সাংবাদিকের ওপর হাত নয়, পা তোলার নির্দেশ আ.লীগ নেতার

Slider জাতীয়


নীলফামারীর সৈয়দপুরে রেলওয়ে কারখানার ড্রেনের ওপর টেন্ডার দিয়ে সবজি বাজার নির্মাণ করেছে পৌরসভা কর্তৃপক্ষ। এ সংক্রান্ত সংবাদ প্রকাশ করায় নির্মাণ কাজ বন্ধ করে দেয় রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। আর তাতেই নির্যাতন নেমে এসেছে সাংবাদিকের ওপর।
সাংবাদিকের ওপর হাত নয়, পা তোলার নির্দেশ আ.লীগ নেতার

শুধু মারপিট ও মামলা দিয়েই থেমে থাকেনি প্রভাবশালীরা। জুতার মালা পরানো ছবি রাস্তায় রাস্তায় টানিয়ে মানসিকভাবে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ নির্যাতিত ওই সাংবাদিক পরিবারের। ফটোশপে এডিট করে সৈয়দপুর শহরের রাস্তায় রাস্তায় সাঁটানো সাংবাদিক মোতালেবের প্ল্যাকার্ড শোভা পাচ্ছে কয়েক দিন ধরে। ছবিটি রংপুরের প্রাচীনতম আঞ্চলিক ‘দৈনিক দাবানলের’ সৈয়দপুর প্রতিনিধি মোতালেব হোসেনের। ‘হক সাংবাদিক’ নামে পরিচিত যিনি।

এর আগে ৮ এপ্রিল সন্ধ্যায় প্রকাশ্যে মাটিতে ফেলে তাকে দীর্ঘক্ষণ ধরে পিটিয়ে আহত করা হয়। মোতালেবের দাবি, সৈয়দপুর রেল কারখানার একটি ড্রেনের ওপর টেন্ডারের মাধ্যমে পৌরসভা সবজি বাজার নির্মাণ করছে। এ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন করায় রেল কর্তৃপক্ষ নির্মাণ কাজ বন্ধ করে দেয়। এরপর নেমে আসে নির্যাতন। তাকে আসামি করে দেয়া হয় মামলাও।

মোতালেব জানান, পরিবার-পরিজন নিয়ে তিনি নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। কারণ এসবের পেছনে প্রথমে মদদ দিলেও এখন প্রকাশ্য সভা-সমাবেশ করে তাকে পেটানোর হুমকি দিচ্ছেন উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মোকছেদুল মোমিন।

এদিকে নির্যাতনের শিকার মোতালেবকে উন্নয়নবিরোধী, হলুদ ও চাঁদাবাজ সাংবাদিক আখ্যা দিয়ে গত ৯ এপ্রিল একটি মানববন্ধনে ভাষণ দেন মোকছেদুল মোমিন। সাংবাদিকদের সম্পর্কে ঔদ্ধত্যপূর্ণ কথা বলায় তার এই বক্তব্যের একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। যেখানে তিনি তার সমর্থকদের নির্দেশ দিয়ে বলেছেন, সাংবাদিকের ওপর হাত তুললে দোষ হয়, এখন থেকে পা তুলবেন। তাও না পারলে থুতু ছিটিয়ে দেয়ার নির্দেশ দেন মোকছেদুল মোমিন।

এরপরে ঘটনাটি নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়েছে। দলের স্থানীয় নেতাকর্মীসহ কেন্দ্রীয় নেতারাও এতে বিব্রত। তারা বলছেন, আওয়ামী লীগের কোনো নেতা সাংবাদিক সম্পর্কে এ ধরনের কথা বলতে পারেন না। এ ব্যাপারে একাধিক কেন্দ্রীয় নেতা সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস দিলেও এখনও তা পরিলক্ষিত হয়নি বলে অভিযোগ করছেন সংশ্লিষ্টরা।

সাংবাদিকদের দুটি সংগঠন ঘটনাটি ৭ সদস্যের কমিটি দিয়ে তদন্ত করেছে। বাংলাদেশ মফঃস্বল সাংবাদিক ফোরাম ও সাংবাদিক নির্যাতন প্রতিরোধ কমিটির পক্ষে ওই কমিটির নেতৃত্ব দেন সাংবাদিক শরীফা বেগম শিউলী। অনুসন্ধানের পর দেওয়া প্রতিবেদনে বলা হয়, অবাঙালি অধ্যুষিত নীলফামারীর রেলের শহর সৈয়দপুরে ১৯৮৪ সালে এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ ভূমি প্রশাসনের মাধ্যমে ২৫.৭৫ একর জমি লিজ দেয় সৈয়দপুর পৌরসভাকে।

রেলের বাজার আছে সেই জমিতে শুধু উন্নয়ন কাজে অনুমতি দিতে পারবে পৌরসভা। এছাড়া জমি, রাস্তা-ঘাট, বাজার, মসজিদ পৌরসভার কাছে হস্তান্তর করে। এরপর থেকেই শুরু হয় রেলের জমি দখল করে বহুতল ভবন, বাজার, মার্কেট, আবাসিক হোটেল, বাসা নির্মাণ। এসব দখলদার ভূমিদস্যুর বিরুদ্ধে ধারাবাহিক সংবাদ প্রকাশিত হওয়ায় বিষয়টি নজরে আসে রেল কর্তৃপক্ষের। ফলে গত ১৪ এপ্রিল ২০২২ রেলের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শামীম হুসাইনের উপস্থিতিতে রেলের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নুরুজ্জামান সৈয়দপুর আধুনিক পৌর সবজি বাজারের নির্মাণ কাজ পরিদর্শন করে তা বন্ধ করে দেওয়ার নির্দেশ দেন।

প্রতিবেদনে বলা হয়, এরূপ কর্মকাণ্ডে নিজেদের অপরাধ ঢাকতে সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য ভূমিদস্যুরা পরিকল্পিতভাবে শহরের বিভিন্ন স্থাপনায় জুতার মালা পরিয়ে মোতালেব হোসেনের ছবির পোস্টার টাঙিয়ে দিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছবিটি ভাইরাল করে দেয়।

ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ও স্থানীয় বাসিন্দারা জানায়, মূলত সরকারি দল আওয়ামী লীগের উপজেলা পর্যায়ের দুই শীর্ষ নেতার বিরোধের বলি মোতালেবও একই দলের নেতা। রেলের লোহা চুরি, জমি দখল নিয়ে সংবাদ প্রচার করায় এক সময়ে রেলের খালাসী বর্তমান সৈয়দপুর উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি মোকছেদুল মোমিনের সঙ্গে সাংবাদিক মোতালেব হোসেন হকের দীর্ঘদিন ধরে দ্বন্দ্ব চলে আসছিল।

এ বিষয়ে হামলা-মামলার শিকার ভুক্তভোগী সাংবাদিক মোতালেব হোসেন বলেন, দীর্ঘদিন ধরে রেলের লোহা চুরি, জমি দখলসহ সৈয়দপুর পৌরসভা রেলের ব্যাকবোন ড্রেন দখল করে স্থায়ী মার্কেট নির্মাণ করছে। যা আমি ধারাবাহিকভাবে সংবাদ প্রকাশ করে আসছি। ফলে রেল কর্তৃপক্ষ অবৈধ মার্কেট নির্মাণ বন্ধ করে দিলে স্থানীয় সুবিধাভোগী অসৎ ব্যবসায়ী ভূমিদস্যু ও কয়েকজন রাজনৈতিক নেতার যোগসাজশে আমার ওপর হামলা চালানো হয়। এবিষয়ে ঘটনার পরদিন থানায় মামলা দিলে, থানা মামলা না নেওয়ায় কোর্টে মামলা দায়ের করি। আর সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন করার বিষয়টি আইনি পদক্ষেপ প্রক্রিয়াধীন।

তিনি আরও বলেন, আমাকে হেয় করার জন্য আমার নামে মিথ্যা চাঁদাবাজির মামলা করা হয়েছে। এছাড়াও বিভিন্ন মাধ্যমে আমার হাতপা ভেঙে দেওয়াসহ হত্যার হুমকি দিচ্ছেন বর্তমান উপজেলা চেয়ারম্যান মোকছেদুল মোমিন। আমি বাসা থেকে বের হতে পারছি না। বর্তমানে আমি আমার পরিবার নিয়ে চরম নিরাপত্তাহীনতায় আছি।

এ ব্যাপারে বক্তব্য চাইলে একাধিকবার সময় দিলেও শেষ পর্যন্ত আনুষ্ঠানিক কোনো বক্তব্য দেননি সৈয়দপুর উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি মোকছেদুল মোমিন।

তবে সময় নিউজের এই প্রতিবেদকের সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা হয় তার।

তিনি জানান, ওই সাংবাদিক সাংবাদিকতার কোনো নীতিমালা না মেনে দীর্ঘদিন ধরে আমার বিরুদ্ধে মিথ্যে প্রচারণা চালিয়ে আসছে।

সৈয়দপুর উপজেলা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক মহসীন হক মহসীন বলেন, সাংবাদিক মোতালেব হোসেন হক, তিনি উপজেলা আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজ কল্যাণ বিষয়ক সম্পাদক। তিনি সাংবাদিক হিসেবে সংবাদ প্রকাশ করেছেন, সেটা যদি মিথ্যা হয় তাহলে প্রতিবাদ জানাবে কিংবা আইসিটি আইনে মামলা হবে। কিন্তু তার ওপর যে হামলা হলো সেটা আমরা ভালো চোখে দেখছি না। হামলার পরপরই আমরা সৈয়দপুর উপজেলা আওয়ামী লীগ তৎক্ষণাৎ একটি প্রতিবাদ মিছিল করি। এ প্রতিবাদ মিছিলের মাধ্যমে আমরা হামলাকারীদের জানান দিয়েছি যে আমরা রাজপথে আছি। এ হামলার সঙ্গে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি করছি।

তিনি আরও বলেন, একজন সাংবাদিকের গলায় জুতার মালা পরিয়ে পোস্টার লাগানোসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া খুবই দুঃখজনক এবং খারাপ নজির। জুতার মালা কেন পরাবে, কী অপরাধ করেছে সে! সে তো কোনো দোষী সাব্যস্ত হয় নাই। যারা এমনটা করেছে তাদের বিরুদ্ধে সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি বলে আমি মনে করি।

এদিকে, সার্বিক বিষয়কে ‘সেনসিটিভ’ বলে বক্তব্য দেননি সৈয়দপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবুল হাসনাত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *