২১ আগস্ট: আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করে দিতে চেয়েছিল তারা

Slider জাতীয়


সেদিন মুহুর্মুহু গ্রেনেড বিস্ফোরণে কেঁপে ওঠে ঢাকার বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ। আর্তনাদ আর প্রাণ বাঁচাতে ছোটাছুটি। রক্তে ভেজা রাজপথ, ছিন্নভিন্ন দেহ। শত শত জুতা-স্যান্ডেল পড়ে ছিল রাস্তায়। ধ্বংসস্তূপের ভেতরে কাতরানি, সাহায্যের জন্য আহাজারি। গোটা জাতি বাকরুদ্ধ হয়ে যায় সেই ভয়াবহতায়। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট। আঠারো বছর পেরিয়ে গেলেও সেই বিভীষিকাময় দিনের কথা আজও ভুলতে পারেনি মানুষ।

বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে দলীয় কার্যালয়ের সামনে আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনার সন্ত্রাসবিরোধী সমাবেশে ভয়াবহ গ্রেনেড হামলায় ২৪ জন নিহত হন। স্প্লিন্টারের আঘাতে তিন শতাধিক আহত হন। এ ঘটনায় মামলার রায়ে আদালত জানিয়েছে, ‘রাষ্ট্রীয় যন্ত্রের সহায়তায় ওই হামলার মাধ্যমে আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করে দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে’।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘মহান আল্লাহর অশেষ রহমত ও জনগণের দোয়ায় আমি অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে যায়। আওয়ামী লীগের নিবেদিতপ্রাণ নেতাকর্মীরা মানববর্ম তৈরি করে আমাকে রক্ষা করেন। বিএনপি-জামায়াত জোট যখনই সরকারে এসেছে, জঙ্গি ও সন্ত্রাসীদের মদদ দিয়ে বাংলাদেশকে ব্যর্থ রাষ্ট্র বানানোর অপচেষ্টা করেছে।’

সেদিন যা ঘটেছিল

সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বোমা হামলা, গোপালগঞ্জে তুষার হত্যাকাণ্ড এবং দেশের বিভিন্ন স্থানে নেতাকর্মী হত্যা ও গ্রেফতারের প্রতিবাদে দলীয় কার্যালয়ের সামনে সমাবেশ ও গণমিছিল ডেকেছিল আওয়ামী লীগ।

২০০৪ সালের সেই ভয়াল দিন বিকাল ৩টা থেকে দলের মধ্যমসারির নেতারা বক্তব্য দেয়া শুরু করেন। ৪টার দিকে জ্যেষ্ঠ নেতাদের বক্তৃতার পালা। সমাবেশের প্রধান অতিথি শেখ হাসিনা আসেন বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে। নেতাকর্মীরা অধীর আগ্রহে নেত্রীর অপেক্ষায় ছিলেন।

যে ট্রাকে সমাবেশের মঞ্চ তৈরি করা হয়েছিল, তার পেছনে বাঁ দিকে একটি সিঁড়ি ছিল ওপরে ওঠার। ট্রাকের শেষ মাথায় ডানদিকে রাখা টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা দিচ্ছিলেন নেতারা। দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনার বক্তৃতা শুরু হয় বিকাল ৫টা ২ মিনিটে। তার দুই পাশে ছিলেন মোহাম্মদ হানিফ, মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়াসহ আওয়ামী লীগের কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতা।

পুরোটা সময় ওই টেবিলের পাশে বসেছিলেন শেখ হাসিনার নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা অবসরপ্রাপ্ত স্কোয়াড্রন লিডার আব্দুল্লাহ আল-মামুন। মঞ্চ থেকে নামার সিঁড়ির কয়েক গজের মধ্যে দাঁড় করিয়ে রাখা ছিল আওয়ামী লীগ সভাপতির বুলেট প্রুফ মার্সিডিজ গাড়ি। সেখানে ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল তারেক আহমেদ সিদ্দিক। ৫টা ২২ মিনিটে বক্তব্য শেষ করে শেখ হাসিনা মাইক থেকে সরে যাওয়ার মুহূর্তেই প্রথম গ্রেনেডটি ছোড়া হয়।

ট্রাকের বাঁ পাশে পড়ে সেটি বিস্ফোরিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ট্রাকে থাকা জ্যেষ্ঠ নেতা এবং নিরাপত্তাকর্মীরা শেখ হাসিনাকে ট্রাকের ওপর বসিয়ে দেন।

এর পরপরই বিস্ফোরিত হয় আরও তিনটি গ্রেনেড। চারদিকে ধোঁয়ায় আছন্ন হয়ে যায়। শেখ হাসিনার নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা অবসরপ্রাপ্ত মেজর শোয়েব মো. তারিকুল্লাহ ট্রাকের সিঁড়ির নিচে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে আওয়ামী লীগ সভাপতিকে নামিয়ে আনতে বলেন।

মায়াসহ দেহরক্ষীরা শেখ হাসিনাকে ধরে নামিয়ে নেয়ার সময় আরেকটি গ্রেনেড ট্রাকের পেছনের ডালায় বাড়ি খেয়ে পাশেই বিস্ফোরিত হয়। ফলে শেখ হাসিনাকে নিয়ে আবার ট্রাকের ওপর বসে পড়তে বাধ্য হন সবাই।

নেতাকর্মী ও নিরাপত্তাকর্মীরা সেখানে শেখ হাসিনাকে ঘিরে তৈরি করেন মানববর্ম। কিন্তু শোয়েব নিচ থেকে জানান, বিস্ফোরণে ট্রাকের তেলের ট্যাংক ফুটো হয়ে গেছে। যে কোনো মুহূর্তে ট্রাকে আগুন ধরে যেতে পারে।

শেখ হাসিনার পায়ের স্যান্ডেল তখন কোথায় ছিটকে গেছে, চশমাও খুঁজে পাচ্ছিলেন না তিনি। ওই অবস্থায় মামুন, শোয়েব এবং অন্যরা মিলে তাকে নিয়ে গাড়ির সামনে বাঁ দিকের আসনে বসিয়ে দেন।

সে সময় ঘটনাস্থলে থাকা নিরাপত্তাকর্মীরা জানান, বিস্ফোরণে আহত নেতাকর্মীদের ছেড়ে যেতে চাইছিলেন না শেখ হাসিনা। অনেকটা ইচ্ছার বিরুদ্ধেই তাকে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ থেকে সুধাসদনে নিয়ে যাওয়া হয়।

শেখ হাসিনা যখন ঘটনাস্থল ত্যাগ করছিলেন, তখনও গ্রেনেড ফাটানো হচ্ছিল। কানে আসছিল গুলির শব্দ। ওই হামলা আর বিস্ফোরণের পর বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে গেলে আহতদের হাসপাতালে পাঠাতে গিয়ে বিপাকে পড়েন নেতাকর্মীরা। ওই অবস্থায় রিকশা, বেবিট্যাক্সি, এমনকি রিকশাভ্যানে করেও আহতদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়ার চেষ্টা করেন তারা।

ঝরে যায় ২৪ প্রাণ

সেদিনের হামলায় ঘটনাস্থলেই নিহত হন ১৬ জন। হামলায় গুরুতর আহত হন মহিলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের স্ত্রী আইভি রহমান। এরপর চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৫৮ ঘণ্টা পর (২৪ আগস্ট) মারা যান। হামলার প্রায় দেড় বছর পর মারা যান ঢাকার প্রথম নির্বাচিত মেয়র মোহাম্মদ হানিফ। সব মিলিয়ে পরে নিহতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ২৪ জনে।

২১ আগস্ট হামলায় নিহত অন্যরা হলেন- শেখ হাসিনার দেহরক্ষী ল্যান্স করপোরাল (অব.) মাহবুবুর রহমান, হাসিনা মমতাজ, রিজিয়া বেগম, রফিকুল ইসলাম (আদা চাচা), রতন শিকদার, মোহাম্মদ হানিফ ওরফে মুক্তিযোদ্ধা হানিফ, মোশতাক আহমেদ, লিটন মুনশি, আবদুল কুদ্দুছ পাটোয়ারী, বিল্লাল হোসেন, আব্বাছ উদ্দিন শিকদার, আতিক সরকার, মামুন মৃধা, নাসিরউদ্দিন, আবুল কাসেম, আবুল কালাম আজাদ, আবদুর রহিম, আমিনুল ইসলাম, জাহেদ আলী, মোতালেব ও সুফিয়া বেগম। একজনের পরিচয় এখনও জানা যায়নি।

আহতদের অনেকের জীবন পরবর্তীতে দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। সে সময় শেখ হাসিনা প্রাণে রক্ষা পেলেও তখন তিনি যে কানে আঘাত পান, সেই বোঝা আজও বয়ে বেড়াচ্ছেন। বাংলাদেশের মাটিতে যত ন্যাক্কারজনক হামলার ঘটনা ঘটেছে তার মধ্যে এটি অন্যতম।

হামলার উদ্দেশ্য

শেখ হাসিনা যেন বাঁচতে না পারেন, তার সব চেষ্টাই সেদিন করেছিল হামলাকারীরা। রাজনৈতিক বিরোধীদের নির্মূল করতে রাষ্ট্রীয় মদদে এই সন্ত্রাসী হামলা হয়েছিল।

অভিযোগপত্র, বাদীদের সাক্ষ্যপ্রমাণ, হরকাতুল জিহাদের (হুজি) প্রধান মুফতি হান্নান ও খালেদা জিয়ার ভাগনে সাইফুল ইসলাম ডিউক যে স্বীকারোক্তি দিয়েছেন, তাতেই এটি পরিষ্কার হয়েছে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে চেয়েছিল সেই সময়ের ক্ষমতাসীন তারেক রহমান।

২১ আগস্ট মামলার রায়ে বিচারক বলেন, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নেতৃত্বশূন্য করতেই রাষ্ট্রযন্ত্রের সহায়তায় আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলা চালানো হয়েছিল।

কারা হামলা চালায়?

হামলায় হুজি সন্ত্রাসীদের ব্যবহার করা হয়েছে। হুজির মতাদর্শ ছিল বিকৃত। যে কারণে হামলা চালাতে তাদের খুব বেশি জোর করতে হয়নি। ধর্মনিরপেক্ষ নেতৃত্বের জন্য শেখ হাসিনাকে ‘ইসলামের শত্রু’ হিসেবে বিবেচনা করত তারা। সেই বিকৃত ধারণা থেকেই এই ন্যাক্কারজনক হামলা চালানো হয়।

হামলার মূল পরিকল্পনাকারী ছিলেন তারেক রহমান। এছাড়াও তখনকার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক সচিব হারিস চৌধুরী, জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু, এনএসআই-এর মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আব্দুর রহিম ও ডিজিএফআই-এর পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী। মুফতি হান্নানের স্বীকারোক্তিমূলক বিবৃতি অনুসারে- বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী মেজর নূর চৌধুরীও সেই হামলার ঘটনায় সক্রিয় অংশগ্রহণকারী ছিল।

তারেক রহমানের রাজনৈতিক কার্যালয় হাওয়া ভবনে বিএনপির সংসদ সদস্য শাহ মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদ হুজি হামলাকারী এবং বিএনপি-জামায়াতের পরিকল্পনাকারীদের মধ্যে বৈঠকের ব্যবস্থা করে। হাওয়া ভবনে ছাড়াও মোহাম্মদপুরের হুজির আস্তানায় ও ধানমণ্ডিতে বিএনপির উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুর বাসভবনে অন্যান্য পরিকল্পনা সভা হয়। ওই সময় তাজউদ্দীন নামের এক হুজি সদস্য হত্যাকারীদের কাছে গ্রেনেড সরবরাহ করে।

মুফতি হান্নানের স্বীকারোক্তি

২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা নিয়ে স্বীকারোক্তি দেয় মুফতি হান্নান। সে জানায়, তারেক রহমানের সঙ্গে তাদের যোগাযোগের সিদ্ধান্ত হয়। এরপর একদিন মুরাদনগরের এমপি কায়কোবাদ তাদের হাওয়া ভবনে নিয়ে তারেক রহমান ও হারিছ চৌধুরীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়। বৈঠকে সহযোগিতা ও সাহায্যের আশ্বাস দেয় তারেক রহমান।

মুফতি হান্নান জানায়, ১৪ আগস্ট হাওয়া ভবনে বৈঠকে শেখ হাসিনার প্রতি বিষোদগার করে তার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেয়ার কথা বলে তারেক রহমান। তাতে সায় দেয় আলী আহসান মুজাহিদ। এ বৈঠকেই শেখ হাসিনাকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় তারেক।

হামলার পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন

হামলার পরিকল্পনা করা হয়, তখনকার ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুখ্যাত হাওয়া ভবন থেকে ২০০৪ সালের ১৪ আগস্ট। সেদিনের বৈঠকে তারেক-বাবর ছাড়াও বঙ্গবন্ধুর খুনি মেজর নুর, আলী আহসান মুজাহিদ, হারিছ চৌধুরী, আবদুস সালাম পিন্টু, হরকাতুল জিহাদের নেতা মুফতি হান্নান ও জঙ্গি তাজউদ্দীন উপস্থিত ছিল।

বৈঠকে শেখ হাসিনার ওপর হামলায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার সহায়তার নিশ্চয়তাও দেয় তারেক রহমান।

এর দুদিন পরেই হামলার পরিকল্পনা ও সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। মিন্টু রোডে বাবরের বাসায় বৈঠকে হামলার পূর্ণাঙ্গ পরিকল্পনা ও হামলার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। আর ১৮ আগস্টের বৈঠকটি হয়েছে আবদুস সালাম পিন্টুর বাসায়। এতে পিন্টুর ভাই তাজউদ্দীন, খালেদা জিয়ার ভাগনে ডিউকও ছিল। হরকাতুল জিহাদের কাছে আর্জেস গ্রেনেড হস্তান্তর করে বাবর।

হামলাকারীরা পুলিশের সহায়তায় পালিয়ে যায়। এমনকি আহতদেরও হাসপাতালে নিতে বাধা দেয়া হয়। ঘটনাস্থল থেকে সব ধরনের প্রমাণ মুছে দেয়া হয়।

অপারেশন লাইট স্ন্যাকস ফর শেখ হাসিনা

হামলার একদিন আগে হুজি হত্যাকারীরা কাজল এবং আবু জানদাল বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে হামলার স্থান পরিদর্শন করে। অভিযানের নাম দেয়া হয় লাইট স্ন্যাকস ফর শেখ হাসিনা। ২১ আগস্ট, তারা বাড্ডায় একটি পূর্বনির্ধারিত বাড়িতে সাক্ষাৎ করে। সেখানেই সিদ্ধান্ত হয়, কাজল ও আবু জান্দালের নেতৃত্বাধীন মোট ১২ জন ওই ঘটনায় অংশ নেবে। তারপর তারা একসঙ্গে নামাজ পড়বে এবং মধ্যাহ্নভোজ করবে। চূড়ান্ত বৈঠকের পর মাওলানা সাঈদ জিহাদ বক্তৃতা দেয়। এরপর মুফতি হান্নান ১২ জন হামলাকারীর কাছে ১৫টি গ্রেনেড হস্তান্তর করে।

আলোচনা অনুযায়ী আসরের নামাজের পর তারা সবাই গোলাপ শাহ মাজারের কাছে যায়। এরপর তারা ট্রাকের চারপাশে অবস্থান নেয়। যেখানে আওয়ামী লীগ নেতারা সমাবেশে বক্তব্য রাখেন। শেখ হাসিনার বক্তব্য শুরু হলে আবু জানদাল প্রথম গ্রেনেডটি ছোড়ে। তারপর প্রত্যেকে নিজের গ্রেনেড নিক্ষেপ করে সেখান থেকে সরে যায়। নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের সহায়তায় তারা দিনের আলোতে অপরাধ করে নিরাপদে পালিয়ে যেতে পারে।

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া

ভয়াল এই হামলা নিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা গিয়েছিল। বিশ্ব নেতারা এই নৃশংসতার নিন্দা জানিয়েছেন। দায়ীদের বিচারের আওতায় নিয়ে আসতে তখনকার বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট সরকারের কাছে তারা বারবার আহ্বান জানান।

সংবাদমাধ্যমে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন বলেন, আওয়ামী লীগ সভাপতির সমাবেশের সেই ভয়ঙ্কর ঘটনা পুরো বিশ্বকেই নাড়া দিয়েছিল, যা পরবর্তী প্রতিক্রিয়ায় স্পষ্ট হয়। যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, চীন বা ইউরোপ- সবাই দফায় দফায় এ নিয়ে তখন বিবৃতি দিয়েছে, কথা বলেছে।

৯/১১ এর হামলার পর তখন এমনিতেই সন্ত্রাসবাদ নিয়ে উদ্বেগ ছিল বিশ্বজুড়ে। এমন এক পরিস্থিতিতে ঢাকার সেই ভয়াবহ হামলা সন্ত্রাসবাদের ঝুঁকিকেই আরও স্পষ্ট করে তোলে। যে কারণে গ্রেনেড হামলা নিয়ে বেশ উদ্বেগ তৈরি হয়েছিল পশ্চিমা বিশ্বে ও আঞ্চলিক শক্তিগুলোর মধ্যে।

বিবিসিসহ আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার খবর ফলাও করে প্রচার হয়। হামলার কয়েক ঘণ্টা পরেই শেখ হাসিনাকে ফোন করেন ভারতের তখনকার প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং। এরপর বিবৃতি দেন সেই সময়ের জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইয়শকা ফিশার। শেখ হাসিনার সঙ্গে ফোনে কথা বলেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী কলিন পাওয়েল।

২২ আগস্ট শেখ হাসিনার সঙ্গে ফোনে কথা বলেন তখনকার তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী নাজমউদ্দিন এরবাকান, ভারতের কংগ্রেস নেত্রী সোনিয়া গান্ধী, ভারতীয় লোকসভায় বিরোধী দলীয় নেতা এল কে আদভানি এবং যুক্তরাষ্ট্রের সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ক্রিস্টিনা রোকা।

এছাড়া পৃথকভাবে বিবৃতিও আসে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ভারতীয় হাইকমিশনের কাছ থেকে। এসব বিবৃতিতে স্পষ্টভাবেই হামলায় জড়িতদের বিচারের আওতায় আনার জন্য বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছিল।

যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত হ্যারি কে টমাস ও ভারতীয় রাষ্ট্রদূত বিনা সিক্রী সেদিন ঢাকায় আলাদাভাবে শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করে সমবেদনা জানান। ২৩ আগস্ট যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ গভীর দুঃখ প্রকাশ করেন।

শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন ঢাকায় ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরী। এছাড়া নেদারল্যান্ডস, সুইডেন, ডেনমার্ক, ফ্রান্স, জার্মানি ও ইতালির রাষ্ট্রদূতরাও দেখা করে নিজ দেশের সরকারপ্রধানের বার্তা শেখ হাসিনার কাছে পৌঁছে দেন। শ্রীলঙ্কার রাষ্ট্রদূত ছাড়াও শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করেন পাকিস্তানের সিনেটর ইকবাল হায়দার।

এরপর ২৪ আগস্ট তখনকার জাতিসংঘ মহাসচিব কফি আনান ঘটনার তীব্র নিন্দা জানান।

তদন্ত ও বিচারে বাধা

হামলায় জামায়াতসহ সরকার ও নিরাপত্তা কর্মকর্তারা জড়িত ছিল। যে কারণে তারা এ নৃশংস ঘটনায় কোনো সঠিক তদন্ত চায়নি। ‘জজ মিয়া’ নাটক সাজিয়ে তারা পরিস্থিতি অন্যদিকে ঘুরিয়ে দিতে চেয়েছিল। বিচার থেকে রেহাই দেয়া হয়েছিল হামলাকারীদের।

স্বেচ্ছাসেবক ও ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দ সব ধরনের সভা সমাবেশে আওয়ামী লীগের নিরাপত্তায় কাজ করলেও ২১ আগস্ট আশপাশের ভবনের কোনো ছাদে তাদের যাওয়ার অনুমতি দেয়া হয়নি।

গ্রেনেড বিস্ফোরণের পরপরই পুলিশ টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ করে। যেসব নেতাকর্মী আহতদের উদ্ধার করছিল, তাদের লাঠিপেটা করা হয়। ওই সময়ই তারা হামলাকারীদের পালিয়ে যেতে সাহায্য করে। হামলার পরবর্তী সময়ে ঘটনাস্থল থেকে প্রমাণ নষ্ট করে দেয়া হয়। এমনকি উদ্ধারকৃত গ্রেনেডগুলো সংরক্ষণের বদলে ধ্বংস করা হয়।

বিএনপি-জামায়াত সরকার বিচারপতি জয়নাল আবেদীনের নেতৃত্বে এক ব্যক্তির জুডিশিয়াল কমিশন গঠন করে। যা ছিল কেবল লোক দেখানো। হাস্যকরভাবে তদন্ত শেষ করে এই কমিশন। প্রতিবেদনের উপসংহার ছিল এমন: ‘বিদেশি ও স্থানীয় শত্রুরা এই হামলা চালিয়েছিল’। দুবছর পরে একই বিচারপতি জয়নাল সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে উন্নীত হন। ধারণা করা হচ্ছে, এই প্রতিবেদনের পুরস্কার হিসেবে তাকে পদোন্নতি দেয়া হয়েছিল।

হামলার সঙ্গে জজ মিয়া নামের এক নির্দোষ ব্যক্তিকেও জড়িয়েছিল বিএনপি-জামায়াত সরকার। ২০০৫ সালের ১০ জুন ফৌজদারি তদন্ত বিভাগের কর্মকর্তারা জজ মিয়াকে তার নিজ বাড়ি থেকে গ্রেফতার করে। তিন বছর পর নির্দোষ প্রমাণিত হলে তাকে কারাগার থেকে মুক্তি দেয়া হয়। একই রকম আরেকজন ব্যক্তি ছিলেন যার নাম পার্থ। বলপ্রয়োগ করে তাকে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিতে বলা হয়।

হামলায় অন্যতম পরিকল্পনাকারী সন্ত্রাসী তাজউদ্দিন ছিল বিএনপির উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুর ছোট ভাই। তারেক রহমানের নির্দেশে ডিউকসহ অন্যদের পাকিস্তানে পালিয়ে যেতে সাহায্য করা হয়।

হুজিপ্রধান মুফতি হান্নান ২১ আগস্ট হামলায় জড়িত থাকলেও বিএনপি-জামায়াত সরকার তাকে গ্রেফতার করেনি। কিন্তু অন্য মামলায় গ্রেফতার হওয়ার পর সে ২১ আগস্ট হামলায় জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে।

খালেদা জিয়ার বিতর্কিত ভূমিকা

ন্যাক্কারজনক এ হামলার সময় প্রধানমন্ত্রী ছিলেন খালেদা জিয়া। কিন্তু সরকারপ্রধান হয়েও তিনি যে ভূমিকা রাখেন, তাতে তার আসল চেহারা বেরিয়ে আসে। তিনি সংসদে হাস্যরস করে মন্তব্য করেছিলেন: ‘কে তাকে হত্যা করতে চায়?’। আরও বলেছিলেন যে শেখ হাসিনা তার নিজের ভ্যানিটি ব্যাগে করে জনসভায় গ্রেনেড নিয়ে এসেছিলেন।

এ সময় বিএনপি-জামায়াত নেতাকর্মীরা বলেন, বিদেশে সহানুভূতি পেতে নিজের লোকদের ওপর হামলা চালায় আওয়ামী লীগের লোকজন। আরও একটি বিতর্কিত ভূমিকা রাখেন বিএনপি চেয়ারপারসন। ২১ আগস্ট হামলার তদন্ত করার জন্য খালেদা জিয়াকে তখনকার ডিজিএফআইপ্রধান রুমী জিজ্ঞেস করলে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন।

মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ১৯ জন

বিচারিক আদালতের রায়ে ১৯ আসামিকে মৃত্যুদণ্ড ও এক লাখ টাকা করে অর্থদণ্ড দেয়া হয়। তারা হলেন- সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, সাবেক উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু, মেজর জেনারেল (অব.) রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবদুর রহিম (সম্প্রতি মারা গেছেন), হানিফ পরিবহনের মালিক মো. হানিফ, জঙ্গি নেতা মাওলানা তাজউদ্দিন, মাওলানা শেখ আবদুস সালাম, মাওলানা শেখ ফরিদ, মাওলানা আবু সাইদ, মুফতি মঈনউদ্দিন শেখ ওরফে আবু জানদাল, হাফেজ আবু তাহের, ইউসুফ ভাট ওরফে মাজেদ ভাট, আবদুল মালেক, মফিজুর রহমান ওরফে মহিবুল্লাহ, আবুল কালাম আজাদ ওরফে বুলবুল, জাহাঙ্গীর আলম, হোসাইন আহমেদ তামিম, রফিকুল ইসলাম ওরফে সবুজ ও উজ্জ্বল ওরফে রতন।

যে ১৯ জনের যাবজ্জীবন

১৯ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও ৫০ হাজার টাকা করে অর্থদণ্ড দেয় আদালত। তারা হলেন- বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, বিএনপি নেতা হারিছ চৌধুরী, কাজী শাহ মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদ ও আরিফুল ইসলাম আরিফ, জঙ্গিনেতা মুফতি আবদুর রউফ, হাফেজ ইয়াহিয়া, মুফতি শফিকুর রহমান, মুফতি আবদুল হাই, মাওলানা আবদুল হান্নান ওরফে সাব্বির, মুরসালিন, মুত্তাকিন, জাহাঙ্গীর বদর, আরিফ হাসান ওরফে সুমন ওরফে আবদুর রাজ্জাক, আবু বকর সিদ্দিক ওরফে হাফেজ সেলিম হাওলাদার, মো. ইকবাল, রাতুল আহমেদ, মাওলানা লিটন, মো. খলিল ও শাহাদত উল্লাহ ওরফে জুয়েল।

এছাড়াও বিভিন্ন মেয়াদে ১১ জনকে দণ্ড দেয়া হয়। তারা হলেন- মেজর জেনারেল (অব.) এ টি এম আমীন, লে. কর্নেল (অব.) সাইফুল ইসলাম জোয়ারদার, লে. কমান্ডার (অব.) সাইফুল ইসলাম ওরফে ডিউক, সাবেক আইজিপি আশরাফুল হুদা, সাবেক আইজিপি শহিদুল হক, সাবেক ডিআইজি খান সাঈদ হাসান, ডিএমপির সাবেক ডিসি (পূর্ব) ওবায়দুর রহমান খান, সাবেক আইজিপি খোদা বক্স চৌধুরী, জোট সরকার আমলের তদন্ত কর্মকর্তা সাবেক এএসপি আবদুর রশিদ, সাবেক এএসপি মুন্সী আতিকুর রহমান ও সাবেক পুলিশ সুপার রুহুল আমীন।

রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান কৌঁসুলি যা বললেন

বিচারিক আদালতে এই মামলার রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান কৌঁসুলি বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান সৈয়দ রেজাউর রহমান বলেন, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের ধারাবাহিকতায় এই হামলা চালানো হয়েছিল। আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাকে হত্যা করে আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য ও দেশকে অকার্যকর করাই ছিল ওই হামলার উদ্দেশ্য।

তিনি বলেন, ওই হামলায় সমরাস্ত্র আর্জেস গ্রেনেড ব্যবহার করা হয়। জঙ্গিরা তৎকালীন ক্ষমতাসীন মহলের প্রত্যক্ষ মদদ ও সহায়তায় বর্বরোচিত এ মামলা চালায় আওয়ামী লীগ ও সাধারণ মানুষের প্রতিবাদ সমাবেশের ওপর। সৈয়দ রেজাউর রহমান বলেন, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় আর্জেস গ্রেনেডের স্প্রিন্টার দেহে বহন করে অসুস্থ হয়ে পরবর্তীতে মৃত্যুবরণ করেন ঢাকার সাবেক মেয়র ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি মোহাম্মদ হানিফ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *