নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রসাধনী সামগ্রীর দাম হিমালয়ের মতো ওপরে দিকে উঠছে। এসব পণ্যের দাম একবার বাড়লে তা আর কমানো হয় না। তাই পণ্যের ‘যৌক্তিক মূল্যবৃদ্ধি’ হচ্ছে কি না, দেখতে চায় ভোক্তা অধিকার। তবে দেশী-বিদেশী প্রশাধন সামগ্রী তৈরিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতিনিধিরা বলছেন, কাঁচামালের দাম ৮২ শতাংশ বাড়লেও তা পণ্যের দাম বাড়িয়েছেন ৫০ শতাংশ। তাতেও তাদের ‘পোষাচ্ছে’ না। লস দিয়ে পণ্য বিক্রি করতে হচ্ছে।
বুধবার ভোক্তা ও ব্যবসায়ী পর্যায়ে মতবিনিময় সভায় এসব কথা উঠে আসে।
ভোক্তা অধিদফতরের মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান জানান, নিত্যপণ্যের যৌক্তিক মূল্যবৃদ্ধি হচ্ছে কি না তা খতিয়ে দেখতে চায় ‘জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর। সে লক্ষ্যে উৎপাদন কারখানাগুলো পরিদর্শন করে পণ্যের দাম বাড়ানোর যৌক্তিকতা খুঁজে বের করা হবে বলে জানিয়েছে সংস্থাটি।
ভোক্তা অধিদফতরের প্রধান কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এ সভায় নিত্যব্যবহার্য পণ্য- সাবান, ডিটারজেন্ট, টুথপেস্ট, লিকুইড ক্লিনারের উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিদের সাথে মতবিনিময় করা হয়।
সফিকুজ্জামান বলেন, ‘তেল, পেঁয়াজসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়লে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সেগুলোকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে এবং নিয়ন্ত্রণও করে। তবে প্রসাধনী পণ্যগুলোর দাম হিমালয়ের মতো আকাশের দিকে উঠেছে। ডলার বলেন, কাঁচামাল বলেন, এগুলো কমলে আর কমাচ্ছেন না, আবার বাড়লে সেখান থেকে বাড়াচ্ছেন।’
তিনি বলেন, এখন বাড়তি দাম দিয়ে নিত্যব্যবহার্য পণ্য কিনতে ভোক্তাদের কষ্ট হচ্ছে। বিশেষত সীমিত ও নিম্নআয়ের মানুষের কষ্ট বেশি হচ্ছে। সে কারণেই আমরা মতবিনিময় সভায় বসেছি। পণ্যের যৌক্তিক মূল্যবৃদ্ধি হচ্ছে কি না, সেটা আমরা দেখতে চাই।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে কয়েক মাস ধরেই বিশ্ববাজারের মতো দেশের বাজারেও নিত্যব্যবহার্য পণ্যের দাম অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। মূল্যবৃদ্ধির কারণ হিসেবে উৎপাদক প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, ডলার ও কাঁচামালের দামসহ উৎপাদন খরচ যে পরিমাণ বেড়েছে তাতে পণ্যের দাম আরো বাড়ানো দরকার। যদিও তারা ভোক্তাদের কথা বিবেচনায় রেখে সে পরিমাণ দাম বাড়াতে পারছেন না।
তবে ভোক্তা অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলো মনে করে যে, পণ্যের দাম সমন্বয়ের ক্ষেত্রে প্রতিনিয়ত চতুরতার আশ্রয় নিচ্ছে উৎপাদন ও বিপণন প্রতিষ্ঠানগুলো। উৎপাদন বা পরিবহন খরচ যতটা বেড়েছে তার চেয়েও কয়েকগুণ বেশি বাড়ানো হচ্ছে পণ্যের দাম।
মতবিনিময় সভায় প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতিনিধিরা দাবি করেন, ২০২০ সালের শেষ দিক থেকে এ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচামালের দামসহ উৎপাদন খরচ বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। কিন্তু পণ্যের দাম বাড়ানো হয়েছে এর অর্ধেক। বিগত সময়ে দাম সমন্বয়ও করা হয়নি। এ অবস্থায় কোম্পানিগুলোর পিঠ এখন দেয়ালে ঠেকে যাচ্ছে। এর কিছুটা চাপ পড়ছে ভোক্তাদের ঘাড়ে।
এ সময় ভোক্তা অধিদফতর বাজারের তথ্য তুলে ধরে জানায়, ২০২০ সালে আধা কেজির যে ডিটারজেন্টের দাম ছিল ৬০ টাকা, সেটি এখন ৯০ টাকা। ৫২ টাকার সাবানের দামও এখন ৭৫ টাকা। অর্থাৎ এ দুই পণ্যের দাম বেড়েছে ৪৪ শতাংশ পর্যন্ত।
এর কারণ হিসেবে কোম্পানিগুলোর প্রতিনিধিরা বলেন, তাদের টয়লেট্রিজ পণ্যের ৮০ শতাংশ কাঁচামালই আমদানি করতে হয়। আন্তর্জাতিক বাজারে এসব কাঁচামালের দাম বাড়ার কারণে উৎপাদন খরচ বেড়েছে ৯৬ শতাংশ পর্যন্ত।
বলা হয়েছে, গত এক বছরে মান ও প্রকারভেদে সাবান-শ্যাম্পুর দাম বেড়েছে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত। ৮০ টাকা থেকে ডাভ সাবান এখন ১৫০ টাকা। ২০০ গ্রাম ওজনের ইমপেরিয়াল লেদার সাবান (থাইল্যান্ড) ৮৫ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ১৯৫ টাকা। মানভেদে ৮০ টাকার গায়ে মাখা সাবান বেড়ে হয়েছে ১৩০-১৫০ টাকা।
বডি স্প্রের দাম বেড়েছে প্রায় ৪০ শতাংশ। ৪০০ মিলির যে নিভিয়া লোশনের দাম ছিল ৬২০ টাকা, তা এখন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭৫০ টাকা। ৩২০ মিলির সানসিল্ক শ্যাম্পুর দাম বেড়েছে ১০০ টাকা। আগে যেটা বিক্রি হতো ৩৬০ টাকায়, তা এখন বেড়ে হয়েছে ৪৬০ টাকা।
২০০ মিলির জিলেট শেভিং জেল ২৫০ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ৩২৫ টাকা। দাম বেড়েছে গুঁড়া সাবানেরও। এক কেজি ওজনের গুঁড়া সাবান এখন ১৫০ টাকা, যা আগে ছিল ৮০ টাকা।
মানভেদে ২০০ গ্রাম ওজনের সব ব্র্যান্ডের টুথপেস্টে ১০-২০ টাকা বেড়েছে। যেমন- ২০০ গ্রাম ওজনের কোলগেট টুথপেস্টের দাম ১৩০ থেকে বেড়ে হয়েছে ১৫০ টাকা।
তবে ইউনিলিভার কর্মকর্তা জাহিদ বলেন, ‘যে পরিমাণ ইনফ্লেসন হয়েছে সে অনুযায়ী আমরা দাম বাড়াই নাই। টুথপেস্টের দাম সে অনুযায়ী বাড়েনি। গত দুই বছরে মাত্র ৬ শতাংশ বেড়েছে তা। ওয়াশিং পাউডার আর সাবানের দাম বেড়েছে।’
কোম্পানিগুলোর প্রতিনিধিদের মধ্যে ইউনিলিভারের সিএফও জাহিদ মালিথা, স্কয়ারের হেড অব অপারেশন মালিক সাইদ, এসিআইয়ের সিনিয়র এক্সিকিউটিভ পলাশ হোসাইনসহ অন্যরা বক্তব্য রাখেন।
সভায় ‘কনজিউমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ’ (ক্যাব) প্রতিনিধি কাজী আব্দুল হান্নান বলেন, ব্র্যান্ড-ভ্যালু আর মানুষের ইমোশনকে পুঁজি করে বড় কোম্পানিগুলো ভোক্তাদের ব্ল্যাকমেইল করছে কি না, সে বিষয়ে নজরদারির সময় এসেছে।
ভোক্তা অধিদফতরের মহাপরিচালক বলেন, কোনো পণ্যের দাম বাড়াতে হলে তার পক্ষে যৌক্তিক কারণ দেখাতে হবে কোম্পানিগুলোকে। সেজন্য তাদের ফ্যাক্টরিতে আমরা যাবো। কত দামে কাঁচামাল আমদানি হচ্ছে, কোন পণ্য উৎপাদনে কত খরচ হচ্ছে এবং কোন পণ্য কী দামে বাজারে বিক্রি হচ্ছে সেগুলো আমরা বিশ্লেষণ করতে চাই। পরবর্তী সময়ে আমরা পর্যবেক্ষণ বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে প্রতিবেদন দেবো। এরপর বিষয়গুলো নিয়ে সিদ্ধান্ত আসবে।