেতের আল পথ।

১৯ সেপ্টেম্বর সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে ৩-১ গোলে নেপালকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে বাংলাদেশ নারী ফুটবল দল। সেই দলের দুই সদস্য মিডফিল্ডার ঋতুপর্ণা চাকমা ও গোলকিপার রুপনা চাকমার বাড়ি রাঙামাটিতে। এর মধ্যে ঋতুর বাড়ি কাউখালী উপজেলার মগাছড়ি চাকমা পাড়ায়। আর রুপনা চাকমার বাড়ি নানিয়ারচর উপজেলার ঘিলাছড়ি ভূঁইআমাদম পাড়ায়।

দেশ-বিদেশে আলো ছড়ানো ঋতুপর্ণা আর রুপনার বেড়ে ওঠা সাধারণ পাহাড়ি পরিবারে। গতকাল বুধবার সকালে রুপনার বাড়িতে দেখা যায়, দুই চালার টিনের ছাউনির এক কক্ষের কুঁড়েঘরে থাকেন তার মা কালাসোনা চাকমা। একই কক্ষে থাকেন তার ছেলে অটিল চাকমা, ছেলে বউ রিতা চাকমা আর দুই নাতি-নাতনি। এক কোনায় পাতা ছোট চৌকি। আসবাবপত্রও নেই। প্রতিবেশীদের কাছ থেকে ধার করে নেওয়া হয়েছে বিদ্যুৎ। তাতে জ্বলে মাত্র একটি লাইট। ঢাকা থেকে ফিরলে এই ঘরে জায়গা হয় না রুপনার। থাকেন অন্য কারও বাড়িতে।

ভাঙা বাড়িটির বেড়ায় শোভা পাচ্ছে প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে নেওয়া রুপনার পুরস্কারের ছবিসহ তার দলের বেশ কিছু বাঁধাই করা গ্রুপ ছবি। পাশেই ঝুলছে বেশ কিছু মেডেল। ৬৫ বছর বয়সী রুপনার মা কালাসোনা চাকমা জানালেন, এক সময় মানুষের কাজ করে সংসার চালাতেন। এখন প্রায়ই অসুস্থ থাকেন। তাই কাজ বন্ধ। বাঁ চোখে দেখতে পান না। ছোট ছেলের কুঁড়েঘরেই আশ্রয় তার। চান চিকিৎসা আর একটি বাড়ি। দুই ভাই আর দুই বোনের মধ্যে রুপনা সবার ছোট। গোলপোস্ট আগলে রাখা রুপনার আরেক গল্প শোনালেন তিনি। গাছে চড়তে পারদর্শী হওয়ায় গ্রামে আলাদা কদর আছে তার। উঁচু গাছ থেকে নিমিষে নারিকেল পেরে দেন তিনি। বিনিময়ে পাওয়া ১০-২০ টাকায় তার হাত খরচ চলে যায়।

বড় তিন ভাইবোন বিয়ে করে আলাদা সংসারি হয়েছেন। বড় ভাই শান্তি জীবন আর ভাবি রিতা চাকমার দাবি রুপনার জন্য একটি সরকারি চাকরি। আরেক ভাই অটিল চাকমা চান গ্রামের সড়ক আর বাড়ির পাশে বড়মাহরুম নদীতে সেতু।

ঋতুপর্ণার বাড়িতে গিয়ে দেখা যায় টিনের ছাউনি আর বেড়ার তিন কক্ষের বাড়ি তাদের। কক্ষের বেড়ায় শোভা পাচ্ছে প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে নেওয়া ঋতুর পুরস্কারের ছবিসহ তার দলের বেশ কিছু বাঁধাই করা গ্রুপ ছবি। পাশেই ঝুলছে বেশ কিছু মেডেল। সোকেসের ওপর সাজিয়ে রাখা হয়েছে অনেকগুলো শিরোপা। খুশির আমেজ বাড়িজুড়েই। প্রতিবেশীরাও আসছেন শামিল হতে।

ঋতুর মা বোজপুতি চাকমা বললেন, শিশু বয়সে ২০১৫ সালে বাবা বরজ বাঁশি চাকমাকে হারিয়েছেন ঋতুপর্ণা। চার বোনের মধ্যে ঋতু চতুর্থ। তারপর তাদের পরিবারে এসেছিল একমাত্র ভাই পার্বণ চাকমা। মাত্র ১৮ বছর বয়সে গত ২৯ জুলাই বিদ্যুতের তারে জড়িয়ে মারা গেছেন তিনি। ঋতুদের সাফল্য দেখে যেতে পারেননি বাবা আর ভাই। তবে গ্রামবাসী আর দেশের মানুষের উচ্ছ্বাসের আনন্দ ছড়িয়ে গেছে পরিবারটিতে। তিন বোনের বিয়ে হয়ে যাওয়ায় এখন মাকে নিয়েই সংসার ঋতুর। এই খুশির অংশীদার হিসেবে ঋতুর আর্থিক নিরাপত্তার জন্য একটি সরকারি চাকরির দাবি ঋতুর মা বোজপুতি আর বোন পুতুলি চাকমার।

ঋতুপর্ণাদের গ্রামের মানুষ প্রতিদিনকার প্রয়োজন পূরণ করতে পার হতে হয় মগাছড়ি ছড়া। গ্রামে কোনো সড়ক নেই। ধানের ক্ষেতের আল ধরে যাতায়াত করতে হয় মানুষের। গ্রাম থেকে পিচঢালা সড়কে পৌঁছাতে চার কিলোমিটার পাহাড়ি খাল-বন পার হতে হয়।

গ্রামবাসীর প্রত্যাশা : অন্তত ঋতুপর্ণা আর রুপনার কারণে গ্রামে উন্নয়ন হবে এমন প্রত্যাশা করছেন গ্রামবাসী। গৃহিণী নীলবানু চাকমা, সুদীপ চাকমা আর চন্দসেন চাকমার প্রত্যাশা- গ্রামের সড়ক, সেতু আর বিশুদ্ধ খাওয়ার পানির ব্যবস্থা হবে। কাদা পানি মাড়িয়ে হাঁটতে হবে না। গ্রামে আসবে গাড়িও।

পাহাড়ে নারী ফুটবলের আঁতুড়ঘর রাঙামাটির ঘাগড়া উচ্চ বিদ্যালয়। যেখানে ফুটবল দুনিয়ায় হাতেখড়ি হয়েছে পাহাড়ের সন্তান জাতীয় দলের তারকা খেলোয়াড় মনিকা, আনাই, আনুচিং, ঋতুপর্ণা ও রুপনা চাকমার। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিজের বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সাফল্য অর্জনে গর্বিত বিদ্যালয়টির প্রধান শিক্ষক চন্দ্রা দেওয়ান।

রুপনার বাড়ি তৈরি করতে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ : রুপনা চাকমার বাড়ি দ্রুত তৈরি করে দিতে বুধবার রাঙামাটির জেলা প্রশাসককে নির্দেশ দিয়েছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। রাঙামাটির পাহাড়ি কন্যাদের এমন সাফল্যে আনন্দে শামিল হতে রাঙামাটির জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মিজানুর রহমান মঙ্গলবার ঋতুপর্ণা ও রুপনা চাকমার বাড়িতে গেছেন। সেখানে তাদের দুই পরিবারের হাতে তুলে দিয়েছেন তিন লাখ টাকার চেক। ক্রীড়া সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ভালো পৃষ্ঠপোষকতা পেলে পাহাড়ে আরও প্রতিভাবান নারী খেলোয়াড় উঠে আসবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *