টিপু হত্যা : র‌্যাবের ব্রিফিং পরিকল্পনায় ছিলেন স্থানীয় নেতারা

Slider বাংলার আদালত


পুরনো দুটি হত্যাকাণ্ডসহ এলাকায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে রাজধানীর মতিঝিল থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল ইসলাম টিপুকে পূর্বপরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। আলোচিত এ হত্যার জন্য বাজেট করা হয়েছিল ১৫ লাখ টাকা। হত্যাকাণ্ডের মূল সমন্বয়কারী কিলার মুসা। টিপুকে হত্যার আগেই তিনি দুবাই চলে যান।

সেখানে বসেই তিনি হত্যাকাণ্ডের ছক কষেন। হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী ছিলেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ১০ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওমর ফারুকগত ২৪ মার্চ রাত সাড়ে ১০টার দিকে রাজধানীর শাহজাহানপুরে আওয়ামী লীগ নেতা জাহিদুল ইসলাম টিপু ও কলেজছাত্রী সামিয়া আফরান প্রীতি হত্যাকাণ্ডে দায়ের করা মামলায় চারজনকে গ্রেপ্তারের পর জিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিয়ে এসব তথ্য জানায় র‌্যাব। গ্রেপ্তাররা হলেন আওয়ামী লীগ নেতা ওমর ফারুক (৫২), আবু সালেহ শিকদার ওরফে শ্যুটার সালেহ (৩৮), নাছির উদ্দিন ওরফে কিলার নাছির (৩৮) ও মোরশেদুল আলম ওরফে কাইল্লা পলাশ (৫১)। রাজধানীর মুগদা, শাহজাহানপুর ও মিরপুর এলাকা থেকে তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁদের কাছ থেকে হত্যাকাণ্ডে ব্যবহার করা মোটরসাইকেল, হত্যার জন্য দেওয়া তিন লাখ ৩০ হাজার টাকা এবং মোবাইল ফোন উদ্ধার করা হয়েছে। এঁদের মধ্যে কাইল্যা পলাশ বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোট ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সাধারণ সম্পাদক। নাছির সম্পর্কে আরো জানা গেছে, টিপু হত্যার সময় ঘটনাস্থলের কাছে সাদা শার্ট, জিন্স প্যান্ট ও কেডস পরা অবস্থায় ছিল। ঘটনার পরে সে তার মোবাইল থেকে সব তথ্য মুছে ফেলে বিক্রি করে দেয় ও সিমকার্ড ভেঙে ফেলে। র‌্যাব পরে ওই মোবাইল ফোন ও সিমকার্ড উদ্ধার করে। এছাড়া ঘটনার আগের দিন সে সীমান্তবর্তী চৌদ্দগ্রাম এলাকায় অবস্থান করেছিল। নাছিরকে স্থানীয় আওয়ামী লীগ কর্মী হিসেবে সবাই চেনে। হত্যাকাণ্ডের সমন্বয়কারী মুসার আপন ছোট ভাই সালেহ শীর্ষ সন্ত্রাসী বিকাশের হয়ে কাজ করেন।

গতকাল শনিবার কারওয়ান বাজারে র‌্যাবের মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানানো হয়। সংবাদ সম্মেলনে র‌্যাবের মুখপাত্র খন্দকার আল মঈন বলেন, পুরনো দুটি হত্যাকাণ্ড ও এলাকায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করেই টিপু হত্যাকাণ্ড ঘটে। টিপু হত্যার অন্যতম পরিকল্পনাকারী ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ১০ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওমর ফারুক। এ ছাড়া গ্রেপ্তার হওয়া আবু সালেহ শিকদার ওরফে শ্যুটার সালেহও এ ঘটনার পরিকল্পনা ও অর্থ প্রদানের সঙ্গে জড়িত। তিনি রিজভী হাসান ওরফে বোঁচা বাবু হত্যাকাণ্ডের ২ নম্বর চার্জশিটভুক্ত আসামি। তাঁর নামে রাজধানীর বিভিন্ন থানায় হত্যা, অস্ত্র, চাঁদাবাজিসহ ১২টি মামলা রয়েছে। বিভিন্ন মেয়াদে তিনি কারাভোগও করেছেন।

গ্রেপ্তার চারজনই সাবেক যুবলীগ নেতা মিল্কীর অনুসারী জানিয়ে র‌্যাব কর্মকর্তা বলেন, ২০১৩ সালে যুবলীগ নেতা মিল্কী হত্যাকাণ্ড হয়। গ্রেপ্তার হওয়া চারজনই একসময় মিল্কীর অনুসারী ছিলেন। তাঁরা বিশ্বাস করেন, মিল্কী হত্যাকাণ্ডে জাহিদুল ইসলাম টিপু জড়িত। মিল্কী হত্যার পরে বিচারের দাবিতে এলাকায় টিপুর বিরুদ্ধে পোস্টারিং, মিছিল, মানববন্ধন, আলোচনাসভা করেছিলেন গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা। টিপু আদালতে অব্যাহতি পাওয়ায় ক্ষুব্ধ তাঁরা।

খন্দকার আল মঈন বলেন, টিপু হত্যার পরিকল্পনাকারীরাই ২০১৬ সালে রিজভী হাসান ওরফে ‘বোঁচা বাবু’কে হত্যা করেন। বাবু ছিলেন টিপুর ঘনিষ্ঠ সহযোগী। বাবু হত্যা মামলায় পুলিশ এরই মধ্যে গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিদের মধ্য থেকে তিনজন (ওমর ফারুক, আবু সালেহ শিকদার ও নাসির উদ্দিনের) বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দিয়েছে। সেই মামলাটি বর্তমানে দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের রায়ের অপেক্ষায় রয়েছে। ওই মামলায় অভিযুক্তরা মোরশেদুল আলম ওরফে কাইল্লা পলাশকে সুরতহাল সাক্ষী বানান মামলার গতিপথ পাল্টাতে।

তিনি আরো বলেন, বোঁচা বাবু হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় মামলা করেছিলেন তাঁর বাবা আবুল কালাম। কিন্তু মামলার যাবতীয় খরচসহ সব কিছু দেখভাল করেন জাহিদুল ইসলাম টিপু। আসামিরা ৫০ লাখ টাকা দিয়ে মামলার দফারফা করতে টিপুকে প্রস্তাব দিয়েছিলেন। টিপু রাজি হননি। গ্রেপ্তাররা প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে র‌্যাবকে জানান, টিপুর কারণেই মামলা দ্রুত বিচার ট্রাইবুনালে গেছে এবং বিচার দ্রুত হচ্ছে। আসামিদের আশঙ্কা ছিল, এ মামলায় তাঁদের ফাঁসি হবে। তাই মামলার স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত করতে প্রথমে মামলার বাদী আবুল কালামকে হত্যার পরিকল্পনা করা হয়। পরে আসামিরা সিদ্ধান্ত নেন টিপুকে হত্যা করলে মামলার কার্যক্রম ব্যাহত করা যাবে।

র‌্যাব জানায়, মূলত রিজভী হাসান ওরফে বোঁচা বাবু হত্যা মামলার রায় দীর্ঘায়িত করতেই টিপুকে হত্যার পরিকল্পনা করা হয়। সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সমন্বয়ক হিসেবে কাজ করেন কিলার মুসা। মুসা সরকারের তালিকাভুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসী প্রকাশ-বিকাশের সহযোগী। এ ছাড়া দীর্ঘদিন ধরে মতিঝিল এলাকার চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, স্কুল-কলেজের ভর্তি বাণিজ্য, বাজার নিয়ন্ত্রণ, আধিপত্য বিস্তার নিয়ে হত্যার পরিকল্পনাকারীদের সঙ্গে টিপুর বিরোধ বিদ্যমান ছিল।

হত্যার পরিকল্পনা যেভাবে

র‌্যাবের ভাষ্য, তিন থেকে চার মাস আগে টিপু হত্যার পরিকল্পনা করা হয়। পরিকল্পনার অংশ হিসেবে সুমন শিকদার মুসার সঙ্গে ১৫ লাখ টাকার চুক্তি করেন ওমর ফারুক। হত্যাকাণ্ডটি দেশে সংঘটিত হলেও তা নিয়ন্ত্রণ করা হয় দুবাই বসে। চুক্তির ১৫ লাখের মধ্যে মুসাকে প্রথমে ৯ লাখ টাকা দেন ওমর ফারুক।

দুবাই বসে হত্যার ছক

এই হত্যাকাণ্ডের ১২ দিন আগে গত ১২ মার্চ বাংলাদেশ থেকে দুবাই চলে যান কিলার মুসা। সেখানে বসে হত্যার ছক সাজান তিনি। দুবাই যাওয়ার পর মুসা আন্ডারওয়ার্ল্ডের সন্ত্রাসীদের মাধ্যমে শ্যুটার নিয়োগসহ অন্য কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেন। দেশ থেকে কিলার নাছির, কাইল্লা পলাশসহ আরো কয়েকজন হত্যার আগে টিপুর অবস্থান সম্পর্কে খোঁজ নিতে শুরু করেন। ঘটনার দিন সন্ধ্যার পর কিলার নাছির আনুমানিক চারবার টিপুর অবস্থান সম্পর্কে মুসাকে অবহিত করেন। পরে জাহিদুল ইসলাম টিপু গ্রান্ড সুলতান রেস্টুরেন্ট থেকে বের হওয়ার সময় কাইল্লা পলাশ তাঁকে নজরদারিতে রাখেন। টিপুর অবস্থান সম্পর্কে জানানোর পরিপ্রেক্ষিতে রাত সাড়ে ১০টার দিকে আন্ডারওয়ার্ল্ডের তত্ত্বাবধানে ভাড়াটে কিলার কর্তৃক টিপু হত্যাকাণ্ডটি সংঘটিত হয়।

টিপু হত্যাকাণ্ডে সব মিলিয়ে এ পর্যন্ত ছয়জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এর আগে এই হত্যা মামলায় মাসুম মোহাম্মদ আকাশ ও আরফান উল্লাহ দামালকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি)। তাঁরা বর্তমানে রিমান্ডে রয়েছেন।

ডিবির হাতে গ্রেপ্তার শ্যুটার মাসুম ও দামালের এই হত্যাকাণ্ডে সম্পৃক্ততার বিষয়ে জানতে চাইলে কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, হত্যাকাণ্ডটি কাটআউট পদ্ধতিতে করা হয়।

মূল পরিকল্পনাকারী ওমর ফারুককে দল থেকে বহিষ্কার শাহজাহানপুরে আওয়ামী লীগ নেতা জাহিদুল ইসলাম টিপু হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী ওমর ফারুককে আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে।

গতকাল বিকেলে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সভাপতি আবু আহমেদ মন্নাফি ও সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুন কবির স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে ফারুককে বহিষ্কারের কথা জানানো হয়।

এতে বলা হয়, ‘এই ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের খবর ব্যাপকভাবে প্রচারিত হওয়ায় ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে। এর দায়ভার কোনোভাবেই ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগ বহন করবে না। ’

‘দলের নীতি ও শৃঙ্খলা বহির্ভূত কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকায় দলীয় গঠনতন্ত্রের ৪৭ ধারা মোতাবেক আপনাকে বহিষ্কার করা হলো। ’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *