ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন ২৬ কাউন্সিলর ঠিকাদার অন্যরা ব্যবসায়ী

Slider জাতীয়

 

 

ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে কাউন্সিলর পদে নির্বাচিত ব্যক্তিদের ১৭ জনই ঠিকাদার। আর পেশা হিসেবে ঠিকাদার উল্লেখ না করলেও বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি দপ্তরে নির্মাণসামগ্রী, পণ্য ও সেবা সরবরাহ করে থাকেন আরও নয়জন কাউন্সিলর। সব মিলিয়ে ঠিকাদার ও সরবরাহকারী কাউন্সিলর এখন ২৬ জন।
নির্বাচন কমিশনে জমা দেওয়া হলফনামা ধরে অনুসন্ধান করে দেখা গেছে, নির্বাচিত কাউন্সিলরদের মধ্যে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে নয়জন এবং দক্ষিণে আটজন ঠিকাদার। আর সরবরাহকারীদের মধ্যে পাঁচজন উত্তর সিটিতে এবং চারজন দক্ষিণে। ঠিকাদারি, সরবরাহকারী ও সাধারণ ব্যবসায়ী মিলিয়ে দুই সিটির কাউন্সিলরদের মধ্যে ৯৩ শতাংশই ব্যবসায়ী। নির্বাচিত কাউন্সিলরদের অনেকেই ২০০৯ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার গঠনের পর রাতারাতি বিপুল টাকাপয়সার মালিক বনে গেছেন।
প্রথম আলোর অনুসন্ধানে জানা গেছে, সরকারি দলের নেতা হওয়ার সুবাদে অনেক কাউন্সিলর নিজে ঠিকাদারি না করেও সিটি করপোরেশনসহ সরকারি বিভিন্ন দপ্তরের ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণ করেন। অনেকের বিরুদ্ধে নিজ নিজ এলাকায় বাহিনী লালন ও চাঁদাবাজির অভিযোগ রয়েছে।
এবার দুই সিটি করপোরেশনে মেয়র পদের প্রার্থীদের বেশির ভাগই ছিলেন তরুণ। ঢাকা দক্ষিণের নির্বাচিত মেয়র সাঈদ খোকন সবে ৪৫-এ পা দিয়েছেন। উত্তরের মেয়র আনিসুল হকের বয়স ৬৩। নির্বাচিত কাউন্সিলরদের মধ্যে অন্তত ২০ জনের বয়স ৪০ বা এর চেয়ে কম। বাকিদের বড় অংশের বয়স ৫০ বছরের মধ্যে।
আইনে মোটা দাগে সিটি করপোরেশনের কাজ চিহ্নিত করা আছে ২৮টি। সড়ক নির্মাণ, মেরামত, রক্ষণাবেক্ষণসহ বেশির ভাগ কাজই করা হয় ঠিকাদারের মাধ্যমে। সিটি করপোরেশনের নিজস্ব কাজ ছাড়াও ওয়াসা, টিঅ্যান্ডটি, বিদ্যুৎ বিভাগের সঙ্গে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ির কাজ আছে। কাউন্সিলর প্রার্থীদের অনেকেই নিজেকে ওয়াসা কিংবা বিদ্যুৎ বিভাগের ঠিকাদার বলে উল্লেখ করেছেন। এ ধরনের আরও ৫৬টি সরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সিটি করপোরেশনের কর্মসম্পর্ক রয়েছে।
জানতে চাইলে স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, অতীতে ঠিকাদার কাউন্সিলররা কাজ ভাগাভাগি নিয়ে ব্যস্ত থেকেছেন। এবার নতুন ঠিকাদারেরা যোগ হয়েছেন। এতে মেয়রের কাজটা কঠিন হয়ে যাবে। মানসম্মত কাজ আদায় করতে বেগ পেতে হবে। তিনি জানান, আইনে কাউন্সিলর এবং তাঁদের স্বজনেরা সিটি করপোরেশনে ঠিকাদারি করতে পারেন না। তবে অভিজ্ঞতা বলছে, প্রতিবারই তাঁরা বেনামে কাজ করেন কিংবা কাজ ভাগাভাগি করে থাকেন।
ঢাকা দক্ষিণের মতিঝিল এলাকা নিয়ে গঠিত ৯ নম্বর ওয়ার্ড থেকে প্রথমবারের মতো কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছেন এ কে এম মমিনুল হক সাইদ। ঢাকা মহানগর যুবলীগ দক্ষিণের যুগ্ম সম্পাদক মমিনুল হকের পেশা ঠিকাদারি। ঢাকা সিটি করপোরেশন ছাড়াও গণপূর্ত অধিদপ্তর, স্বাস্থ্য প্রকৌশল দপ্তর, বিআইডব্লিউটিএসহ সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে তিনি কাজ করেন।
ঠিকাদারির বাইরে মমিনুল হকের আয়ের বড় একটি উৎস মতিঝিলের ক্লাবপাড়ার জুয়া ও হাউজির বোর্ড। ওই এলাকার ফুটপাতের কোথায় কার দোকান বসবে, এটাও তাঁর নিয়ন্ত্রণে। ২০০৯ সালে শেখ হাসিনার সরকার গঠনের পরই তাঁর আধিপত্য প্রতিষ্ঠা হয়।
হলফনামা অনুসারে ঠিকাদারি ব্যবসা থেকে মমিনুল হকের বার্ষিক আয় ১৮ লাখ ৬৯ হাজার টাকা। কিন্তু স্থাবর-অস্থাবর কোনো সম্পদ নেই।
জানতে চাইলে মমিনুল হক দাবি করেন, তিনি সিটি করপোরেশনে ঠিকাদারি করেন না। আর জুয়া ও হাউজি পরিচালনা যারা করে, তারা স্বাধীন প্রতিষ্ঠান এবং সরকারের অনুমতি নিয়ে করে। এতে তাঁর কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। ফুটপাত দখলের কথা নাকচ করে তিনি বলেন, এগুলো প্রশাসনের ব্যর্থতা। তিনি আরও বলেন, আয়-ব্যয় ও সম্পদের হিসাব আয়কর নথিতেই আছে। এই বিষয়ে কিছু বলার নেই।
গুলিস্তান এলাকা নিয়ে গঠিত দক্ষিণেরই ২০ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ফরিদ উদ্দিন আহম্মেদ রতন। দক্ষিণের নগর ভবনও পড়েছে এই ওয়ার্ডে। ঠিকাদার এই কাউন্সিলরের ব্যাপক প্রভাব রয়েছে নগর ভবনে। বিদ্যুৎ ভবনের দরপত্রেও তাঁর একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ।
গুলিস্তানে টিঅ্যান্ডটি ভবনের দেয়াল ঘেঁষে ফুটপাত দখল করে গত বছর কয়েক শ দোকান গড়ে ওঠে। অভিযোগ রয়েছে, ফরিদ উদ্দিনের নেতৃত্বেই এগুলো হয়েছে। এ ছাড়া গুলিস্তানের ফুটপাতের হকারদের একটা বড় অংশের নিয়ন্ত্রণ তাঁর হাতে।
হলফনামা অনুসারে ব্যবসা খাত থেকে ফরিদ উদ্দিনের বার্ষিক আয় সোয়া চার কোটি টাকা। এ ছাড়া নিজের নামে পল্টন এলাকায় ফ্ল্যাট ছাড়াও স্ত্রীর নামে কৃষি-অকৃষি জমি রয়েছে।
জানতে চাইলে ফরিদ উদ্দিন বলেন, ‘ফুটপাত ও টেন্ডারবাজির কথা শুনলে আমার লজ্জা লাগে। খুদ খেয়ে পেট খারাপ আমি করি না। বিদ্যুৎ খাতে যে ব্যবসা আছে এবং পারিবারিক সম্পদই যথেষ্ট।’
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ঢাকা মহানগর দক্ষিণ ছাত্রলীগ সভাপতি আনিসুর রহমানেরও জীবন পাল্টে গেছে। এবার যোগ হয়েছে গোড়ান এলাকা নিয়ে গঠিত ঢাকা দক্ষিণের ২ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলরের পদ। পেশা হিসেবে উল্লেখ করেছেন আমদানি-রপ্তানি। কিন্তু স্থানীয় ঠিকাদারির নিয়ন্ত্রণ তাঁর হাতেই।
হলফনামা অনুসারে নিজ নামে ৩৪ লাখ টাকার ফ্ল্যাট আছে আনিসের। বাড়িভাড়া ও ব্যবসা থেকে বার্ষিক আয় প্রায় সাড়ে তিন লাখ টাকা।
জানতে চাইলে আনিস দাবি করেন, ঠিকাদারি তিনি করেন না। নিয়ন্ত্রণও নেই। আমদানি-রপ্তানিই তাঁর মূল আয়ের উৎস। বাড়িটা পৈতৃক সম্পত্তি।
মোহাম্মদপুর-বছিলা ও কাটাসুর এলাকা নিয়ে গঠিত ঢাকা উত্তরের ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর হয়েছেন তারেকুজ্জামান রাজীব। এবারের সিটি নির্বাচনে সাধারণ ওয়ার্ডে নির্বাচিত কাউন্সিলরদের মধ্যে তিনি সর্বকনিষ্ঠ। যুবলীগের রাজনীতি করেন। দলের সমর্থন না পেলেও দল-সমর্থিত প্রার্থীকেই হারিয়েছেন। তারেকুজ্জামান স্থানীয় সাংসদ জাহাঙ্গীর কবির নানকের লোক হিসেবে পরিচিত। তাঁর নিয়ন্ত্রণেই স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ও সিটি করপোরেশনের মাধ্যমে ওই এলাকায় নির্মাণ ও মেরামতকাজ হয়েছে সাম্প্রতিক সময়ে।
হলফনামা অনুসারে তারেকুজ্জামান আবাসন ব্যবসায়ী ও ঠিকাদার। ব্যবসা ও বাড়িভাড়া থেকে বছরে প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখ টাকা আয় করেন।
জানতে চাইলে তারেকুজ্জামান বলেন, ঠিকাদারি তিনি করেন না। পেশা হিসেবে হলফনামায় ঠিকাদারি উল্লেখ আছে মনে করিয়ে দিলে তিনি বলেন, এটা হয়তো ভুল হয়েছে। তবে এলাকার উন্নয়নমূলক কাজে স্ব-উদ্যোগে অংশ নেন বলে দাবি করেন তিনি।
মহাখালী এলাকা নিয়ে গঠিত ২০ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মো. নাছির। টেন্ডারবাজি ছাড়াও গুলশান-বাড্ডা এলাকায় বাড়ি-জমি বিক্রির মধ্যস্থতাকারী হিসেবেও তিনি পরিচিত। নিজস্ব বাহিনী রয়েছে তাঁর। আওয়ামী লীগ-সমর্থিত প্রার্থীকে হারিয়ে কাউন্সিলর হয়েছেন যুবলীগের এই নেতা।
হলফনামা অনুসারে নাসিরের ঠিকাদারি ব্যবসা থেকে বার্ষিক আয় মাত্র পৌনে তিন লাখ টাকা। নিজের ও স্ত্রীর নামে ব্যাংকে, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে শেয়ার ও নগদ টাকা আছে প্রায় দুই কোটি। নিকুঞ্জ এলাকায় তিন কাঠার একটি প্লটও আছে নাসিরের।
গুলশান-কালাচাঁদপুর এলাকা নিয়ে গঠিত ১৮ নম্বর ওয়ার্ডের নতুন কাউন্সিলর জাকির হোসেন। যুবলীগ উত্তরের এই নেতা নিজে সরাসরি ঠিকাদারি করেন না। তবে সিটি করপোরেশনসহ বিভিন্ন দপ্তরের কাজ কে পাবে না পাবে, তার মধ্যস্থতা করেন। বসুন্ধরা আবাসিক এলাকাসহ ওই অঞ্চলের জমি কেনাবেচার মধ্যস্থতাকারী হিসেবেও তাঁর পরিচিতি আছে।
হলফনামা অনুসারে নিজের ব্যবসা এবং বাড়িভাড়া ও নির্ভরশীলদের উপার্জন মিলে জাকিরের বার্ষিক আয় প্রায় আট লাখ টাকা। এর বাইরে নিজের নামে পাঁচতলা বাড়ি ও দোকান এবং নির্ভরশীলদের নামে জমি ও বাড়ি আছে।
মুঠোফোনে চেষ্টা করেও মো. নাসির ও জাকিরের সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি।
ঢাকা উত্তরের ৩৬ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর হয়েছেন যুবলীগের নেতা ও সাংসদ নুরুন্নবী চৌধুরীর স্ত্রীর ভাই তৈমুর রেজা। তাঁর বিরুদ্ধে সিটি করপোরেশনে টেন্ডারবাজির অভিযোগ রয়েছে।
নির্বাচনের আগে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তৈমুর রেজা বলেছিলেন, তিনি এখন আর সিটি করপোরেশনে ঠিকাদারি করেন না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *