নড়াইলে শিক্ষক লাঞ্ছনা আর সাভারে ছাত্রের মারধরে শিক্ষকের মৃত্যুর ঘটনায় দেশজুড়ে উদ্বেগ-প্রতিবাদের ঝড় বইছে। এর মধ্যেই গতকাল বুধবার শ্রেণিকক্ষে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগের একজন অধ্যাপককে হেনস্তার ঘটনা ঘটেছে। কেন শিক্ষাঙ্গনে একের পর এক এ ধরনের ঘটনা ঘটছে- প্রশ্নটি জোরালোভাবে আলোচিত হচ্ছে দেশজুড়ে। শিক্ষক লাঞ্ছনার মতো ঘটনার লাগাম টানতে তাগিদও দেওয়া হচ্ছে বিভিন্ন মহল থেকে।
বিশিষ্টজনেরা এসব ঘটনায় সামাজিক অবক্ষয় এবং নৈতিক মূল্যবোধের অভাবকে দায়ী করছেন। তারা বলছেন, নৈতিক অবক্ষয়ের কারণে পুরো সমাজেই অস্থিরতা বাড়ছে, যার প্রভাব পড়ছে শিক্ষাঙ্গনে। বিচারে দীর্ঘসূত্রতা এবং বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটছে বলে মনে করেন তারা। বারবার শিক্ষকদের ওপর হামলার ঘটনার নেপথ্যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরীণ স্বার্থের দ্বন্দ্ব এবং স্থানীয় রাজনীতির নেতিবাচক প্রভাবকেও দায়ী করা হচ্ছে।
ফেসবুকে ভারতের ক্ষমতাসীন দল বিজেপির বহিষ্কৃত মুখপাত্র নূপুর শর্মার সমর্থনে কলেজের এক হিন্দু শিক্ষার্থীর পোস্ট দেওয়াকে কেন্দ্র করে গত ১৮ জুন দিনভর বিক্ষোভ, সহিংসতা চলে নড়াইলের মির্জাপুর ইউনাইটেড ডিগ্রি কলেজ ক্যাম্পাসে। গুজব ছড়িয়ে দেওয়া হয়, ওই শিক্ষার্থীর পক্ষ নিয়েছেন কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ। এরপর পুলিশ পাহারায় বিকাল ৪টার দিকে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসকে ক্যাম্পাসের বাইরে নিয়ে যাওয়ার সময় তাকে দাঁড় করিয়ে গলায় জুতার মালা পরিয়ে দেয় একদল ব্যক্তি। ওই শিক্ষক তখন হাত উঁচিয়ে ক্ষমা চাইতে থাকেন। পরে তাকে তুলে নেওয়া হয় পুলিশের গাড়িতে।
অন্যদিকে গত শনিবার দুপুরে ঢাকার আশুলিয়ার চিত্রশাইল এলাকার হাজি ইউনুস আলী স্কুল অ্যান্ড কলেজের মাঠে ক্রিকেট টুর্নামেন্ট চলাকালে প্রভাষক উৎপলকে স্টাম্প দিয়ে পিটিয়ে আহত করার অভিযোগ ওঠে ওই স্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্র জিতুর বিরুদ্ধে। মারধরে গুরুতর আহত শিক্ষকের মৃত্যু হয় পরদিন।
এসব ঘটনায় উদ্বেগ জানিয়ে সাম্প্রদায়িক শক্তি দমনে পদক্ষেপ নিতে সরকারকে আহ্বান জানিয়েছেন দেশের ১৭ বিশিষ্ট নাগরিক। এক বিবৃতিতে তারা বলেন, ‘স্মরণকালে শিক্ষকের গলায় জুতার মালা পরানোর মতো ঘটনা আমরা প্রত্যক্ষ করিনি। শিক্ষা ও সামাজিক মূল্যবোধ কোন স্তরে নেমে গেছে তা ভেবে আমরা আতঙ্কিত। সাম্প্রদায়িকতা কীভাবে আমাদের সমাজকে ধর্মের ভিত্তিতে বিভাজিত করেছে তা দেখে আমরা দিশেহারা’।
এর আগে মুন্সীগঞ্জে এমন রটনা তৈরি করে আরেক সংখ্যালঘু শিক্ষককে অপদস্ত করা হয়, পাঠানো হয় কারাগারে। ক্লাসে ধর্ম নিয়ে আপত্তিকর কথা বলার অভিযোগ তুলে গত ২০ মার্চ মুন্সীগঞ্জ সদর উপজেলার পঞ্চসার ইউনিয়নের বিনোদপুর রামকুমার উচ্চবিদ্যালয়ে শিক্ষক হৃদয় চন্দ্র ম-লের বিরুদ্ধে উত্তেজনা তৈরি করা হয়। পরে মামলা হয় এবং ওই শিক্ষককে গ্রেপ্তার দেখিয়ে পাঠানো হয় কারাগারে। কারগারে ১৯ দিন থাকার পর দেশজুড়ে প্রতিবাদ আর বিক্ষোভের মুখে তার জামিন হয়।
এ ধরনের ঘটনার কেন ঘটছে?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সাদেকা হালিম আমাদের সময়কে বলেন, সামাজিক শিক্ষায় নৈতিক মূল্যবোধের বড় অভাব দেখতে পাচ্ছি। আমি খুবই হতাশ, দেশে শিক্ষকরা লাঞ্ছিত হচ্ছে- কোনো ঘটনার সুষ্ঠু বিচার দেখতে পাচ্ছি না। যে কারণে এর পুনরাবৃত্তি ঘটছে। ঘটনাগুলোর মধ্যে ধর্মানুভূতিতে আঘাতের অভিযোগ আসে। কে করেছে, কেমন করে হচ্ছে- খবরই তো নেওয়া হচ্ছে না। আমরা দেখছি, নিরপরাধ মানুষকে ফাঁসিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এর পেছনে কারা আছে? সেই ধৃষ্টতা তারা কীভাবে পায়? সরকারকে একেবারে রুট লেভেলে গিয়ে দেখতে হবে, শক্ত হাতে এগুলো দমন করা উচিত।
হঠাৎ করে কিছু হচ্ছে না বলে মন্তব্য করে তিনি বলেন, নৈতিক শিক্ষা পরিবার থেকে, মসজিদ বা উপাসনালয় থেকে দেওয়া হতো। আমাদের নানা সীমাবদ্ধতা রয়েছে। মানুষের মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তন হয়েছে। বিভিন্ন কারনে বিভিন্ন অজুহাতে বারবার সনাতন ধর্মাবলম্বী শিক্ষকদের ওপর হামলা হচ্ছে। আমরা এ ধরনের রাজনীতি, ধর্মান্ধতা দেখতে চাই না।
শিক্ষকদের লাঞ্ছনা এমনকি হত্যার মতো ঘটনাগুলোয় শুধু নৈতিক মূল্যবোধের অভাবই দেখছেন না ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানের অধ্যাপক মাহফুজা খানম। তিনি বলেন, নৈতিক মূল্যবোধের যে ঘাটতি দেখছি, এর জন্য একক কোনো কারণ আছে বলে আমার মনে হয় না। অনেক সূচকের সমন্বিত একটি বহিঃপ্রকাশ হচ্ছে মূল্যবোধের অবক্ষয়। যেমন আগে ছাত্রশিক্ষকের যে মধুর সম্পর্ক ছিল এখন তা বিরল। একজন শিক্ষক শুধু ক্লাসে পড়াতেন না তিনি তার পরিবারের খোঁজখবরও রাখতেন। ছাত্রের ভালো মন্দ সবকিছু জানতেন ওই শিক্ষক। এখনকার শিক্ষকরা অনেকটা কমার্শিয়াল। ছাত্রদের পেছনে এত সময় কীভাবে দেবেন। স্কুলের ক্লাস শেষে তাকে আবার যেতে হচ্ছে কোচিংয়ে। স্কুল-কলেজের শিক্ষকরা ব্যক্তিগত নানা কাজে জড়িত থাকেন। ফলে ছাত্রশিক্ষকের সেই সম্পর্কের জায়গায় একটা ছেদ পড়েছে। এরপর আছে পরিবারের শিক্ষা। বাবা-মা সন্তানের জন্য রোল মডেল। তারা বাবা-মাকে অনুসরণ করে বড় হয়ে ওঠে। এখন বাবা-মা সবাই খুব ব্যস্ত। সন্তানকে সময় দেওয়ার মতো পরিস্থিতি নেই অনেক পরিবারের। সন্তানরা একটা শূন্যতায় বড় হয়ে ওঠে। তাদের মধ্যে এ শূন্যতায় ভিন্ন মনোজগৎ তৈরি হয়ে যায়। ফলে মূল্যবোধের জায়গাটা পরিবর্তন দেখা দেয়। এ ছাড়া আমাদের সমাজে শিক্ষক লাঞ্ছনার ঘটনা- এটিই নতুন নয়। যেটি দেখছি আমরা এর বিচারে দীর্ঘসূত্রতা আবার বিচার না হওয়ার সংস্কৃতিতে এমন অপরাধ বারবার পুনরাবৃত্তি ঘটছে বলে মনে হয়। শিক্ষার্থীদের মানবিক মূল্যবোধ তৈরির জন্য তাদের সুশিক্ষা, পরিবারের শিক্ষার প্রতি আমাদের মনোযোগী হতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ সামাদ আমাদের সময়কে বলেন, একজন শিক্ষককে লাঞ্ছনা- এটি সব শিক্ষককে লাঞ্ছনা করার শামিল। এ ঘটনার আমি তীব্র নিন্দা জানাই। একই সঙ্গে এর সুষ্ঠু তদন্তপূর্বক বিচার হওয়া উচিত। শিক্ষকদের নিরাপত্তার জন্য সরকারকে আন্তরিক হতে হবে।
২০১৬ সালে ধর্ম অবমাননার অভিযোগে নারায়ণগঞ্জের স্কুলশিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্তকে কান ধরে ওঠবস করানোর ঘটনাও পুরো দেশকে স্তম্ভিত করেছিল। এসব ঘটনা অহরহ ঘটতে থাকাকে খুবই দুঃখজনক বলছেন অবসরে যাওয়া শ্যামল কান্তি ভক্ত। এ জন্য তিনি দায় দিচ্ছেন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা কমিটির ক্ষমতার অপব্যবহার ও স্থানীয় রাজনীতিকে। তিনি বলেন, ম্যানেজিং কমিটিগুলোই নোংরা ভিলেজ পলিটিক্সে বেশি জড়িত। তাদের পকেটের প্রধান শিক্ষক না হলে, নীতি-নৈতিকতা নিয়ে চললে- তাদের ক্ষেত্রেই এসব বেশি ঘটে। এগুলো অনাকাক্সিক্ষত। শিক্ষক জাতির মেরুদ-, মানুষ গড়ার কারিগর। তাদের প্রতি এমন অমানবিক ঘটনা অত্যন্ত ন্যক্কারজনক।
এদিকে, নড়াইলে কলেজ অধ্যক্ষকে পুলিশের সামনে লাঞ্ছনার ঘটনায় কার কতটা গাফিলতি রয়েছে, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলে গতকাল জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। নড়াইলে পুলিশ ও প্রশাসনের সামনে ঘটনাটি কীভাবে ঘটল- সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নে মন্ত্রী বলেন, দেখুন, অকস্মাৎ অনেক ঘটনা ঘটে যায়। এ ঘটনায় আমরা সত্যিই দুঃখিত, একজন শিক্ষককে জুতার মালা পরিয়ে দিয়েছে উত্তেজিত জনতা। আমাদের ডিসি-এসপি তাৎক্ষণিকভাবে যে ব্যবস্থা নিয়েছিল, তখন অনেক লোকের উত্তেজনা হয়েছিল, আমরা যা শুনেছি। তারপরও আসল ঘটনাটি কী হয়েছিল, সেটি আরেকটু ভালো করে জেনে আপনাদের জানাব। আমাদের কাছে মনে হয়েছে, উত্তেজিত জনতা এত বেশি একত্র হয়ে গিয়েছিল, সেখানে ডিসি-এসপির করণীয়’র আগেই ঘটনাগুলো ঘটে গিয়েছিল।
শিক্ষক নেটওয়ার্কের বিবৃতি
শিক্ষকদের ওপর আক্রমণ বন্ধের দাবি জানিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক। ৮১ জন শিক্ষক গতকাল এক বিবৃতিতে বলেন, শিক্ষকদের যে সম্মান এ সমাজ দিত এক সময়, আজকাল তা তো অপসৃতই, সঙ্গে জুটছে সহিংসতা, এমনকি মৃত্যুও। আজ এমন এক সমাজ-রাষ্ট্র দেখা দিয়েছে, শিক্ষাব্যবস্থাকে যেনতেন রকমে দাঁড় করিয়ে রেখেছে। তা দিয়ে কেরানি-আমলা হবে, কিন্তু শিক্ষার যে মূল লক্ষ্য- জ্ঞানচর্চা ও মানবিক মূল্যবোধের লালন, সেসবের অস্তিত্ব যেন নেই সেখানে।
নড়াইলে শিক্ষক নির্যাতন ও সাভারে শিক্ষক হত্যার ঘটনায় জড়িতদের গ্রেপ্তার ও বিচার দাবি করেছে গণসংহতি আন্দোলন। গতকাল সংগঠনটির প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি ও নির্বাহী সমন্বয়কারী আবুল হাসান এক যৌথ বিবৃতিতে এ দাবি জানান।