সরকারি এক ভবনেই ২৪শ টন এসি

Slider জাতীয়

রাজধানীতে অবস্থিত একটি সরকারি ভবনেই দুই হাজার ৪০০ টন শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত যন্ত্র (এসি) ব্যবহার করা হয়। তথ্য দেখে চোখ কপালে উঠলেও এটিই সঠিক। টনের হিসাবে দেশের সবচেয়ে বেশি এসি ব্যবহার করা হয় এই অফিসে। রাজধানীর পান্থপথে অবস্থিত পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীন পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) সদরদপ্তর পানি ভবনের চিত্র এটি। যদিও সরকারের প্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দু বাংলাদেশ সচিবালয়ের ৩৬টি মন্ত্রণালয়ের জন্য সব মিলিয়ে চার হাজার টন এসি ব্যবহার করা হয়। এ ছাড়া বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক) সদরদপ্তরেও ৮০০ টনের ওপরে এসি ব্যবহার করা হয়। তবে পানি ভবনের এমন এসির ব্যবহারকে বিলাসী হিসেবে দেখছেন সরকারের অন্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারাও। তারা বলছেন, সরকারের কোনো সংস্থার বিদ্যুতের এমন যথেচ্ছ ব্যবহার মেনে নেওয়া যায় না। পানি উন্নয়ন বোর্ড থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে, রাজধানীর পান্থপথে অবস্থিত ‘আধুনিক পানি ভবন’ ২০২০ সালের ১ অক্টোবর উদ্বোধন করা হয়। ২৬০ কোটি ৮২ লাখ টাকা ব্যয়ের এ ভবনটির নির্মাণকাজ শুরু হয় ২০১৫ সালের ৩১ জানুয়ারি। পানি ভবন ১২ তলাবিশিষ্ট, দৈর্ঘ্য ২৭৬ ফুট এবং প্রস্থ ১২৭ ফুট, ফ্লোরের মোট এরিয়া ৩৫ হাজার বর্গফুট বেজমেন্ট এবং সেমি-বেজমেন্টের উচ্চতা ১০ দশমিক ৮২ ফুট, ফ্লোর উচ্চতা (নিচতলা) ১৩ দশমিক ৭৫ ফুট, ফ্লোর উচ্চতা (অন্যান্য তলা) ১২ দশমিক ২৫ ফুট, ভবনের মোট উচ্চতা ১৭৪ ফুট। অডিটরিয়াম দৈর্ঘ্য ১০০ ফুট এবং প্রস্থ ৫১ ফুট, মোট এরিয়া পাঁচ হাজার ১০০ বর্গফুট (প্রায়)। অডিটরিয়াম উচ্চতা ২১ ফুট, অডিটরিয়াম ধারণক্ষমতা ৫৩৬ জন।

সার্ভিস ভবন তিন তলাবিশিষ্ট, দৈর্ঘ্য ১০০ ফুট এবং প্রস্থ ৬০ ফুট, প্রতি ফ্লোরের মোট এরিয়া ছয় হাজার বর্গফুট (প্রায়)। ভবনের বেজমেন্ট এবং সেমি-বেজমেন্টে পার্কিং সংখ্যা ১৭৬টি, ভবনের বাইরে খোলা জায়গায় পার্কিং সংখ্যা ২০০টি, কমন টয়লেটের সংখ্যা ৪৮টি, রুমের সঙ্গে অ্যাটাচড টয়লেট সংখ্যা ৭০টি, ভবনের লিফট সংখ্যা আটটি। ভবনের ১১ তলায় রয়েছে কেন্দ্রীয় শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে আলাপকালে জানা যায়, প্রায় চার লাখ ২০ হাজার বর্গফুট আয়তনের এই ভবনের জন্য প্রতি মাসে বিদ্যুৎ বিল গুনতে হচ্ছে ২৫ থেকে ২৭ লাখ টাকা। সেই হিসাবে বছরে এর পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ৩ কোটি টাকা। বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রও জানিয়েছে প্রতিমাসে ২৭ থেকে ২৮ লাখ টাকা বিল দিচ্ছে পানি ভবন। তবে কর্মকর্তারা বলছেন, একটি ভবনের এত পরিমাণ এসির দরকার নেই। এ ছাড়া পাউবোর অফিসিয়াল কাজ কম। বেশিরভাগ কাজই মাঠপর্যায়ে। দেশের প্রায় সব জেলা ও বিভাগীয় শহরে আলাদা আলাদা অফিস রয়েছে। ঢাকায়ও সচিবালয়ে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অফিস রয়েছে। সেখানেই মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রী ও সচিব অফিস করেন। এ ছাড়া তাদের পিএস, এপিএসও সচিবালয়ে অফিস করেন। কিন্তু পানি ভবনেও প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রীর জন্য অফিস রয়েছে। রুম রয়েছে তাদের পিএস, এপিএসের জন্যও। যদিও পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রী ও সচিবের মাঠের কাজ বেশি। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে তারা নিয়মিত সফর করেন।

কর্মকর্তারা জানান, পানি ভবনের অনেক রুম এবং জায়গাই অব্যবহৃত। কিন্তু কেন্দ্রীয়ভাবে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা থাকায় এসি চালু করলেই পুরো ভবনে ব্যবহৃত হয়। বিপুল পরিমাণ বিদ্যুৎ খরচ হয়। যদিও তা কোনো কাজে আসছে না।

কর্মকর্তারা বলছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বরাবরই বিদ্যুৎ ব্যবহারে সাশ্রয়ী হওয়ার তাগিদ দিচ্ছেন। তিনি বলেছিলেন, সরকারি অফিস-আদালত নির্মাণের ক্ষেত্রে আবদ্ধ ভবন নির্মাণ না করে প্রাকৃতিক আলো-বাতাস প্রবেশ করে এমন পরিকল্পনা করতে। কিন্তু উল্টোচিত্র পানি ভবনের। তারা বলেন, রাজধানীতে পানি ভবনের সমমানের আরও অনেক অফিস রয়েছে। সেসব অফিসে এত বেশি এসির ব্যবহার নেই। এমনকি বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলনকেন্দ্র, ওসমানি স্মৃতি মিলনায়তনে অনেক বড় জায়গা; কিন্তু সেখানেও এত পরিমাণ এসির দরকার হয়নি।

তারা বলেন, দেশের পাঁচতারকা হোটেলগুলোতেও এত পরিমাণ এসির ব্যবহার করা হয়নি। হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল, সোনারগাঁওসহ অন্য যেসব বড় স্থাপনা রয়েছে, সেগুলো সেন্ট্রাল এসি হলেও তার পরিমাণ এত বড় না। পানি ভবনের তুলনায় অনেক কম। যদিও বিপুলসংখ্যক মানুষ ওইসব ভবন ব্যবহার করে।

বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) সদরদপ্তরেও প্রয়োজনের চেয়ে বেশি শীততপ নিয়ন্ত্রিত যন্ত্রের ব্যবহার হয় বলে জানিয়েছেন সংস্থাটির কর্মকর্তারা। তারা বলছেন, ভবনে প্রায় ৮১০ টন এসির ব্যবহার হয়। সংস্থাটির প্রকৌশল বিভাগের একজন কর্মকর্তা জানান, ২৭০ টনের তিনটি এসি রয়েছে বেবিচক ভবনে। যদিও এত এসির প্রয়োজন নেই। পুরো ভবনটি সেন্ট্রাল এসির আওতাধীন।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের শিক্ষক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ তৌহিদুল হক আমাদের সময়কে বলেন, পানি ভবনে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত যন্ত্রের এমন মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার নিঃসন্দেহে খারাপ উদাহরণ। কেবল পানি ভবনই নয়, অনেক সরকারি ভবনে এমন যথেচ্ছ শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত যন্ত্র ব্যবহার হয়। এখন যেহেতু নানা কারণেই বিদ্যুতের ঘাটতি দেখা দিয়েছে। সরকারি কর্মকর্তাদের উচিত এসির ব্যবহার কমিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করা।

তিনি বলেন, বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের জন্য সরকার নানা নির্দেশনা দিয়েছে। এসব নির্দেশনা যেন কেবল কাগুজে না হয়। সরকারি কর্মকর্তাদের উচিত হবে- নিজেরা সর্বপ্রথম বাস্তবায়ন করে সাধারণ মানুষের কাছে দৃষ্টান্ত হওয়া। আমরা চাই না দেশ সমস্যাগ্রস্থ থাকুক। বিদ্যুতের সমস্যাও থাকবে না। আগামী দুই-তিন মাসের মধ্যে হয়তো এ সমস্যা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে। তবে এ সময়টাতে সবাইকে দায়িত্বশীল আচরণ করতে হবে। প্রয়োজনে সরকারের টিম গঠন করতে হবে, যারা নির্দেশনা মানার বিষয়টি তদারকির জন্য বিভিন্ন স্থানে ঝটিকা অভিযান পরিচালনা করবেন। জরিমানাসহ নানা শাস্তিমূলক ব্যবস্থাও রাখতে হবে।

এ বিষয়ে জানতে পাউবোর মহাপরিচালক ফজলুর রশীদের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। পরে নিউজের বিষয়বস্তু লিখে খুদেবার্তা পাঠালেও তিনি ফোন করেননি। পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী এনামুল হক শামীমের বক্তব্যে পাওয়ার জন্যও চেষ্টা করা হয়। তবে তিনি দেশের বাইরে থাকায় তার বক্তব্য পাওয়া সম্ভব হয়নি। পানি ভবনে বিপুল পরিমাণ বিদ্যুৎ খরচের বিষয়ে জানতে পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুককে একাধিকবার ফোন করলেও তিনিও রিসিভ করেননি। পরে নিউজের বিষয়বস্তু লিখে খুদেবার্তা পাঠালেও তিনি ফোন করেননি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *