রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ : বৈশ্বিক খাদ্যসঙ্কট

Slider সারাবিশ্ব


রাশিয়া ও ইউক্রেনের উৎপাদিত গমে বিশ্ব চাহিদার ৩০ শতাংশ পূরণ হতো। গত ২৪ ফেব্রুয়ারি দেশ দু’টির মধ্যে যুদ্ধ শুরুর পর থেকে রাশিয়া ইউক্রেনের বন্দর অবরোধ করে রাখে। এর প্রতিক্রিয়ায় আফ্রিকায় ‘রুটি আন্দোলন’ শুরু হয়েছে। শুধু আফ্রিকা নয়; যেসব দেশের খাদ্য নিরাপত্তা আমদানির ওপর নির্ভরশীল সেসব দেশেও এ ধরনের সমস্যা শুরু হয়েছে। অনেকে ধারণা করছেন, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সাথে যুদ্ধ বন্ধে নিশ্চয় ইউক্রেনের একটি চুক্তি হবে।

প্রেসিডেন্ট পুতিনের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে, তিনি ইউক্রেনের বড় বন্দর ব্লক করেছেন যুদ্ধের শুরুতে। পশ্চিমা দুনিয়া রাশিয়াকে আহ্বান জানায়, ইউক্রেনের অবরুদ্ধ বন্দর চালু করে দিতে; যেন ইউক্রেন গম রফতানি করতে পারে। ইতোমধ্যে রাশিয়া ইউক্রেনের বন্দর খুলে দিতে একটি চুক্তি করেছে বটে। কিন্তু চুক্তির পর দিনই হামলা চালায় রাশিয়া। আন্তর্জাতিক খবরে প্রকাশ; কেবল ইউক্রেনের বন্দরে ১৫ কোটি টন গম আটকে আছে। আন্তর্জাতিক খাদ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ পরিমাণ বর্তমান বিশ্বের গম বাণিজ্যের ১০ শতাংশ। যে কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে গমের দাম বেড়েছে এবং দুর্ভিক্ষের কবলে বিশ্বের কিছু দেশ।

বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) সংস্থার গত জুনের তথ্য অনুসারে, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে আফ্রিকার প্রায় দুই কোটি মানুষের খাদ্যাভাব দেখা দিয়েছে। ইউক্রেনের কৃষিপণ্য রফতানির প্রধান বন্দর ওডেসাকে যুদ্ধের শুরুতে রাশিয়া অবরুদ্ধ করে রাখায় বিশ্বে খাদ্যসঙ্কটের শুরু। ডব্লিউএফপির রিপোর্ট বলছে, আফ্রিকার কয়েকটি দেশে জরুরি ভিত্তিতে খাদ্য সরবরাহ করা না হলে ওইসব অঞ্চলে আবারো দুর্ভিক্ষ শুরু হবে। কেনিয়ায় গত দু’বছরে যে দুর্ভিক্ষ শুরু হয়েছে বর্তমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে সেখানে দুর্ভিক্ষ চারগুণ বৃদ্ধি পাবে এবং ইথিওপিয়ার সাত লাখের বেশি মানুষকে দৈনিক খাদ্য সহায়তা দিতে হবে।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে থেকে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব, কোভিড-১৯ মহামারীর কারণে আফ্রিকান অঞ্চলে খাদ্যাভাব শুরু হয়। কিন্তু খাদ্যশস্যের অভাব, নিজের দেশের সংরক্ষণবাদ নীতি কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা লাগানোর মতো অসহ্য হয়ে উঠেছে। এটি ঠিক, ইউক্রেনের খাদ্য রফতানি হয়েছে রাশিয়ার কারণে। কিন্তু বিশ্বের ৫১ শতাংশ গমের স্টক রয়েছে চীনে। এর বাইরে চীন আরো ২০ শতাংশ স্টক বাড়িয়েছে। চীনা গমের স্টকও বৈশ্বিক খাদ্য ঘাটতির আরেকটি কারণ। এ ছাড়া গত চার বছরে বিশ্বে গমের উৎপাদন বেড়েছে ৮ শতাংশ। আগে মোট গম উৎপাদন ছিল ৭৩ কোটি ২০ লাখ টন, উৎপাদন বেড়ে হয়েছে ৭৯ কোটি টন। তা সত্তে¡ও গম রফতানি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় পৃথিবীর কিছু কিছু দেশে দুর্ভিক্ষাবস্থা শুরু হয়ে গেছে।

কৃষি অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ‘প্রকৃতপক্ষে গম উৎপাদনের চিত্রটি পুরোটা খারাপ নয়। এখনো বিশ্বব্যাপী খাদ্য সরবরাহ নীতি ইতিবাচক রয়েছে। কিন্তু যুদ্ধের কারণে জাহাজ ভাড়া বৃদ্ধি ও বাণিজ্য কমে যাওয়ায় খাদ্যদ্রব্যের দাম দ্রুততার সাথে বেড়ে যাচ্ছে। একই সাথে আবার সারের দামও বৃদ্ধি পেয়েছে। এটিও খাদ্যপণ্যের দামে প্রভাব ফেলেছে।’ খাদ্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায়, অর্থ খরচ করে খাদ্য কিনতে না পারায় বিশ্বের দরিদ্রতম ও উন্নয়নশীল দেশগুলোতে সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়েছে। গত ১ জুন থেকে পরবর্তী দুই সপ্তাহ কৃষিপণ্যের মূল্যসূচক ৫ শতাংশ কমেছে। কিন্তু তখনো এটি জানুয়ারি ২০২১ থেকে ৪০ শতাংশ বেশি। জানুয়ারি ২০২১ সালের সাথে জানুয়ারি ২০২২-এর তুলনা করলে দেখা যায়, অন্যান্য শস্য এবং গমের মূল্য ছিল যথাক্রমে ৪২ শতাংশ ও ৬০ শতাংশ বেশি। বিপরীতে চালের মূল্য ১২ শতাংশ কম ছিল সরবরাহ বৃদ্ধি পাওয়ায় এবং ধান উৎপাদনে সমস্যাও দেখা দেয়নি। শিকাগো মার্কেন্টাইল এক্সচেঞ্জের তথ্য অনুসারে, ‘২০২২ সালের শুরুতে প্রতি কেজি গমের দাম ছিল ০.২৭ ডলার এবং ২০ জুন ২০২২ গমের দাম বেড়ে দাঁড়ায় কেজিতে ০.৩৮ ডলার।

কৃষি অর্থনীতিবিদরা বলছেন, অভ্যন্তরীণ খাদ্যে যে মূল্যস্ফীতি চলছে তা আরো উচ্চ মূল্যস্ফীতির মধ্যেই থাকতে পারে আগামী তিন বছর। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত ৯০ শতাংশ উদীয়মান অর্থনীতির দেশে ৫ শতাংশের বেশি ছিল মূল্যস্ফীতি। আবার অনেক দেশে মূল্যস্ফীতি ডাবল ডিজিট অতিক্রম করেছে। ৭০ শতাংশ উদীয়মান অর্থনীতির দেশে খাদ্যমূল্যে যে স্ফীতি ঘটেছে তা সাধারণ মূল্যস্ফীতির সাথে যোগ হয়ে ৭০ শতাংশ ছাড়িয়েছে। অনেক দেশেই খাদ্যের উচ্চমূল্যের কারণে বেড়েছে মুদ্রাস্ফীতি। ফলে সেসব দেশে নিজেদের মুদ্রার অবমূল্যায়ন করতে হয়েছে, সারের মূল্যবৃদ্ধি ও শ্রমমূল্যও বেড়েছে। ফলে নিম্নআয়ের মানুষ, নিম্নমধ্য আয়ের দেশগুলোতে এর বিশাল প্রভাব পড়েছে। মানুষের মধ্যে দেখা দিয়েছে অসন্তোষ, কিছু দেশে ইতোমধ্যে আন্দোলন শুরু হয়ে গেছে। আমাদের কাছের দেশ শ্রীলঙ্কার অবস্থা দিয়ে ব্যাপারটি ব্যাখ্যা করা যায়। এসব দেশের মানুষের আয়ের বিশাল একটি অংশ চলে যাচ্ছে খাদ্যের বর্ধিত মূল্য পরিশোধে।

যুদ্ধ শুরু হবার আগে খাদ্যমূল্য বাড়ছিল। যুদ্ধ খাদ্যমূল্যকে আরো বাড়িয়েছে। সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়েছে গম, খাদ্যশস্য, ভোজ্যতেল ও সারের মূল্যের ওপর। কম শস্য সরবরাহ বৈশ্বিক পণ্য বাজারকে উচ্চ ঝুঁকিতে নিয়ে গেছে। এর ওপর আবার প্রভাব ফেলেছে উচ্চ জ্বালানি মূল্য। ইউক্রেনের বন্দরগুলোর ৮০ শতাংশ যুদ্ধের কারণে অবরুদ্ধ হয়ে আছে। ফলে এসব বন্দর দিয়ে পণ্য চালান দেয়া যাচ্ছে না। ২০২১ সালে ১৯ কোটি ৩০ লাখ মানুষের খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা দেখা দিয়েছে। ‘গ্লোবাল রিপোর্ট অন ফুড ক্রাইসিস’ পূর্বাভাস দিয়েছে, ২০২২ সাল শেষ হওয়ার আগে উপরোল্লিখিত সংখ্যার পরিবর্তন ঘটবে। আরো চার কোটির বেশি মানুষ খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় যুক্ত হবে ২০২০ সালের তুলনায়। খাদ্যের দুর্মূল্যে ইতোমধ্যে ৮৩ দেশে অত্যাবশ্যক ছাড়া অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কেনা বন্ধ করে দিয়েছে মানুষ। এটি ঘটেছে ২০২০ থেকে করোনা মহামারী শুরু হওয়ার পর থেকে।

ইউক্রেনের গম রফতানিতে রাশিয়া ও পশ্চিমাদের মধ্যে ‘ব্লেমগেম’ শুরু হয়েছে। রাশিয়া বলছে, ইউক্রেনের খাদ্যশস্য রফতানিতে বাধা দেয়নি মস্কো। কৃষ্ণসাগর দিয়ে ইউক্রেন খাদ্যশস্য রফতানি করতে পারবে। কিন্তু পশ্চিমা দেশগুলো বলছে, ইউক্রেনের খাদ্যশস্য রফতানিতে রাশিয়া বাধা দিচ্ছে। পুতিন বলছেন, ওডেসা বন্দর ইউক্রেনের নিয়ন্ত্রণে। এটি ছাড়াও ইউক্রেন দানিয়ুব নদী দিয়ে রোমানিয়া, হাঙ্গেরি, পোল্যান্ডে রফতানি করতে পারে। তিনি আরো দাবি করেন, ইউক্রেন যে পানিতে মাইন পুঁতে রেখেছে তা পরিষ্কার করে ওডেসা বন্দর ব্যবহার করে রফতানি করতে পারে। প্রেসিডেন্ট পুতিন বলেন, বেলারুশের বাল্টিক বন্দর ব্যবহার করে পৃথিবীর যেকোনো দেশে ইউক্রেন রফতানি করতে পারে এবং তা হবে ইউক্রেনের জন্য সবচেয়ে সহজ ও সস্তা। কিন্তু বেলারুশের বন্দর ব্যবহার হতে হবে মিনস্কের ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের শর্তে। এদিকে ইউক্রেনের সরকারি কর্মকর্তারা অভিযোগ করছেন, রাশিয়া ইউক্রেনের রফতানি বন্ধ করে বসে থাকেনি, ইউক্রেনের পাঁচ লাখ টন খাদ্যশস্য চুরি করেছে। খাদ্য ঘাটতির কথা বলে পশ্চিমা কয়েকটি দেশ রাশিয়াকে সামরিক আক্রমণ বন্ধের আহ্বান জানিয়েছে।

অপর দিকে, জাতিসঙ্ঘ মহাসচিবের মুখপাত্র স্টেফেন দুজারিক বলেছেন, ‘ইউক্রেনের খাদ্য রফতানি এবং রাশিয়ার খাদ্য ও সার রফতানির জন্য তিনি একটি ‘প্যাকেজ ডিলে’ পৌঁছানোর চেষ্টা করছেন’। ইতোমধ্যে একটি চুক্তিও হয়েছে দু’দেশের মধ্যে। তিনি আরো বলেন, ‘পরিস্থিতি খুব খারাপ। জাতিসঙ্ঘের মহাসচিব, জাতিসঙ্ঘের অন্যান্য কর্মকর্তা প্রকল্পটি চূড়ান্ত করতে যেখানে যাওয়া প্রয়োজন তারা সেখানে যাবেন।’

জাতিসঙ্ঘে মার্র্কিন রাষ্ট্রদূত বলেন, বাইডেন প্রশাসন রাশিয়ান খাদ্যশস্য ও সার রফতানি সমর্থন করে। তিনি বলেন, ‘রাশিয়ান খাদ্যশস্য ও সার রফতানিতে কোনো নিষেধাজ্ঞা ছিল না’। ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ বলেন, ‘কৃষ্ণসাগর দিয়ে ইউক্রেনের খাদ্যশস্যের নিরাপদ রফতানি রাশিয়া চায়, ভবিষ্যতেও এটি অব্যাহত থাকবে।’ আল-জাজিরা রাশিয়ার সংবাদমাধ্যম তাসের বরাতে বলা হয়, ‘ইউক্রেনের খাদ্যশস্য বৈশ্বিক বাজারে পৌঁছার নিশ্চয়তা দেয়ার ইচ্ছা রাশিয়ার রয়েছে’। এদিকে তুরস্ক বলে, ‘চলতি সপ্তাহে তুরস্ক, রাশিয়া, ইউক্রেন এবং জাতিসঙ্ঘ খাদ্যশস্য রফতানির বিষয়ে আলোচনায় বসবে।’ এ পরিপ্রেক্ষিতে জাতিসঙ্ঘ বলে, ‘বৈশ্বিক বাজারে খাদ্যের ঘাটতি সমাধানে সংস্থাটি চেষ্টা করবে’।

বিশ্বের ৩০ শতাংশ গম বাণিজ্যের প্রধান উৎপাদক রাশিয়া ও ইউক্রেন হলেও ইউক্রেনের বন্দরে কয়েক ডজন কনটেইনার জাহাজ আটকা পড়ে আছে এবং এগুলো ঘিরে রেখেছে রাশিয়ান সেনারা। এসব জাহাজের চারপাশে মাইন পুঁতে রাখা হয়েছে। গম ছাড়া সূর্যমুখী বীজের তেল, সার ও মালামাল ভর্তি জাহাজ আটকে রয়েছে রাশিয়ান সেনাদের বেষ্টনীতে। প্রেসিডেন্ট পুতিন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগানের সাথে অঙ্গীকার করেন, ইউক্রেনের বন্দর থেকে ইউক্রেনের জাহাজ বাধাহীনভাবে চলাচল করুক, ক্রেমলিন তা চায়। কিন্তু এটি হতে হবে মস্কোর ওপর পশ্চিমাদের আরোপিত নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়ার বিনিময়ে। এরদোগানকে পুতিন জানান, ‘রাশিয়া বিশাল পরিমাণে কৃষিজাত পণ্য ও সার রফতানি করতে প্রস্তুত যদি রাশিয়ার প্রতি পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হয়।’ শুধু যে ইউক্রেনের গম রফতানির সুযোগ পেলেও বিশ্বের খাদ্যশস্যের ঘাটতি কমে যাবে তা নয়। একই সাথে আন্তর্জাতিক কৃষিজ, খাদ্য-বাণিজ্যের উদারীকরণও করতে হবে। সংশ্লিষ্ট দেশগুলো যে সুরক্ষামূলক বাণিজ্যনীতি গ্রহণ করেছে নিজের জন্য, তা-ও খাদ্য ঘাটতির একটি বাধা। এ বাধাও অপসারণ করতে হবে।

লেখক : সাংবাদিক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *