বছরে জনপ্রতি বরাদ্দ ৩৪ টাকার ওষুধ!

Slider জাতীয়


জনবল সংকটসহ নানা সমস্যায় ধুঁকছে লক্ষ্মীপুরের ৫০ শয্যা রায়পুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। সম্প্রতি শূন্যপদে জনবল নিয়োগ দিতে চিঠি দিয়েছেন উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মো. বাহারুল আলম। জেলা সিভিল সার্জনকে দেওয়া ওই চিঠিতে তিনি দাপ্তরিক কাজসহ চিকিৎসাসেবা বিঘ্নিত হওয়ার কথা জানিয়েছেন।

শুধু তাই নয়, অনুমতি না নিয়েই সাত বছর ধরে অনুপস্থিত হাসপাতালটির দুই চিকিৎসক। তাদের কারণ দর্শানো নোটিশ দেওয়া হলেও জবাব মিলছে না।

হাসপাতাল সূত্র জানায়, ২০০৬ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর ৩১ থেকে ৫০ শয্যায় উন্নীত করা হয় রায়পুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। বর্তমানে অনুমোদিত ২০৩টি পদের বিপরীতে ১২০টি পদে লোকবল রয়েছে। শূন্য রয়েছে ৮৩টি পদ। এরমধ্যে প্রথম শ্রেণির ১০টি পদ রয়েছে। তারা সবাই জুনিয়র কনসালটেন্ট। শূণ্য পদগুলো হলো অ্যানেসথেসিয়া, গাইনি, সার্জারি, ডেন্টাল সার্জন, কার্ডিও, চক্ষু, চর্ম ও যৌন এবং ইএনটি।

সবশেষ ২০১১ সালের আদমশুমারির তথ্য বলছে, রায়পুর পৌরসভা ও ১০টি ইউনিয়নে জনসংখ্যা দুই লাখ ৭৫ হাজার ১৬০ জন। তবে বেসরকারি হিসাবে বর্তমানে এ সংখ্যা তিন লাখ। চলতি অর্থবছরে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ওষুধ কেনার জন্য এক কোটি ২ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয় (জনপ্রতি ৩৪ টাকা)।

ডা. মো. বাহারুল আলম বরাদ্দের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, বহিঃবিভাগে প্রতিদিন ৪০০ থেকে ৫০০ রোগী চিকিৎসা নেন। তাদের বিনামূল্যে কিছু ওষধ সরবরাহ করা হয়।

৭ বছর অনুপস্থিত দুই চিকিৎসক

কাগজপত্র ঘেঁটে দেখা গেছে, জুনিয়র কনসালটেন্ট (অর্থোপেটিক) ডা. আবুল কাশেম মো. মহিউদ্দিন ২০১৫ সালের ৫ মে রায়পুর হাসপাতালে যোগদান করেন। এরপর ১৩ জুলাই অনুমতি না নিয়ে বাড়িতে গিয়ে আর আসেননি।

একই অবস্থা ডা. কাজী সামসুদ্দোহার। তিনি রায়পুরের সাইচা উপ-স্বাস্থ্যকেন্দ্রের চিকিৎসা কর্মকর্তা হিসেবে ২০১৪ সালের ২০ নভেম্বর যোগদান করেন। পরের বছরের ১ সেপ্টেম্বর তিনি ছুটি না নিয়ে গিয়ে বাড়ি গিয়ে আর আসেননি। গত সাত বছরে তারা কর্মস্থলে ফেরেননি। তারা কোথায় আছেন, কী করছেন তাও নিশ্চিতভাবে জানে না জেলা স্বাস্থ্য বিভাগ। একাধিকবার কারণ দর্শানো নোটিশ দেওয়া হলেও তারা জবাব দেননি। তাদের রিুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে জানানো হয়েছে।

সবশেষ রোববার (৫ জুন) উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মো. বাহারুল আলম দুই কর্মকর্তার অনুপস্থিতির কথা জানিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে জেলা সিভিল সার্জনকে চিঠি দিয়েছেন।

এক্সরে হয় না ১৮ বছর

হাসপাতালে এখন দুটি এক্সরে মেশিন রয়েছে। কিন্তু টেকনেশিয়ান না থাকায় তা কোনো কাজেই আসছে না। ২০০৪ সালে টেকনেশিয়ান অন্যত্র বদলি হয়ে যান। এরপর প্রায় ১৮ বছর ধরে এক্সরে কক্ষে তালা ঝুলছে।

গতবছর সংযুক্ত হয় অত্যাধুনিক নতুন ডিজিটাল এক্সরে মেশিন। এটি কয়েকমাস বাক্সবন্দি ছিল। পরে এক্সরে কক্ষে স্থাপন করে উদ্বোধন করা হয়। তবে একদিনের জন্যও নতুন মেশিনটি কাজে আসেনি। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে এ বিষয়ে একাধিকবার চিঠি দিয়েও কোনো সুফল মেলেনি। এতে বাধ্য হয়েই রোগীদের বেসরকারি হাসপাতালে চড়ামূল্যে এক্সরে করতে হচ্ছে।

রোগীদের যত অভিযোগ

সোমবার ও মঙ্গলবার দুদিন হাসপাতালে গিয়ে ভর্তি হওয়া ১৪ রোগীর সঙ্গে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। তাদের ভাষ্যমতে, ওয়ার্ডগুলো নিয়মিত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা হয় না, খাবারের মান সন্তোষজনক না, দু একটি ছাড়া প্রয়োজনীয় অন্যসব ওষুধ চড়া দামে ফার্মেসি থেকে কিনে আনতে হয়। নিরাপত্তার অভাব রয়েছে বলেও জানিয়েছেন তারা।

চরবগা গ্রামের নাজমা আক্তার জাগো নিউজকে বলেন, ‘হাসপাতালের বাথরুম খুবই নোংরা। ব্যবহার করতে মন চায় না। বাধ্য হয়েই যেতে হয়। খরচাপাতি না দিলে নার্সরা দুর্ব্যবহার করেন। খাবারের মান ভালো না হওয়ায় বাড়ি বা হোটেল থেকে খাবার এনে খেতে হয়।’

হাসপাতালটিতে খাবার সরবরাহ করার দায়িত্বে রয়েছেন রায়পুর পৌরসভার কাউন্সিলর আনোয়ার হোসেন।

তিনি বলেন, ‘দৈনিক রোগীপ্রতি খাবারের জন্য বরাদ্দ ১২৫ টাকা। এরমধ্যে ভ্যাটও কর্তন হয়। এ টাকার মধ্যে খাবার দিতে হয়। এতে প্রতিদিনই লোকসান হচ্ছে। আগে রোগীরা খাবার পেতো না, মানবসেবা হিসেবেই আমি কাজটি করছি।’

শায়েস্তানগরের গ্রামের ইসমাইল হোসেন ও চরলক্ষ্মীর বাসিন্দা সাহাব উদ্দিন ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, সরকার জনগণের স্বাস্থ্যসেবায় কোটি কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়। অথচ হাসপাতালে ভর্তি হলে বাইরে থেকে ওষুধ আনতে হয়। সব পরীক্ষা-নিরীক্ষা এখানে হয় না। এতে তারা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রম্ত হচ্ছেন।

স্কুলশিক্ষক শামছুল আলম বলেন, হাসপাতালে যেসব চিকিৎসক আছেন সময়মতো তাদের পাওয়া যায় না। দালাল ও ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিদের উপদ্রব রয়েছে। এক্সরেসহ বিভিন্ন পরীক্ষা করার ব্যবস্থা নেই। এসব সমস্য সমাধানে দ্রুত কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়া দরকার।

জানতে চাইলে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) ডা. মো. কবির জাগো নিউজকে বলেন, দুজন চিকিৎসক অনুমতি না নিয়েই দীর্ঘদিন ধরে অনুপস্থিত। এরমধ্যে একজন যুক্তরাষ্ট্রে রয়েছেন বলে আমরা জানতে পেরেছি।

তিনি বলেন, এক্সরে মেশিনের টেকনিশিয়ান না থাকায় নতুন যন্ত্রটিও উদ্বোধন করে রুমে রাখা হয়েছে। এসব সংকটের বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে প্রায় প্রতিমাসেই চিঠি লেখা হয়।

রায়পুর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মো. বাহারুল আলম জাগো নিউজকে বলেন, জনবল সংকটের কারণে সেবা দিতে কিছুটা বেগ পেতে হচ্ছে।

তিনি বলেন, হাসপাতাল থেকে রোগীদের বিনামূল্যে ৮৭ ধরনের ওষুধ সরবরাহ করা হয়। খাবারের মান তদারকি জোরদার করতে আরএমওকে বলা হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *