করোনা ও বন্যায় চলতি বছরের এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষা দুদফা পেছানোর পর আবার বিলম্বিত হচ্ছে পরীক্ষা। এতে মানসিক চাপ বাড়ছে পরীক্ষার্থীদের। পরীক্ষা ব্যবস্থাপনা নিয়ে ক্ষুব্ধ অভিভাবকরা। করোনা সংক্রমণে ফেব্রুয়ারিতে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়নি। এরপর দ্বিতীয় দফায় সিলেটসহ দেশের অন্যান্য অঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতির কারণে জুনে পরীক্ষা শুরু হতে পারেনি। চড়াই-উতরাই দুর্যোগ-দুর্ভোগ পেরিয়ে সম্প্রতি পরীক্ষা শুরু হয়ে গেলেও এবার নতুন সংকট দেখা দিয়েছে, তা হলো অব্যবস্থাপনা। এতে একের পর এক পরীক্ষা বিলম্বিত হয়েই যাচ্ছে।
কুড়িগ্রামে এসএসসির প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ায় চলতি পরীক্ষার সাধারণ গণিত, পদার্থ, রসায়ন এবং কৃষি বিষয়ে গতকাল বুধবার পরীক্ষা স্থগিত করেছে দিনাজপুর মাধ্যমিক উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড। এর আগে যশোর বোর্ডে বাংলা দ্বিতীয় পত্রের বহুনির্বাচনী পরীক্ষা স্থগিত করে তা নতুন সূচিতে নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে বোর্ড।
দিনাজপুর বোর্ডের ৪ বিষয়ে পরীক্ষা স্থগিত: কুড়িগ্রামের ভুরুঙ্গামারী উপজেলায় চলতি এসএসসি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার অভিযোগ উঠেছে। এ অভিযোগে চার বিষয়ের পরীক্ষা স্থগিত করেছে দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ড। কুড়িগ্রাম জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মো. শামসুল আলম এ তথ্য নিশ্চিত করে জানান, এসএসসি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার অভিযোগে গণিত, কৃষি, পদার্থ ও রসায়ন এই চারটি বিষয়ের পরীক্ষা গ্রহণ স্থগিত করা হয়েছে।
এরপর দিনাজপুর মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর কামরুল ইসলাম স্বাক্ষরিত এক জরুরি বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়- দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ডের অধীনে ২০২২ সালের চলমান এসএসসি পরীক্ষার গণিত, পদার্থবিজ্ঞান, কৃষিবিজ্ঞান এবং রসায়ন বিষয়ে পরীক্ষা অনিবার্য কারণবশত স্থগিত করা হলো। পরীক্ষার তারিখ যথাসময়ে জানানো হবে। স্থগিত করা বিষয়গুলো ছাড়া অন্য সব বিষয়ের রুটিনে উল্লিখিত সময়সূচি অনুযায়ী যথারীতি অনুষ্ঠিত হবে। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক কামরুল ইসলাম বলেন, ‘দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ডের আওতাধীন সব এসএসসি পরীক্ষা কেন্দ্র সচিবদের চিঠি দিয়ে পরীক্ষা স্থগিতের বিষয়টি জানানো হয়েছে।’
জানা গেছে, প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ পেয়ে গত মঙ্গলবার রাত ৮টা থেকে ১২টা পর্যন্ত দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক কামরুল ইসলাম, কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রেজাউল করিম ও পুলিশ সুপার আল আসাদ মো. মাহফুজুল ইসলাম ভুরুঙ্গামারী থানা ও ইউএনও কার্যালয়ে চার ঘণ্টার দীর্ঘ বৈঠক করেন। বৈঠক শেষে মামলা করা হয়। মঙ্গলবার রাতে ভুরুঙ্গামারী থানায় মামলা করেন কেন্দ্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত ট্যাগ কর্মকর্তা উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা আদম মালিক চৌধুরী।
মামলায় আটক ৫ শিক্ষক: এ বিষয়ে কুড়িগ্রামের নিজস্ব প্রতিবেদক ও ভুরঙ্গামারী প্রতিনিধি জানিয়েছেন, প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগে মামলায় একটি পরীক্ষা কেন্দ্রের সচিবসহ পাঁচ শিক্ষককে আটক করা হয়েছে। আটক শিক্ষকরা হলেন- উপজেলার নেহাল উদ্দিন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও ওই পরীক্ষা কেন্দ্রের সচিব লুৎফর রহমান, একই বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক যোবায়ের হোসেন ও রাসেল মিয়া। সবশেষ সহকারী শিক্ষক হামিদুর রহমান ও সোহেলকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করেছে ভুরুঙ্গামারী থানা পুলিশ। লুৎফর রহমান, যোবায়ের হোসেন ও রাসেল মিয়াকে জেলহাজতে পাঠিয়েছে পুলিশ। কুড়িগ্রাম জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মো. সামছুল আলম বলেন, কুড়িগ্রামে প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান ও সচিব স্যার এসেছিলেন। এসে ভুরুঙ্গামারীতে অসংগতি পেয়েছেন। এ কারণেই কয়েকটি বিষয়ের পরীক্ষা স্থগিত করেছেন।
যেভাবে প্রশ্নফাঁস: এসএসসি পরীক্ষার শুরুর দিনে ভুরুঙ্গামারীর নেহাল উদ্দিন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় পরীক্ষা কেন্দ্রের জন্য প্যাকেট করা বাংলা প্রথম পত্রের প্রশ্নের প্যাকেটে ভরে বাংলা দ্বিতীয় পত্র, ইংরেজি প্রথম ও দ্বিতীয় এবং ইংরেজি প্রথম পত্রের প্রশ্নের সঙ্গে বিজ্ঞানের তিনটি বিষয়ের প্রশ্নপত্র বের করে নেওয়া হয় থানার লকার থেকে। এসব প্রশ্ন পরীক্ষার আগে হাতে লিখে শিক্ষার্থীদের দিয়ে দিতেন অভিযুক্ত শিক্ষকরা। হাতে লেখা প্রশ্নপত্র ম্যাসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ এবং মেইলেও শিক্ষার্থীরা পেয়ে যেত টাকার বিনিময়ে। বিষয়টি বাংলা দ্বিতীয় পত্র পরীক্ষার দিন প্রকাশ পেলে স্থানীয় প্রশাসন ও পরীক্ষাসংশ্লিষ্টরা বিষয়টি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু ইংরেজি পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁসের বিষয়টি স্থানীয় অনেকের নজরে এলে বাধ্য হয়ে থানায় অভিযোগ করেন কেন্দ্রের ট্যাগ কর্মকর্তা। এ অভিযোগের সূত্র ধরে গত মঙ্গলবার বিকেলে ভুরুঙ্গামারী উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য থানায় নেয়া হয়। পরে নেহাল উদ্দিন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও কেন্দ্র সচিব লুৎফর রহমান, একই বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক যোবায়ের হোসেন ও রাসেল মিয়াকে আটক করে ভুরুঙ্গামারী থানা পুলিশ।
মাউশি সচিবের ক্ষোভ প্রকাশ: প্রশ্নফাঁসের ঘটনায় শিক্ষকরা জেলে, আমরা কাকে বিশ্বাস করব- বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব মো. আবু বকর ছিদ্দীক। প্রশ্নফাঁসের ঘটনায় কেন্দ্রসচিবসহ পাঁচ শিক্ষকের আটকের প্রসঙ্গে রাজধানীর রেসিডেন্সিয়াল মডেল কলেজ অডিটোরিয়ামে এক বক্তব্যে তিনি এ কথা করেন।
সচিব বলেন, ‘আমরা একটা কঠিন সময়ের মধ্যে আছি। আজ শুদ্ধাচার নিয়ে কথা বলছি। প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়ে গেছে। পরীক্ষা স্থগিত হয়েছে। দুর্ভাগ্য আমাদের শিক্ষককে অ্যারেস্ট না করে পারিনি। এই লজ্জা নিয়ে আমরা আজ এখানে কর্মশালা করছি। তিনজন শিক্ষক জেলে, একজন পলাতক (পরে আরও দুই শিক্ষককে আটক করেছে পুলিশ)। আমি কার ওপর বিশ্বাস করব। প্রশ্নপ্রত্র আনা-নেওয়ার দায়িত্ব যার ওপর দিলাম, শুনলাম উনি বেশভূষায় ধার্মিক মানুষ। কোথায় বিশ্বাস রাখব? ছাত্ররা কী শিখবে?
এদিকে দিনাজপুর বোর্ডের প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় মানসিক চাপে পড়েছেন উত্তরের আট জেলার শিক্ষার্থীরা। অনেক শিক্ষার্থী কান্নায় ভেঙে পড়েন। অভিভাবকরাও ক্ষোভ প্রকাশ করেন পরীক্ষা ব্যবস্থাপনা নিয়ে। এ বিষয়ে নর্দার্ন ইলেকট্রিসিটি সাপ্লাই কোম্পানি লিমিটেডের (নেসকো) দিনাজপুর অফিসের কর্মচারী সাজ্জাদুল ইসলাম বলেন, ‘আমার মেয়ে এবার এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছে। সকালে অনলাইন মিডিয়া, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক ও টিভির পর্দায় দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ডের অধীনে চলমান এসএসসি পরীক্ষা স্থগিত হওয়ার খবর দেখে কান্নাকাটি শুরু করে দিয়েছে। তাকে থামানো যাচ্ছে না।’ লালমনিরহাট কালিগঞ্জ উপজেলার সুন্দ্রাহবি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে পরীক্ষা দিচ্ছে সুবর্ণা। তার অভিভাবক গোলাম মোস্তফা বলেন, ‘করোনা খাইছে দুই বছর, বন্যা খাইছে এক মাস। দেখা যাক এবার প্রশ্নফাঁস কত দিন খায়।’ আসলে পরীক্ষা ব্যবস্থাপনা নিয়ে গলদ আছে। ওই জেলার আরেক পরীক্ষার্থী সোহেল আহমেদ কুড়িগ্রাম সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে পরীক্ষা দিচ্ছে। সে কান্না করতে করতে বলে, ‘প্রশ্নফাঁসের মতো জঘন্য ঘটনায় আমাদের সাফার করতে হবে, এটা মানি কেমন করে? আমাদের পরীক্ষা এখন আরও বেশি সময় ধরে চলবে- এটা আমাদের জন্য মানসিক চাপ বাড়ে।’ হারুন নামে আরেক শিক্ষার্থী বলেন, ‘করোনা এবং বন্যার কারণে প্রস্তুতি নেওয়ার পরও পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়নি। এতে আমাদের প্রস্তুতি নষ্ট হয়ে যায়। আবার আমরা মনোবল জুগিয়ে পরীক্ষার জোর প্রস্তুতি নিয়ে পরীক্ষা শুরু করি। কিন্তু প্রশ্নপত্র ফাঁসের কারণে পরীক্ষা স্থগিত হয়ে গেল। আমরা পরীক্ষার্থীরা আবারও হোঁচট খেলাম।’
প্রশ্নপত্র ব্যবস্থাপনায় গাফিলতি: গত ১৬ সেপ্টেম্বর যশোর শিক্ষা বোর্ডে এক বিজ্ঞপ্তিতে বাংলা দ্বিতীয় পত্রের এমসিকিউ পরীক্ষা স্থগিত করে। এর কারণ ‘অনিবার্য’ উল্লেখ করা হলেও পরে জানা গেছে, বাংলা প্রথম পত্র পরীক্ষার দিন দ্বিতীয় পত্রের বহুনির্বাচনী প্রশ্নপত্র পরীক্ষার হলে বিতরণ করা হয়েছিল।
এ বিষয়ে যশোর বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক মাধবচন্দ্র বলেন, ‘নড়াইলে বাংলা প্রথম পত্র পরীক্ষার দিনে দ্বিতীয় পত্রের এমসিকিউ প্রশ্ন দেওয়ার কারণে ১৭ সেপ্টেম্বরের এমসিকিউ অংশের পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে।’ গত ১৫ সেপ্টেম্বর নড়াইলের কালিয়া উপজেলার প্যারী শংকর পাইলট মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়, নড়াগাতী থানার বাঐসোনা কামশিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয় এবং লোহাগড়া উপজেলার দিঘলিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে ভুল প্রশ্ন দেয়ার ঘটনাটি ঘটে।
কালিয়া প্যারী শংকর পাইলট মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ে ১০০ পরীক্ষার্থীর মধ্যে বাংলা প্রথম পত্রের পরিবর্তে দ্বিতীয় পত্রের প্রশ্ন সরবরাহ করার পর বিষয়টি পরীক্ষার্থী ও কক্ষ পরিদর্শকদের নজরে আসে।
বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও কেন্দ্র সচিব দীপ্তিরানী বৈরাগী বলেন, ‘প্রশ্নপত্রের প্যাকেটের ওপর বাংলা প্রথম পত্রের কোড লেখা থাকার কারণে বিষয়টি খেয়াল না করেই প্রশ্নপত্র বিতরণ করা হয়েছিল। পরে জানতে পেরে দ্রুত সেগুলো গুছিয়ে নেয়া হয়। ‘পরে বাংলা প্রথম পত্রের অতিরিক্ত প্রশ্নপত্র দিয়ে সুষ্ঠুভাবে পরীক্ষা সম্পন্ন করা হয়েছে।’ বাঐসোনা কামশিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ১৫টি প্রশ্ন সরবরাহের পর বিষয়টি নজরে আসে। এই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক অমলেন্দু হিরা বলেন, ‘১৫টি প্রশ্ন সরবরাহের পর বিষয়টি নজরে এলে কেন্দ্রসংশ্লিষ্টরা প্রশ্ন দেয়া বন্ধ করে দেন। পরে তা গুছিয়ে নেওয়া হয়।’
এ বিষয়ে জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. ছায়েদুর রহমান বলেন, ‘বিজি প্রেসের ভুলের কারণে এ ভুলগুলো হয়েছে। যথাযথ কর্তৃপক্ষকে সব বিষয় অবগত করা হয়েছে।’ তবে এই তিন কেন্দ্রে পরীক্ষার্থীদের মধ্যে ওই প্রশ্ন বিতরণ করা হয়নি বলে দাবি করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্তৃপক্ষ। সর্বশেষ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, যশোর শিক্ষা বোর্ডের স্থগিত বাংলা দ্বিতীয় পত্রের বহুনির্বাচনী (এমসিকিউ) পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে ৩০ সেপ্টেম্বর।
প্রসঙ্গত, গত ১৫ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হয় চলতি বছরের এসএসসি পরীক্ষা। ১ অক্টোবর পর্যন্ত চলবে তত্ত্বীয় পরীক্ষা। এরপর ১০-১৫ অক্টোবর পর্যন্ত ব্যবহারিক পরীক্ষার আয়োজন করা হবে।