প্রতিদিন একজন মানুষের ৫ গ্রাম অর্থাৎ এক চা চামচ লবণ খাওয়া দরকার। কিন্তু খাচ্ছে কয়েকগুণ বেশি। শুধু ভাত তরকারিতে নিজ নিজ বাড়িতে মাত্রাতিরিক্ত নয়; না জেনে বাইরের খাবার থেকেও শরীরে ঢুকছে এই মাত্রাতিরিক্তি লবণ। যে কারণে বাড়ছে উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি। উচ্চ রক্তচাপের অন্যতম কারণ হিসেবে অতিরিক্ত লবণ খাওয়াকে দায়ি করছেন বিশেষজ্ঞরা। অতিরিক্তি লবণ বন্ধ করতে পারলে উচ্চরক্তচাপের ঝুঁকি ৫০ শতাংশ কমবে বলে ধারণা তাদের। পাশাপাশি খাদ্যাভাস ও জীবনযাত্রার মানে পরিবর্তনের উপর জোর দিচ্ছেন তারা।
আজ সোমবার রাজধানীর বাংলা মটরে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স-বিআইপি এর কনফারেন্স এই সার্বিক বিষয়ে গণমাধ্যমকর্মীদের অবহিতকরণ এবং করণীয় সম্পর্কে তুলে ধরতে প্রজ্ঞা (প্রগতির জন্য জ্ঞান) দুই দিনব্যাপী কর্মশালার প্রথম দিন বিশেষজ্ঞরা এসব তথ্য জানান।
তারা বলেন, উচ্চ রক্তচাপ একটি দীর্ঘস্থায়ী স্বাস্থ্যগত সমস্যা।
উচ্চরক্তচাপ থাকা ৫০ শতাংশের বেশিই জানেন না তাদের উচ্চরক্তচাপ রয়েছে। উচ্চ রক্তচাপের কারণে হৃদরোগ, স্ট্রোক এবং কিডনি রোগে আক্রান্ত হওয়া এবং মৃত্যুঝুঁকি বহুগুণ বেড়ে যায়। বিশ্বে প্রতিবছর ১ কোটিরও বেশি মানুষ উচ্চ রক্তচাপের কারণে মারা যায়, যা সকল সংক্রামক রোগে মোট মৃত্যুর চেয়েও বেশি। বাংলাদেশে প্রতি ৫ জনে ১ জন প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষ উচ্চ রক্তচাপে ভুগছে। উচ্চ রক্তচাপের ক্রমবর্ধমান প্রকোপ বাংলাদেশে অসংক্রামক রোগের ঝুঁকি ক্রমশ বাড়িয়ে তুলছে। দেশে এ বিষয়ে গণসচেতনতা এবং চিকিৎসা সেবা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব সৈয়দ মুজিবুল হক। আরও উপস্থিত ছিলেন, গ্লোবাল হেলথ অ্যাডভোকেসি ইনকিউবেটর এর কান্ট্রি ডিরেক্টর মো. রুহুল কুদ্দুস, ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হসপিটল অ্যান্ড রিসার্স ইনস্টিটিউটের উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ প্রোগ্রামের প্রোগ্রাম ম্যানেজার ডা. মাহফুজুর রহমান ভূইয়া, ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার ডা. শামীম জুবায়ের, প্রজ্ঞার নির্বাহী পরিচালক এবিএম জুরায়ের।
ডা. মাহফুজুর রহমান ভূইয়া বলেন, অতিরিক্তি লবণ বন্ধ করতে পারলে ৫০ শতাংশের উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি কমে যেতো। একজন মানুষের প্রতিদিন ৫ গ্রাম লবণ প্রয়োজন অর্থাৎ এক চামচ। কিন্তু তার বেশি তারা খাচ্ছেন। জেনে খাচ্ছেন আবার না জেনেও খাচ্ছেন। ঘরে তিনি জেনে খাচ্ছেন। আর ঘরে বাইরে যে খাবার খাচ্ছেন, তাতে কি পরিমাণ লবণ আছে, তা না জেনেই খাচ্ছেন। যেমন চিপসে ১০ গ্রাম লবণ থাকে। তা অনেকই জানেন না। মানুষ সিংগারা ছামুচা বা হোসেলে রেস্ট্ররেন্টে বিভিন্ন খাবার খাচ্ছেন, তাতে কি পরিমাণ লবণ রয়েছে তা তিনি না জেনেই খাচ্ছেন। ফলে শরীরে ঢুকছে মাত্রাতিরিক্ত লবণ। ঘরে লবণ খাওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, পরিবারের সদস্য হিসেবে তরকারিতে ঠিক সেই কয়চামচ লবণ দেয়া দরকার, তার বেশি নয়। ২০২০ সালে বাংলাদেশে উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা ছিল ৩ কোটি, যা ২০৩০ সাল নাগাদ গিয়ে দাঁড়াবে ৩ কোটি ৮০ লাখ। তাই বিষেশজ্ঞরা স্কিনিংয়ের উপর জোর দিচ্ছেন।
এ প্রসঙ্গে ডা. শামীম বলেন, ১৮ বছর বয়সে ব্লাড পেশার মাপবেন। যদি দেখেন নরমাল। ছয় মাস এক বছরের মধ্যে মাপতে হবে না। একবছর পরে আবার মাপবেন। মো. রুহুল কুদ্দুস বলেন, প্রথমে স্কিনিং করতে হবে। স্কিনিংয়ে আসার পর যাদের আছে। তাদের সেই হিসেবে ট্রিটমেন্ট দেয়া। আর যাদের নেই তাদের যাতে না হয় সে হিসেবে কি কি লাইফস্টাইল চেঞ্জ করতে হবে সে বিষয়ে আমরা বললো। প্রথম কাজ হচ্ছে সবাইকে স্কিনিংয়ের আওতায় নিয়ে আসা।
বিশেষজ্ঞরা জানান, অধিকাংশ সময় উচ্চ রক্তচাপের নির্দিষ্ট কোন লক্ষণ এবং উপসর্গ থাকে না অর্থাৎ উচ্চ রক্তচাপে ভোগা অনেক রোগী জানেই না যে তার উচ্চ রক্তচাপ রয়েছে। এজন্য উচ্চ রক্তচাপকে নীরব ঘাতক বলা হয়। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে সকালের দিকে মাথাব্যথা, নাক দিয়ে রক্ত পড়া, হৃৎপি-ের অনিয়মিত ছন্দ, দৃষ্টিতে পরিবর্তন এবং কানে গুঞ্জন অনুভূতি প্রভৃতি উপসর্গ দেখা দিতে পারে। অত্যাধিক উচ্চ রক্তচাপ ক্লান্তি, বমি বমি ভাব, বমি, বিভ্রান্তি, উদ্বেগ, বুকে ব্যথা এবং পেশী কম্পনের কারণ হতে পারে। উচ্চ রক্তচাপ শনাক্ত করার একমাত্র উপায় হল চিকিৎসক বা পেশাদার স্বাস্থ্যকর্মী দ্বারা রক্তচাপ পরিমাপ করা। উচ্চ রক্তচাপের চিকিৎসা করা না হলে, এটি ধমনি এবং মানবদেহের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মারাত্মক ক্ষতিসাধন করে। এমনকি ধমনি শক্ত হয়ে হৃৎপি-ে রক্ত ও অক্সিজেনের প্রবাহ হ্রাস পেতে পারে। ফলে বুকে ব্যথা বা অ্যানজাইনা, হার্ট অ্যাটাক, হার্ট ফেইল এবং হার্ট বিট অনিয়মিত হতে পারে। উচ্চ রক্তচাপের কারণে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ অর্থাৎ স্ট্রোক হতে পারে। এছাড়াও উচ্চ রক্তচাপের কারণে কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, এমনকি বিকলও হয়ে যেতে পারে।
অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস যেমন, খাদ্যের সঙ্গে অতিরিক্ত লবণ ( সোডিয়াম) গ্রহণ, স্যাচুরেটেড ফ্যাট এবং ট্রান্স ফ্যাটযুক্ত খাবার, তামাক ও অ্যালকোহল সেবন উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি বৃদ্ধি করে থাকে। অস্বাস্থ্যকর জীবন-যাপনও উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি বৃদ্ধি করতে পারে যেমন, শারীরিকভাবে কর্মঠ না থাকা, অতিরিক্ত ওজন, মানসিক চাপ এবং পর্যাপ্ত পরিমাণে ফলমূল ও শাকসবজি না খাওয়া। এছাড়াও পারিবারিকভাবে উচ্চ রক্তচাপের ইতিহাস থাকলে, বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে (৬৫ বছরের পরে) এবং ডায়াবেটিস বা কিডনি রোগের সঙ্গে উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি বৃদ্ধি পেয়ে থাকে।
অনুষ্ঠানে জানানো হয় বাংলাদেশে উচ্চ রক্তচাপ পরিস্থিতি উদ্বেগজনক। ‘বাংলাদেশ এনসিডি স্টেপস সার্ভে, ২০১৮’ অনুযায়ী ১৮ বছরের ঊর্দ্ধে জনগোষ্ঠির মধ্যে ২১ শতাংশ (নারী ২৪.১ শতাংশ, পুরুষ ১৭.৯ শতাংশ) উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত এবং এদের মধ্যে ওষুধ গ্রহণের মাধ্যমে রোগটি নিয়ন্ত্রণে রেখেছে মাত্র ১৪ শতাংশ অর্থাৎ প্রতি ৭ জনে একজনেরও কম। অন্যদিকে ‘বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক অ্যান্ড হেলথ সার্ভে ২০১৭-১৮’ অনুযায়ী, ২০১১ থেকে ২০১৭-১৮ সাল সময়ের মধ্যে, ৩৫ বছর ও তদূর্ধ্ব জনগোষ্ঠির মধ্যে উচ্চ রক্তচাপের প্রকোপ উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে, পুরুষের মধ্যে ২০ শতাংশ থেকে বেড়ে ৩৪ শতাংশে এবং নারীর ক্ষেত্রে এই হার ৩২ শতাংশ থেকে ৪৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। অতিরিক্ত ওজন বা স্থূলতা রয়েছে এমন নারী এবং পুরুষের মধ্যে উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হওয়ার হার যথাক্রমে ৪৯ শতাংশ এবং ৪২ শতাংশ, যেখানে স্বাভাবিক ওজনের নারী এবং পুরুষের মধ্যে এই হার যথাক্রমে ২৫ শতাংশ এবং ২৪ শতাংশ । উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত অর্ধেক নারী (৫১ শতাংশ) এবং দুই-তৃতীয়াংশ পুরুষই (৬৭ শতাংশ) জানে না যে তাদের উচ্চ রক্তচাপ রয়েছে। উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত অধিকাংশ রোগীই (৬৪ শতাংশ) কোনো ওষুধ সেবন করে না।
আরেকটি গবেষণায় ২০১৯ এর তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে মৃত্যু এবং পঙ্গুত্বের প্রধান তিনটি কারণের একটি উচ্চ রক্তচাপ। বাংলাদেশে বছরে ২ লাখ ৭৭ হাজার মানুষ হৃদরোগজনিত অসুস্থতায় মারা যায়, যার অন্যতম প্রধান কারণ উচ্চ রক্তচাপ। ডব্লিউএইচও’র তথ্যমতে বাংলাদেশে প্রতিবছর ৫ লক্ষাধিক মানুষ অসংক্রামক রোগে মৃত্যুবরণ করেন, যার প্রায় অর্ধেক হৃদরোগজনিত।
উচ্চ রক্তচাপ কি, এর লক্ষণ:
রক্তচাপ যদি স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে অনেক বেড়ে যায় তাহলে তাকে উচ্চ রক্তচাপ বা হাইপারটেনশন বলে। স্বাভাবিক অবস্থায় একজন প্রাপ্তবয়স্ক সুস্থ মানুষের রক্তচাপের পরিমাপ ১২০/৮০ মি.মি. পারদচাপ ধরা হয়ে থাকে। রক্তচাপের এই মাত্রা দুইটি ভিন্ন দিনে ১৪০/৯০ মি.মি. পারদচাপ বা তার বেশি হলে বুঝতে হবে উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা রয়েছে। তবে বয়স নির্বিশেষে রক্তচাপ কিছুটা কম বা বেশি হতে পারে। ডায়াবেটিস ও কিডনি রোগীদের ক্ষেত্রে ১৩০/৮০ মি.মি. পারদচাপ এর অধিক হলে তা উচ্চ রক্তচাপের পর্যায়ে পড়তে পারে।
আপনার মতামত দিন