জাতীয় শিক্ষাক্রমে আসছে আমূল পরিবর্তন। আর এটার বাস্তবায়নও শুরু হবে আগামী শিক্ষাবর্ষ থেকেই। জাতীয় শিক্ষাক্রম সমন্বয় কমিটির (এনসিসিসি) যৌথ সভায় নতুন এই কারিকুলাম বাস্তবায়নের আনুষ্ঠানিক অনুমোদন দেয়া হয়েছে। শিক্ষামন্ত্রী ডা: দীপু মনি সভায় উপস্থিত ছিলেন। গত সোমবার রাজধানীতে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে এই সভা অনুষ্ঠিত হয়।
সভা সূত্রে জানা গেছে, নতুন শিক্ষাক্রমে সবকিছুকে নতুনভাবে সাজানো হয়েছে। বিশেষ করে পরীক্ষা ধরন, পরীক্ষা অনুষ্ঠানের কার্যকাল, মূল্যায়ন পদ্ধতি সব কিছুতেই আনা হয়েছে নতুনত্ব। পরীক্ষার চাপ কমিয়ে শিখন পদ্ধতিতেই বেশি জোর দেয়া হয়েছে।
সূত্র আরো জানায়, নতুন শিক্ষাক্রমে প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত কোনো পরীক্ষাই থাকছে না। এসব শিক্ষার্থীকে বিদ্যালয়েই মূল্যায়ন করা হবে। নতুন এই শিক্ষাক্রমে উঠে যাচ্ছে প্রাথমিক সমাপনী ও জেএসসি-জেডিসি পরীক্ষাও। শুধু দশম শ্রেণী শেষে একটি পাবলিক পরীক্ষা দিতে হবে শিক্ষার্থীদের। আর একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণী শেষে প্রচলিত এইচএসসি পরীক্ষার বদলে শিক্ষার্থীদের একাদশ শ্রেণী শেষে একটি ও দ্বাদশ শ্রেণী শেষে আরো একটি, এই মোট দুই পাবলিক পরীক্ষায় অংশ নিতে হবে।
নতুন শিক্ষাক্রমের রূপরেখা অনুসারে আগামী বছর অর্থাৎ ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দ থেকে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের কাজ শুরু হবে। আগামী শিক্ষাবর্ষ থেকেই প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণী এবং ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের মাধ্যমে শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন শুরু হবে। নতুন কারিকুলাম অনুসারে প্রাথমিকে প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত বিদ্যালয়েই ধারাবাহিক মূল্যায়ন হবে। এদের কোনো পরীক্ষা থাকবে না। যেহেতু আগামী বছর থেকে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীতে নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়ন শুরু হওয়ায় এ দুই শ্রেণীতে পরীক্ষা হবে না। আর ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দে তৃতীয় শ্রেণীর শিক্ষার্থীরা নতুন কারিকুলামে পড়ালেখা শুরু করলে সে বছর থেকে তাদের পরীক্ষাও থাকছে না।
২০২৪ সালে থেকে জেএসসি জেডিসি ও প্রাথমিক সমাপনীও থাকছে না : সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দের প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণী ও ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের মাধ্যমে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন শুরু হবে। ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দের তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণী এবং অষ্টম ও ৯ম শ্রেণী নতুন এই শিক্ষাক্রমের আওতায় আসবে। এ শিক্ষাক্রমের আওতায় ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে স্কুল পর্যায়ের সব শিক্ষার্থীকে নিয়ে আসা হবে। অবশ্য এর আগেও শিক্ষামন্ত্রী ড. দীপু মনি জানিয়েছিলেন, নতুন কারিকুলামে স্কুল পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের দশম শ্রেণী শেষে একটি পাবলিক পরীক্ষায় অংশ নিতে হবে। সে অনুসারে ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ থেকে অষ্টম শ্রেণীর শিক্ষার্থীরা নতুন কারিকুলামে অন্তর্ভুক্ত হলে সে বছর থেকেই জেএসসি পরীক্ষা থাকছে না। আর ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দে পঞ্চম শ্রেণীর শিক্ষার্থীরা নতুন কারিকুলামে অন্তর্ভুক্ত হলে সে বছর থেকে আর হবে না প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা।
মাধ্যমিকে থাকবে না কোনো বিভাগ : নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের ফলে মাধ্যমিক পর্যন্ত থাকছে না কোনো বিভাগ। অর্থাৎ সায়েন্স, আর্টস, কমার্স বিভাজন উঠে যাচ্ছে। ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণীর সবাইকে পড়তে হবে ১০টি বিষয়। দশম শ্রেণীর পাঠ্যসূচির ওপরই অনুষ্ঠিত হবে এসএসসি পরীক্ষা। একাদশ শ্রেণীতে গিয়ে শিক্ষার্থীদের বিভাগ পছন্দ করতে হবে। একাদশ শ্রেণী শেষে পরীক্ষা এবং দ্বাদশ শ্রেণী শেষে পরীক্ষা নেয়া হবে। এই দুই পরীক্ষার ফলাফলের সমন্বয়ে তৈরি হবে এইচএসসির ফল।
একাদশ-দ্বাদশে দুইটি পাবলিক পরীক্ষা : এ দিকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দ থেকে পরিমার্জিত নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন শুরু হবে। ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে স্কুল পর্যায়ের কারিকুলাম বাস্তবায়ন সম্পন্ন হবে। একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণীর শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন করা হবে ২০২৬ ও ২০২৭ খ্রিষ্টাব্দে। এর আগে গত বছরের ১৩ সেপ্টেম্বর এক সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষামন্ত্রী ডা: দীপু মনি জানিয়েছিলেন, নতুন কারিকুলামে উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নের গ্রেডিং হবে একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণীর আলাদা পরীক্ষার ফলের সমন্বয়ে। উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে একাদশ শ্রেণী ও দ্বাদশ শ্রেণীর পর শিক্ষার্থীদের আলাদা আলাদা দু’টি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। এ পরীক্ষারগুলোর ফল বিবেচনা করে দ্বাদশ শ্রেণীর পর শিক্ষার্থীদের উচ্চমাধ্যমিকের মূল্যায়ন করা হবে।
শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন পদ্ধতি : নতুন কারিকুলামের রূপরেখা অনুসারে প্রাথমিকে প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত বিদ্যালয়েই ধারাবাহিক মূল্যায়ন হবে। কোনো পরীক্ষা থাকবে না। আর চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণীতে গিয়ে শিখনকালীন মূল্যায়ন হবে ৬০ শতাংশ। আর ৪০ শতাংশ মূল্যায়ন হবে ক্লাস শেষে পরীক্ষার মাধ্যমে যেটি সামষ্টিক মূল্যায়ন বলা হচ্ছে। ষষ্ঠ ও অষ্টম শ্রেণীতে বিদ্যালয়ে ধারাবাহিক মূল্যায়ন হবে ৬০ শতাংশ এবং ৪০ শতাংশ হবে সামষ্টিক মূল্যায়ন। নবম ও দশম শ্রেণীতে কয়েকটি বিষয়ে শিখনকালে অর্ধেক মূল্যায়ন হবে এবং বাকি অর্ধেক সামষ্টিক মূল্যায়ন হবে। একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণীতে ৩০ ভাগ শিখনকালীন মূল্যায়ন এবং ৭০ ভাগ সামষ্টিক মূল্যায়ন হবে।
এ বিষয়ে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের সদস্য (কারিকুলাম) অধ্যাপক মশিউজ্জামান বলেন, নতুন কারিকুলামের খসড়া পূর্ণাঙ্গ কমিটি অনুমোদন দিয়েছে। এখন এটি বাস্তবায়নে আর কোনো বাধা নেই। আগামী বছর থেকে ধাপে ধাপে তা বাস্তবায়ন করা হবে । তিনি আরো বলেন, নতুন কারিকুলামের ভাষাগত কয়েকটি বিষয় ছাড়া তেমন কোনো পরিবর্তন আনা হয়নি।
সূত্র জানায় গত সোমবারের সভায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব আবু বকর ছিদ্দীক, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব মো: আমিনুল ইসলাম, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক আলমগীর মুহম্মদ মনসুরুল আলম, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক মশিউর রহমানসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ ও বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা উপস্থিত ছিলেন।