বোরো ধান নিয়ে দুশ্চিন্তায় কৃষক

Slider কৃষি, পরিবেশ ও প্রকৃতি


সুনামগঞ্জে গত কয়েক দিনের পাহাড়ি ঢলে হাওরের ৯টি বাঁধ ভেঙে পানিতে তলিয়ে গেছে প্রায় ১০ হাজার হেক্টরেরও বেশি বোরো ফসল। জেলায় আরো ৩৫টির বেশি ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধের কারণে ফসল ডুবির শঙ্কা পিছু ছাড়ছে না কৃষকদের। ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধগুলোর মধ্যে রয়েছে তাহিরপুর উপজেলার ছয়টি, ধর্মপাশা উপজেলায় ছয়টি, শাল্লায় তিনটি, জগন্নাথপুরে ১০টি, বিশ্বম্ভরপুরে তিনটি, জামালগঞ্জে তিনটি, সদর উপজেলায় দু’টি, দিরাই ও দোয়ারাবাজার উপজেলার একটি বাঁধ। এ কারণে অনেক কৃষক ফসল ডুবির ভয়ে আধাপাকা ধান কেটে বাড়ি আনছেন। আর সপ্তাহখানেক পরই সুনামগঞ্জের হাওরের ধান পাকার আশা করছিল কৃষক। এখন যেখানে ফসল তোলার প্রস্তুতি নিয়ে ব্যস্ত থাকার কথা সেখানে তাঁদের প্রাণান্তকর চেষ্টা চলছে ফসল রক্ষা বাঁধ বাঁচাতেই। দিন-রাত স্বেচ্ছায় কাজ করেও ফসল বাঁচবে কি না তা নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েছেন। এই অবস্থায় জেলার তিন লাখ ৭৮ হাজার ৭০৫টি কৃষক পরিবারের দুশ্চিন্তা যে পিছু ছাড়ছে না।

সুনামগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক বিপ্লব চ›ত্র সোম জানান, জেলায় দুই লাখ ২৩ হাজার ৫০৮ হেক্টর জমিতে এবার বোরো আবাদ হয়েছে। বৃহস্পতিবার দিরাই উপজেলার চাপতির হাওরে সাড়ে তিন হাজার হেক্টর জমির বোরো ধান তলিয়ে গেছে। এ পর্যন্ত জেলায় চার হাজার ৩৫০ হেক্টর জমির বোরো ধান তলিয়ে গেছে। তবে কৃষকরা বলছেন ১০ হাজার হেক্টরেরও বেশি বোরো ফসল তলিয়ে গেছে। তিনি জানান, জেলার ১৩৭টি হাওরসহ কৃষির সাথে তিন লাখ ৭৮ হাজার ৭০৫টি পরিবার জড়িত। হাওর ক্ষতিগ্রস্ত হলে তারাও বিশাল ক্ষতির মুখে পড়ে। মাঠ পর্যায়ে আমাদের কৃষি কর্মকর্তাদের তথ্য এবং আমরা সরেজমিন প্রতিদিন বিভিন্ন হাওর ঘুরে যা দেখেছি, সে অনুযায়ী এখনো জেলার ছোট বড় ১৩৭টি হাওরই ঝুঁকির মুখে আছে। প্রতিটি ফসল রক্ষা বাঁধ ঢলের পানি ছুঁই ছুঁই করছে।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো: জহুরুল ইসলাম বলেন, ২০২১-২২ অর্থবছরে ১২১ কোটি টাকা ব্যয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ড ৭২৩টি প্রকল্পের মাধ্যমে হাওরের ৫৩০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ নির্মাণ, মেরামত ও সংস্কার করেছে। এক সপ্তাহ ধরে পাহাড়ি ঢলের চাপে অস্থায়ী বেড়িবাঁধগুলো ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এখন খুব ধীরগতিতে পানি নামছে। এ অবস্থায় উজানে আবারো বৃষ্টিপাত হলে বড় বিপর্যয়ের আশঙ্কা রয়েছে। পানিসম্পদ উপমন্ত্রী এ কে এম এনামুল হক শামীম সুনামগঞ্জের হাওর ডুবির কারণ দেখতে এসে গতকাল সন্ধ্যায় জেলা পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা কমিটি, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, স্থানীয় নেতা, সুবিধাভোগী, গণমাধ্যমকর্মী এবং কর্মকর্তাদের সাথে মতবিনিময় সভায় সুনামগঞ্জে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) সব কর্মকর্তার ছুটি বাতিল করেছেন। ৫ এপ্রিল পানি উন্নয়ন বোর্ডের ধর্মপাশা উপজেলার ৭৫ নম্বর পিআইসির ডুবাইল বাঁধ ভেঙে যায়। সেখানে গিয়ে দেখা যায়, হাওর ও কংস নদী এখন একাকার। ধনু ও সুরমার পাহাড়ি ঢলের চাপে কংস নদী ফুলে উঠেছে। এতে চন্দ্রসোনার থাল, ধারাম হাওর ও নেত্রকোনার মোহনগঞ্জ উপজেলার হালদিয়া হাওর ভাঙনের ঝুঁকিতে। ডুবাইল বাঁধটি ভেঙে ধর্মপাশার ১৮৫ হেক্টর জমির আধপাকা বোরো ধান তলিয়ে গেছে।

নদীর অপর পাড়ের বাঁধটি দেখিয়ে চন্দ্রসোনার থাল হাওরের কৃষক সুজন মিয়া বলেন, ‘আমরার হাওর প্রতি বছর অরক্ষিত থাকে। অথচ আমাদের পাশের নদীর ওপারের বাঁধটি সম্পূর্ণ সুরক্ষিত। আমরা বছর বছর টেনশনে মরি। স্বেচ্ছাশ্রমে বাঁধে কাজ করেও শেষ পর্যন্ত রক্ষা করতে পারিনি। ‘চন্দ্রসোনার থাল হাওরের পাশেই ধর্মপাশা উপজেলার ধারাম হাওর। এই হাওরে প্রায় দুই হাজার হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ করেছেন কৃষকরা। পাশের হাওরটি তলিয়ে যাওয়ায় এই হাওরের কৃষকরা এখন দুশ্চিন্তায় আছেন। হাওরের কান্দা ও বাঁধে নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছেন তারা।

হাওরের কৃষি ও কৃষক রক্ষা সংগ্রাম পরিষদের সদস্যসচিব অধ্যাপক চিত্তরঞ্জন তালুকদার বলেন, প্রতিটি হাওরের অস্থায়ী বাঁধ এখন ঝুঁকিতে। বাঁধ নির্মাণ ও প্রকল্প গ্রহণ প্রক্রিয়ায় অনিয়ম আছে। অবৈজ্ঞানিকভাবে হাওরের পরিবেশ-প্রতিবেশকে মাথায় না নিয়ে যত্রতত্র প্রকল্প নেয়া হয়েছে। এগুলো এখন হাওরের জন্য ক্ষতিকর হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ঝুঁকিতে থাকা সুনামগঞ্জের বোরো ফসলের হাওর নিয়ে সংসদে পয়েন্ট অব অর্ডারে সোমবার সুনামগঞ্জ-৪ আসনের সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট পীর ফজলুর রহমান মিসবাহ হাওরের ফসল না ওঠা পর্যন্ত পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রী, সচিবসহ সবাই সুনামগঞ্জে অবস্থান করার দাবি জানিয়েছেন সংসদে।

সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসক মো: জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, জেলার প্রতিটি বাঁধেই আমাদের সজাগ দৃষ্টি রাখা হচ্ছে। উপজেলা প্রশাসন, জেলা প্রশাসন এলাকাবাসী সবাই বাঁধে কাজ করছেন। যে বাঁধে যে রকম সমস্যা হচ্ছে সেখানে তেমন ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। ফসল রক্ষাবাঁধ রক্ষা করতে প্রশাসনের পক্ষ থেকে সব ধরনের পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। প্রশাসনের পাশাপাশি স্থানীয় জনগণকে হাওর রক্ষা বাঁধের কাজে তদারকী শ্রম দিতে আহ্বান জানান তিনি। এই কয়েকটা দিন কোনো মতে আমরা কাটিয়ে উঠতে পারলে আশা করি হাওরের ফসল তুলতে সক্ষম হবো।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *