সিলেট: বানের ঢলের তাণ্ডব কমেছে অনেকটাই। নামতে শুরু করেছে পানি, আর ভেসে উঠছে বন্যায় বিধ্বস্ত এক জনপদ। সিলেটজুড়েই এই চিত্র। নগরীতে ময়লা-আবর্জনা আর দুর্গন্ধ। গ্রামে গ্রামে হাহাকার। ভাঙা বাড়িঘর, ক্ষত-বিক্ষত সড়ক, মাঠের ধানের সঙ্গে বানের পানিতে পচেছে ঘরের ধান। গ্রামে বেশিরভাগ ঘরে নেই কোনো খাবার ব্যবস্থা। বাসনকোসন, কাপড়চোপড় ভেসে যাওয়ায় অনেকে দিন কাটাচ্ছেন এক কাপড়ে। সরকারি হিসাবেও ক্ষতির পরিমাণ বিপুল। এখনো বিস্তীর্ণ এলাকা নিমজ্জিত থাকায় ক্ষতির পরিমাণ আরও অনেক বাড়তে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
স্মরণকালের সবচেয়ে ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়া সিলেটে ঘরবাড়ি, ফসল, প্রাণিসম্পদ সবক্ষেত্রেই হয়েছে ব্যাপক ক্ষতি। ক্ষতির মুখে পড়েছেন প্রায় ২২ লাখ মানুষ।
বন্যায় সিলেট সিটি করপোরেশনের আংশিক এলাকা, জেলার ১৩ উপজেলা ও ৫ পৌরসভা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ৯৯ ইউনিয়নের মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। বাড়িঘর বিধ্বস্ত হয়েছে প্রায় ২৩ হাজার। ২৮ হাজার ৯৪৫ হেক্টর জমির ফসল পড়েছে ক্ষতির মুখে।
প্রায় ২ লাখ মানুষ আশ্রয়কেন্দ্র থেকে বাড়িতে ফিরেছেন। তবে তারা বাড়ি ফিরেছেন প্রায় নিঃস্ব হয়েই। আরও অন্তত ২ লাখ মানুষ আশ্রয়কেন্দ্র থেকে বাড়িঘরে ফেরার অপেক্ষায় আছেন।
সিলেটের জেলা প্রশাসক মো. মজিবর রহমান জানিয়েছেন, সব উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তাদের ইতোমধ্যে ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। শিগগির বন্যার্তদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হবে।
এদিকে বন্যার কবলে পড়া সিলেটে হাজার হাজার একর চারণভূমি প্লাবিত হয়েছে। পানিতে তলিয়ে বিনষ্ট হয়েছে ঘাস, খড়। ক্ষতি ও সংকটের মুখে পড়েছেন কৃষক ও খামারিরা। প্রাণিসম্পদ খাতে এই ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ১২ কোটি টাকা।
সংশ্লিষ্টরা জানান, এবারের বন্যায় সিলেট জেলায় প্রায় ৮০ শতাংশ এলাকাই তলিয়ে যায়। বন্যার পানিতে হাজার হাজার হাঁস-মুরগি এবং বেশ কয়েকটি গরু-ছাগল মারা পড়েছে। হাজার হাজার টন খড় হয় ভেসে গেছে, না হয় পচে বিনষ্ট হয়েছে।
সিলেট জেলা প্রাণিসম্পদ কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, বন্যায় সিলেটে প্রাণিসম্পদ খাতে ১১ কোটি ৮১ লাখ ৪৪ হাজার টাকার ক্ষতি হয়েছে। ৭ হাজার ৩৫৪ একর চারণভূমি প্লাবিত হয়েছে বন্যায়। এখনো সিংহভাগ চারণভূমি তলিয়ে আছে পানিতে।
বন্যায় ৭২১টি গবাদিপশুর খামার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সিলেট জেলায়। এক্ষেত্রে ক্ষতি হয়েছে ৬ কোটি ৩৬ লাখ ৬০ হাজার টাকা। এদিকে ৩৬৮টি হাঁস-মুরগির খামার ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে ক্ষতির পরিমাণ ২ কোটি ৭৩ লাখ ৭৫ হাজার টাকা।
জেলায় ২ হাজার ৯১ টন খড় বিনষ্ট হয়েছে বন্যার পানিতে; যেখানে ক্ষতির পরিমাণ ১ কোটি ৪ লাখ ৫৫ হাজার টাকা। ২ হাজার ৯৮২ টন ঘাস পচে বিনষ্ট হয়ে গেছে; এখানে ক্ষতির পরিমাণ প্রায় দেড় কোটি টাকা।
এদিকে বন্যার কারণে ১১টি গরু, ৬টি মহিষ, ২১টি ছাগল ও ১৬টি ভেড়া অসুস্থ হয়ে মারা গেছে। এ ছাড়া ৪ হাজার ৯৬৩টি মুরগি ও ১ হাজার ২৮৪টি হাঁস মারা গেছে এবারের বন্যার কবলে পড়ে। এ বাবদ ১৮ লাখ ৮৯ হাজার ৩৫০ টাকার ক্ষতি হয়েছে।
প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তারা বলছেন, বন্যায় অসুস্থ হয়ে পড়া ৯ হাজার ১৫৪টি গবাদিপশু এবং ১২ হাজারের বেশি হাঁস-মুরগিকে টিকা দেওয়া হয়েছে। অন্যান্য প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে ১০ সহস্রাধিক গবাদিপশু এবং ২৭ সহস্রাধিক হাঁস-মুরগিকে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিস্তীর্ণ গোচারণভূমি এখনো পানিতে নিমজ্জিত থাকায় গবাদিপশুর মালিকরা সমস্যার মধ্যে পড়েছেন। পর্যাপ্ত গোখাদ্য পাওয়া যাচ্ছে না। কচুরিপানা খাইয়ে গবাদিপশুকে বাঁচিয়ে রাখা হচ্ছে।
এদিকে সুরমা নদীর পানি কমায় সিলেটে বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। তবে এখনো কুশিয়ারা নদীর পানি বিপদসীমার ওপরে। বিভাগের বেশিরভাগ সড়ক এখনো পানির নিচে। পানি নামলেও ভেসে ওঠছে ক্ষত-বিক্ষত সড়ক। গতকাল রবিবার সিলেটের প্রধান সড়কগুলো পরিদর্শন করে সড়ক ও জনপথ বিভাগের প্রধান প্রকৌশলী একেএম মনির হোসেন পাঠান জানান, চলতি বন্যায় সিলেট বিভাগে সওজের অধীন অর্ধেক সড়কই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পরিমাণে সেটি প্রায় ৮০০ কিলোমিটার। এসব সড়ক আপাতত যান চলাচল উপযোগী করার চেষ্টা করা হচ্ছে। তবে সড়ক সংস্কারে লাগবে দীর্ঘ সময় ও বড় বরাদ্দ। তিনি বলেন, এখন ত্রাণ নিয়ে যানবাহন যাচ্ছে। সেগুলোর যাতায়াত নিশ্চিত করা বেশি জরুরি।
হবিগঞ্জ : জেলার বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। নিম্নাঞ্চলের পানি ধীরগতিতে কমছে। বন্যাজনিত কারণে এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে। গত দুই সপ্তাহ ধরে অব্যাহত বন্যায় জেলার সাত উপজেলার ৫৪ ইউনিয়ন বন্যাকবলিত হয়ে পড়েছে। সরকারি হিসাবে ২৪ হাজার ২৩০টি পরিবার পানিবন্দি রয়েছে। ৮৩ হাজার ৪৯০ জন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। ঘরবাড়ি ছেড়ে ২১ হাজার ৭৩ জন আশ্রয়কেন্দ্রে উঠেছেন। এ পর্যন্ত ৪১৫ টন চাল, ১৫ লাখ টাকা নগদ ও ৪ হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। জেলায় ৩৫০টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। গতকাল বিকালে আজমিরিগঞ্জ উপজেলায় কালনি ও কুশিয়ারা নদীর পানি বিপদসীমার ১১৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। এদিকে গত শনিবার দুপুরে বানিয়াচং উপজেলার মকরমপুর ইউনিয়নের পুরান পাতারিয়া গ্রামের জনৈক লুৎফুর রহমান ও বশিরা খাতুনের আড়াই বছরের ছেলে আফিল মিয়া তাদের বসতবাড়ির উত্তর দিকে বন্যার পানিতে ডুবে মারা যায়।