আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম আবারও ঊর্ধ্বমুখী। এই ধারা অব্যাহত থাকলে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) লোকসান বাড়বে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। গত রবিবার আন্তর্জাতিক বাজরে প্রতি ব্যারেল ডিজেলের দাম ১৭২ ডলার পর্যন্ত উঠেছে। এই দামে এলসি খুলে ডিজেল আমদানি করলে বিরাট লোকসান হবে বিপিসির।
বিপিসিসংশ্লিষ্টরা বলছেন, যদি ১৭২ ডলার ব্যারেল ডিজেল আমদানি করে বিক্রি করতে হয় তা হলে গ্রাহক পর্যায়ে প্রতি লিটারে ডিজেলে বিপিসির প্রায় ৫৪ টাকা লোকসান করতে হবে। অর্থাৎ ১৭২ ডলার দাম ধরে তেল আমদানি করলে অন্যান্য খরচসহ বাংলাদেশে প্রতি লিটার তেলের
দাম পড়বে ১৩৪ টাকা, বিদ্যমান ৮০ টাকা লিটারে বিক্রি করলে লোকসান হবে প্রতি লিটারে ৫৪ টাকা। বিপিসির সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সেই হিসাবে শুধু ডিজেলেই প্রতিদিন ৮৯ কোটি টাকা লোকসান হতে পারে বিপিসির।
বিপিসির চেয়ারম্যান এবিএম আজাদের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে আমাদের সময়কে বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম ঊর্ধ্বমুখী। গত রবিবার প্রতি ব্যারেল ডিজেলের দাম ওঠে ১৭২ ডলার। তিনি বলেন, যদিও এই দামে তেল আমদানি এখনো শুরু হয়নি। তবে তেলের সরবরাহ অব্যাহত রাখতে হলে বা দেশের জ্বালানি তেলের জোগান ঠিক রাখতে এই দামে এলসি করতে হবে। তাতে সামনের দিনগুলোয় তেলের দাম আরও বেড়ে যাবে। চেয়ারম্যান বলেন, তেলের দাম এমন অব্যাহত থাকলে বিপিসি বিশাল পরিমাণ লোকসান গুনতে হবে। এত লোকসান দিয়ে তেলের সরবরাহ অব্যাহত রাখা বিরাট চ্যালেঞ্জ।
বিপিসি সূত্রে জানা যায়, চলতি বছরের শুরুর দিকেও ৩০ হাজার মেট্রিক টন ডিজেলের একটি অর্ডার আমদানি করতে বিপিসির যেখানে খরচ হতো ১৬ থেকে ১৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার; সেই একই পরিমাণ তেল আমদানি করতে এখন খরচ পড়ছে দ্বিগুণেরও বেশি দাম। বিপিসি সূত্রে জানা যায়, দেশের প্রতিদিন প্রায় ১৫ হাজার মেট্রিক টন জ্বালানি তেলের চাহিদা রয়েছে। এই চাহিদা পুরুন করতে প্রতি মাসে ৪/৫টি ডিজেলের চালান আমদানি করতে হয়।
এ বিষয়ে বিপিসির চেয়ারম্যান এবিএম আজাদ আরও বলেন, বর্তমানে ডিজেল এবং অকটেন এ দুটি জ্বালানি তেলে বিপিসির প্রায় ৬০/৬৫ কোটি টাকা প্রতিদিন ক্ষতি হচ্ছে। তিনি বলেন, এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি লোকসান হচ্ছে ডিজেলে। অকটেনে গড়ে ৭/৮ কোটি টাকা লোকসান হচ্ছে। এখন যেভাবে বিশ^বাজারে জ্বালানি তেলের দাম আরও বাড়ছে, তাতে হয়তো প্রতিদিন বিপিসির লোকসান ৯০ কোটিতে গিয়ে ঠেকবে।
এদিকে বিপিসির অন্য আরেকজন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বললে তিনি আমাদের সময়কে বলেন, জ্বালানি তেলের মূল্য সমন্বয় করবে কিনা সেটা সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের সিদ্ধান্তের বিষয়। তবে বিপিসির পক্ষ থেকে প্রতিনিয়ত আন্তর্জাতিক বাজারের জ্বালানি তেলের দাম এবং দেশের বাজারে চাহিদা সরবরাহ এবং ভর্তুকির পরিমাণ মন্ত্রণালয়কে জানিয়ে রাখা হচ্ছে।
বিপিসির কর্মকর্তারা আরও বলেন, শুধু ডিজেল নয়, বিশ্ববাজারে প্রায় সব ধরনের জ্বালানিপণ্যের দাম এখন বাড়ছে। এমন পরিস্থিতিতে বিপিসি ডিজেল আমদানির জন্য বিভিন্ন সরকারি ব্যাংকে এলসি খুললেও ব্যাংক কর্তৃপক্ষ ডলার পেমেন্ট করতে সমস্যার মুখোমুখি পড়ছে।
বিপিসি সূত্রে জানা যায়, করোনা মহামারীর কারণে গত বছর ডিজেলের ব্যবহার কম হয়েছে। গত বছরের তুলনায় চলতি বছর বিভিন্ন বিভিন্ন খাতে ডিজেলের ব্যবহার বেড়েছে। গত ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশে জ্বালানি তেলের চাহিদা ছিল প্রায় ৬৩ লাখ মেট্রিক টন। চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরে এই চাহিদা আরও সাড়ে ৪ লাখ বেড়ে দাঁড়াবে ৬৭ লাখ ৫০ হাজার মেট্রিক টন।
গত ২০২০-২১ অর্থবছর দেশে ব্যবহৃত ৬৩ লাখ মেট্রিক টন জ্বালানি তেলের মধ্যে ডিজেলের পরিমাণ ছিল প্রায় ৪৬ লাখ মেট্রিক টন। ফার্নেস অয়েলের চাহিদা ছিল ৫ লাখ ৫৯ হাজার মেট্রিক টন, অকটেনের ব্যবহার ছিল ৩ লাখ মেট্রিক টন, পেট্রোলের চাহিদা ছিল ৩ লাখ ৭৮ হাজার মেট্রিক টন এবং কেরোসিন বিক্রি হয়েছে ১ লাখ মেট্রিক টনের বেশি। দেশে ব্যবহৃত জ্বালানি তেলের মধ্যে ৭৩ শতাংশ ডিজেল। ডিজেলের ব্যবহার বেশি হওয়ায় এখন লোকসানের পরিমাণও বাড়ছে। এ ছাড়া গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো গ্যাস সংকটে ঠিকমতো চলতে না পারার কারণে ডিজেল বা ফার্নেস তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো বেশি চালাতে হচ্ছে। ফলে ডিজেল বা ফার্নেস তেলের চাহিদা বাড়ছে। একই সঙ্গে দেশের বিভিন্ন শিল্পকারখানায় গ্যাস সংকটের কারণে জ্বালানি তেলের ব্যবহার বেড়েছে।
আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ব্রেন্ড ক্রুড অয়েল ২০১২ সালের জুনে ছিল প্রতি ব্যারেল ৯৫ দশমিক ৫৯ ডলার। সেই তেল পর্যায়ক্রমে বাড়তে থাকে। ২০১৩ সালের জুনে সেই তেল হয় ১০৩ দশমিক ১১ ডলার, ২০১৪ সালের জুনে হয় ১১১ দশমিক ৮৭ ডলার, তবে ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বর থেকে চলতি বছরের পর্যন্ত সেই তেল ১০০ ডলারের নিচে ছিল। তবে গত মার্চ মাসে সেই তেলের দাম ওঠে প্রতি ব্যারেল ১৩৮ দশমিক ৫৬ ডলার, এপ্রিলে ওঠে ১৪৩ দশমিক ৮২ ডলার পর্যন্ত।