সম্পাদক, এমডি প্রতারণার গ্র্যান্ডমাস্টার

Slider ফুলজান বিবির বাংলা

রাজবাড়ীর খানগঞ্জের ছেলে মো. ইসহাক আলী মনি। বাবার নাম শহিদুল ইসলাম। বাবার প্রতারণার কারণে ছোটবেলায় এলাকাবাসী তাদের গ্রামছাড়া করেছিল। পরে পাড়ি জমায় কুষ্টিয়ার কুমারখালীতে। সেখানে গিয়ে বাবা-ছেলে দু’জনই শুরু করে মানুষের সঙ্গে প্রতারণা। ওই এলাকার অনেক যুবককে বিদেশে পাঠানোর নামে টাকা নিয়ে সর্বস্বান্ত করে। সেখান থেকেও বিতাড়িত হয় তারা। ইসহাক চলে আসে ঢাকায়।
তারপর থেকে শুরু করে নিত্য নতুন কৌশলে অভিনব সব প্রতারণা। পত্রিকা অফিস থেকে শুরু করে কর্পোরেট অফিস, এনজিও, স্বাস্থ্যসেবাসহ আরও বিভিন্ন ধরনের ভুয়া প্রতিষ্ঠান সাজিয়ে করে গেছে একের পর এক প্রতারণা। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রতারণার গ্র্যান্ড মাস্টার হয়ে ওঠে ইসহাক।
এই প্রতারক এ পর্যন্ত কত কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে তার হিসাব মেলাতে হিমশিম খাচ্ছেন সবাই। তবে তার প্রতারণার শিকার ভুক্তভোগীদের তথ্যমতে অন্তত শতাধিক নামীদামি প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিকে ঠকিয়েছে। প্রতারণার অভিযোগে তিনবার গ্রেপ্তারও হয়। তবে বেশিদিন কারাগারে থাকতে হয়নি। অল্পদিনের মধ্যেই জামিনে বেরিয়েছে সে। সর্বশেষ চুরি করা গাড়ি বিক্রি করতে গিয়ে গত ২৪শে ফেব্রুয়ারি তেজগাঁও থানা পুলিশের কাছে ধরা পড়ে ইসহাক। এখন বিভিন্ন মামলায় তাকে তদন্ত কর্মকর্তারা রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছেন।
ভুক্তভোগীরা ও পুলিশ জানিয়েছে, ইসহাক ও তার সহযোগীরা প্রথমে শহরের ব্যস্ততম ও গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় বহুতল ভবনে বড় পরিসরে কখনো এনজিও, ভুয়া পত্রিকা অফিস, কখনো করপোরেট অফিস, কখনো থ্রি ও ফোর স্টার মানের হোটেলের নামে একাধিক ফ্লোর ভাড়া নেন। ইসহাক নিজেই ওইসব প্রতিষ্ঠানের এমডি কিংবা চেয়ারম্যান, পরিচালক অথবা সিইও হিসাবে পরিচয় দেন। অফিস সাজানো-গোছানোর জন্য পরিকল্পিতভাবে শহরের স্বনামধন্য ফার্নিচার, মোবাইল কোম্পানি, টাইলস, পেইন্টিং, এড, কার্পেট, আইটি ফার্মসহ বিভিন্ন ইলেকট্রনিকসের শোরুমে যায় তার সহযোগীরা। দোকান মালিকদের জানান, তাদের সাব-অফিস এবং কারখানার জন্য যাবতীয় ফার্নিচার, মোবাইল সিম, ইলেকট্রনিক সামগ্রী, সিসিটিভি ক্যামেরা, কম্পিউটার, ল্যাপটপ, এসি, টিভি, লিফট, জেনারেটর, হার্ডওয়্যারের পণ্য লাগবে। প্রথমে ব্যাংক চেকের মাধ্যমে ছোটখাটো পেমেন্ট দিয়ে আস্থা অর্জন করেন। পরে প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কোনো কর্মকর্তার স্বাক্ষর করা ব্যাংক চেক পেয়ে লাখ লাখ টাকার পণ্য সরবরাহও করেন দোকান বা প্রতিষ্ঠান মালিক। দুই থেকে তিন সপ্তাহ পর ওই চেক নগদায়নের জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যাংকে গিয়ে দোকান মালিক জানতে পারেন সবই ভুয়া। প্রতারকের খপ্পরে পড়েছেন তিনি। উপায়ান্তর না পেয়ে মাল ফেরত আনতে প্রতারকদের প্রতিষ্ঠানে গিয়ে দেখেন কেউ নেই।

সূত্রগুলো জানিয়েছে, দ্যা ডেইলি মর্নিং এক্সপ্রেস, দৈনিক রুপকার, দৈনিক মাই বাংলা নিউজ, দৈনিক জনবাণী, মুক্তি এনজিও, নারী উন্নয়ন সংস্থা, চেতনা হেলথ কেয়ার অ্যান্ড ডেভেলপার ও বাংলাদেশ সেফ ট্রানজিট সিস্টেম-বিএসটিএসএলসহ আরও কিছু ব্যানারে প্রতারণার ফাঁদ পেতেছিল ইসহাক। দৈনিক রুপকার পত্রিকায় তার নাম ছিল মোহাম্মদ ইসহাক। পদবি ছিল প্রধান সম্পাদক। মর্নিং এক্সপ্রেসে নাম ছিল ইসহাক আলী। পদবি প্রধান সম্পাদক। বাংলাদেশ সেফ ট্রানজিট সিস্টেম-বিএসটিএসএল নামের প্রতিষ্ঠানে তার নাম এম ইসহাক আলী। এই প্রতিষ্ঠানে তার পদবি ছিল ম্যানেজিং ডিরেক্টর। প্রতারণা ও টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন থানায় ইসহাকের চক্রের বিরুদ্ধে অন্তত ২০টি মামলা রয়েছে। এর বাইরে শতাধিক জিডি রয়েছে। ইসহাকের ফাঁদে পড়ে কোটি কোটি টাকা খুইয়েছে অনেক প্রতিষ্ঠান। অধিকাংশ মামলায় আসামি হিসেবে আছেন চক্রটির মূলহোতা মোহাম্মদ ইসহাক আলী মনি ওরফে ই-আলী। মোহাম্মদ আলী, এম ই মনি ও ইসহাক নামেও পরিচিত সে।

পুলিশ জানিয়েছে, ইসহাকের বিরুদ্ধে রমনা, গুলশান, পল্টন, মতিঝিল, ওয়ারী, মুগদা, উত্তরা পশ্চিম, উত্তরা পূর্ব, তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল, মোহাম্মদপুর, কদমতলী, তেজগাঁও, নিউমার্কেট, সাতক্ষীরার কালীগঞ্জ, কলারোয়া, সিরাজগঞ্জের সদর, কিশোরগঞ্জের বাজিতপুরসহ দেশের আরও অনেক স্থানে একাধিক মামলা রয়েছে। এর বাইরে প্রতারিত অনেকেই দেশের বিভিন্ন থানায় জিডি করেছেন। একাধিক গ্রেপ্তারি পরোয়ানাও আছে। কিছু মামলার রায় হয়েছে। বিভিন্ন মামলায় সে ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২২ সালে গ্রেপ্তার হয়।

ইসহাকের দ্বারা প্রতারিত হয়েছেন এমন ৪০টি প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির নাম এসেছে। এসব প্রতিষ্ঠান থেকে ইসহাক বাকিতে বিভিন্ন পণ্য ক্রয় করে ও বিভিন্ন ব্যক্তির কাছ থেকে চাকরি দেয়ার প্রলোভন দেখিয়ে প্রায় ৮ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। এরমধ্যে গ্রামীণ ফোনের ২ কোটি ২৯ লাখ টাকা, এসবিটেল এন্টারপ্রাইজ ও সিলভার ওয়াটার টেকনোলজির মোবাইল ফোন বাবদ ৮৫ লাখ ৫৫ হাজার ৯০০ টাকা, মোহাম্মদ ট্রেডিং এর টাইলসের ১২ লাখ ৪৫ হাজার ৭৭০ টাকা, হাতিল ফার্নিচারের ৫৭ লাখ ৭৫ হাজার ৩১৯ টাকা, বর্ণমালা এডের ২ লাখ টাকা, ইজি ইন্টিরিওর ডিজাইনের ৮ লাখ ২০ হাজার টাকা, নূর ইলেকট্রনিকের ১৬ লাখ ৬৮ হাজার টাকা, বে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ৩ লাখ ৬৬ হাজার ৫০০ টাকা, আইটি কেয়ারের ২৯ লাখ ৩১ হাজার টাকা, লামিয়া ইলেকট্রনিকের ৩৬ লাখ ৮৫ হাজার, ওমেগা ব্যান্ড ম্যানেজমেন্ট সার্ভিসের ৭ লাখ ৫১ হাজার ১২০ টাকা, টেক উইন্ডো বিডির ১ লাখ ৬৫ হাজার টাকা, চাকরিপ্রার্থী মীর মোহাম্মদ শাহজানের ৩ লাখ টাকা, আফতাব কার্পেটের ৫ লাখ ৪৭ হাজার টাকা, টেকনো হেভেন এসোসিয়েটের ৪ লাখ ৭ হাজার টাকা, নুরান প্রিন্টিংয়ের ১ লাখ ১০ হাজার ৮০০ টাকা, ১টি আইটি ফার্মের ২ লাখ টাকা, বিজনেস মেশিন ও ইকুপমেন্টের ৭৯ লাখ ৩৭ হাজার ৭০০ টাকা, ত্রি স্টার লাইটিং সল্যুউশনের ৩ লাখ ১৮ হাজার ৫৬০ টাকা, আনিস রিফ্রিরাজেশনের ৪ লাখ ৪৪ হাজার টাকা, সাইদুল ইসলাম নামের এক ব্যবসায়ীর ১০ লাখ টাকা, এসএম রাজিব নামের সংবাদকর্মীর ২ লাখ ৬৫ হাজার টাকা, নিপ্‌পন পেইন্ট বাংলাদেশের ১ লাখ ৪৮ হাজার ১১৪ টাকা, এসআর আব্রেলার ৫ লাখ ৬৩ হাজার, কম্পিউটার ওয়ার্ল্ডের ১৬ লাখ ৫০ হাজার ৩২০ টাকা, অসিম এন্টারপ্রাইজের ৬৫ লাখ টাকা, চেয়ার লাইনের ৪ লাখ টাকা, নূর এলুমিনিয়ামের ৯ লাখ ৭৬ হাজার ৩৩৮ টাকা, গ্রেট টেকনোলজির ২ লাখ ৮২ হাজার টাকা, ফ্যাশন পাওয়ার সাপ্লাইয়ের ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা, কার রেন্টালের ৩ লাখ ২৯ হাজার, বার্জার পেইন্ট বিডির ৬৮ হাজার ৮০০ টাকা, আরএফএলের ৪০ লাখ ২১ হাজার ৫৯০ টাকা, আস্থা ইলেকট্রো কোম্পানির ২৪ লাখ ৩২ হাজার, বিডি ফুড লিমিটেডের ২২ লাখ ২৮ হাজার, এন্টিওক বাংলাদেশের ১২ লাখ ১০ হাজারসহ আরও অনেক কোম্পানির টাকা আত্মসাত করেছেন।

ইসহাক ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে মতিঝিল থানায় গ্রামীণ ফোনের মার্কেটিং ডিভিশনের করা মামলা সূত্রে জানা যায়, আবেদনের ভিত্তিতে ইসহাকের মতিঝিলের পত্রিকা অফিসে ২ হাজার ৮০০টি পোস্টপেইড সিমকার্ড ও ২ কোটি ২৯ লাখ টাকা মূল্যের ১ হাজার ৪২৩টি মোবাইল হ্যান্ডসেট সরবরাহ করা হয়। সরবরাহ করা এসব সিমকার্ড ও হ্যান্ডসেটের বিপরীতে ১ লাখ ৪০ হাজার টাকার একটি চেক ও ২ কোটি ২৮ লাখ ১৭ হাজার ৬৭০ টাকার একাধিক চেক দেয়া হয়। এসব চেক ব্যাংকে জমা দিলে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ জানায় অ্যাকাউন্টে কোনো টাকা নেই।
আরএফএলের সেন্ট্রাল প্রডাকশন ডিপার্টমেন্টের ডেপুটি ম্যানেজার আশিস সরকার মানবজমিনকে বলেন, চেতনা হেলথ কেয়ার অ্যান্ড ডেভেলপার নামের একটি প্রতিষ্ঠানের জন্য এয়ারকন্ডিশনার, এলইডি টেলিভিশনসহ প্রায় ৪০ লাখ ২১ হাজার ৫৯০ টাকার পণ্য আমাদের কাছ থেকে নিয়ে যায়। এসব পণ্যের মূল্যের বিপরীতে আমাদের দুই মাসের বেশি সময় মেয়াদ দিয়ে ১৫টি চেক দেয়। সময়মতো আমরা ব্যাংকে গিয়ে চেক সাবমিট করলে ব্যাংক জানায় অ্যাকাউন্টে কোনো টাকা নাই। ওদিকে গুলশানের অফিসে গিয়ে ইসহাক বা অফিসের কাউকে পাওয়া যায়নি। পরে আমরা বাড্ডা থানায় মামলা করি। মামলার তদন্ত করছে সিআইডি।

আস্থা ইলেকট্রো কোম্পানির মালিক আবু ইউসুফ মিয়াজি বলেন, ২০১৯ সালে গুলশানে চেতনা হেলথ কেয়ার অ্যান্ড ডেভেলপার নামক প্রতিষ্ঠানের জন্য ৩৮টি এয়ারকন্ডিশনার নিয়েছিল। আমাকে নগদ টাকা না দিয়ে চেক দিয়েছিল। প্রথমে একটি ব্যাংকের চেক দেয়ার পর দুবার ডিজঅনার হয়। পরে পূবালী ব্যাংকের আরেকটি চেক দেয়। সেই চেকটিও ডিজঅনার হয়। এর ভেতরেই সে লাপাত্তা হয়ে যায়। কোথাও তার সন্ধান পাইনি। পরে আমি গুলশান থানায় জিডি করেছি।

বিজনেস মেশিন অ্যান্ড ইকুপমেন্টের মালিক শামসুল হুদা রাসেল বলেন, ২০১৯ সালে ইসহাকের গুলশানের অফিসের জন্য কম্পিউটার, প্রিন্টার, ল্যাপটপ, ফটোকপি মেশিন দিয়েছিলাম। আমরা সব সময় কর্পোরেট চুক্তি করি। সেই হিসেবে তার কোটেশনের ভিত্তিতে ৭৯ লাখ ৩৭ হাজার ৭০০ টাকার পণ্য দেই। পণ্য নেয়ার পর পুরো পেমেন্ট উল্লেখ করে রুপালী ব্যাংকের এক চেকেই দিয়েছিল। কিন্তু কোনো টাকা উঠাতে পারিনি। কারণ ওই অ্যাকাউন্টে কোনো টাকা ছিল না। তার কোনো সন্ধান না পেয়ে কোর্টে মামলা করেছিলাম।

২০১৯ সালের ২৪শে অক্টোবর ইসহাক বাংলাদেশ সেফ ট্রানজিট সিস্টেম-বিএসটিএল লিমিটেড নামক কোম্পানিতে ১ হাজার ৬৮২টি পদে জনবল নিয়োগের জন্য পত্রিকায় একটি বিজ্ঞাপন দেন। জয়েন্টস্টক থেকে রেজিস্ট্রেশনের জন্য ওই কোম্পানিতে মালিক হিসাবে সাতজনকে রাখা হয়। এসব মালিককরা নিজেরাই জানতো না প্রতিষ্ঠানটির মালিক তারা। বিভিন্ন সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে পণ্য নেয়ার নাম করে তাদের কাছ থেকে কৌশলে ভ্যাট, এনআইডি ও টিন সার্টিফিকেট নিয়ে তাদের স্বাক্ষর জালিয়াতি করে বিএসটিএল নামের ওই কোম্পানির অনুমোদন নেন। যারা বিভিন্ন পণ্য সরবরাহ করেছিল টাকা না দিয়ে উল্টো বিভিন্ন মামলায় তাদেরকে ফাঁসিয়ে দিয়েছে ইসহাক। এদের অনেকেই এখন মিথ্যা মামলায় জেরবার।

এ রকম এক ভুক্তভোগী আনোয়ার হোসেন মিঠু। তিনি ২০ বছর ধরে আইটি ব্যবসা করছেন। তিনি বলেন, ওয়েবসাইট, সফটওয়ার ও পিএবিএক্স কাজের জন্য আমাকে ইসহাক উত্তরার হোসেন টাওয়ারে নিয়ে যান। সেখানে গিয়ে আমি তার অফিস দেখে অবাক হয়ে যাই। বিশাল অফিস। বেশ চাকচিক্য। এসব দেখে তাকে বিশ্বাস করি। অফার লেটার পেয়ে দেড় লাখ টাকার কাজ করে তার কাছে পেমেন্ট চাই। কিন্তু পেমেন্ট না দিয়ে সে আমাকে বলে এটি লিমিটেড কোম্পানি। কিছু নিয়মকানুন আছে। এজন্য ছবি, ভ্যাট, এনআইডি, টিন জমা দিতে হবে। সেই অনুযায়ী আমি সবকিছু দেই। তারপরেও আমার টাকা দিচ্ছিল না। এভাবে কয়েকমাস ঘোরার পর ডিসেম্বরের দিকে তার সঙ্গে আমার ঝগড়া বাধে। কথাবার্তার একপর্যায়ে আমাকে নানা রকম থ্রেট করে। কিন্তু আমি তাকে বলি আমার টাকা দিলেতো আর কোনো সমস্যা থাকেনা। তখন ইসহাক বলে আপনাকে কিসের টাকা দিবো। উল্টো আপনিই আমাকে দুই মাস কাজ করিয়ে বেতন দিচ্ছেন না। আপনি এই প্রতিষ্ঠানের মালিক। আমি আপনার বিরুদ্ধে মামলা করবো। তখন আমি তাকে বলি মালিক কীভাবে হলাম। তখন ইসহাক বলে জয়েন্ট স্টকে আপনার নাম আছে। পরে জয়েন্টস্টকের কাগজপত্রে আমিসহ আরও ৭ জনের নাম দেখতে পাই। প্রত্যেকের স্বাক্ষর জালিয়াতি করে কাগজপত্র দিয়ে জয়েনস্টকে জমা দিয়েছে। ওই সময় আমি উত্তরা পশ্চিম থানায় জিডি করেছি। ২০২০ সালে আমি একটি লিগ্যাল নোটিশ পাই। আমি নাকি কয়েক মাসের বাড়ি ভাড়া দেইনি। একটা চেক দিয়েছি ওই অ্যাকাউন্টে টাকা পাওয়া যাচ্ছে না। আমি ওই নোটিশের উত্তরও দিয়েছিলাম। এর কয়েকমাস পরে খোঁজ নিয়ে জানতে পারি আমার নামে মামলা হয়েছে।

এদিকে বিভিন্ন রেন্ট-এ কার মালিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ইসহাক তার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের জন্য ভাড়ায় গাড়ি নিয়ে অন্যের কাছে বিক্রি করে দিতো। গত কয়েক বছরে ইসহাক অন্তত অর্ধশতাধিক গাড়ি ভাড়া নিয়ে মালিকদের সঙ্গে প্রতারণা করেছে। ভাড়ায় গাড়ি নিলেও প্রথম মাসের ভাড়া দেয়ার পর আর কোনো ভাড়া দিতো না। মাসের পর মাস ভাড়া আটকে দিতো। কিছুদিন পর যে প্রতিষ্ঠানের নামে ভাড়া নিতো সেটি বন্ধ করে দিয়ে লাপাত্তা হয়ে যেতো।

নিসা কার এজেন্সির মালিক এ বি এম ফাত্তাহ বলেন, ইসহাকের সঙ্গে চুক্তি করে মাসিক ৩০ হাজার টাকার বিনিময়ে একটি গাড়ি ভাড়া দেই। ইসহাক চেকের মাধ্যমে ১ মাসের অ্যাডভান্সড ভাড়া দেন। এছাড়া যে মাসে ভাড়া দিয়েছি ওই মাসের ১৮ দিনেরও ভাড়া পেয়েছি। এভাবে পরবর্তী দুই মাসে ৩টি করে আরও ৬টি গাড়ি ভাড়া দেই। সবমিলিয়ে তার কাছে আমার গাড়ি ছিল ৭টি। কিন্তু প্রথম মাসের ভাড়া ছাড়া আর কোনো টাকা আমি পাইনি। সবমিলিয়ে আমি প্রায় ১৬ লাখ টাকা ভাড়া পাই। একদিকে মাসের পর মাস ভাড়া পাচ্ছিলাম না অন্যদিকে আমার গাড়িগুলো অন্যত্র বিক্রি করে দেয়ার পাঁয়তারা করেছিল। কিছু গাড়ি বিক্রি করে দিয়েছিল। ২৪শে ফেব্রুয়ারি আমার একটি গাড়ি বিক্রি করতে এসে তেজগাঁও থানা পুলিশের কাছে গ্রেপ্তার হয়েছে ইসহাক। তেজগাঁও থানায় আমার ৩টি গাড়ি পড়ে আছে। আইনি প্রক্রিয়া শেষ করে সেগুলো আমার হেফাজতে আনতে হবে। তিনি বলেন, ইসহাক শুধু আমার সঙ্গেই প্রতারণা করেনি। শত শত ব্যবসায়ী ও মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করেছে। সময় যত যাচ্ছে ভুক্তভোগী পাওনাদারদের সংখ্যা বাড়ছে। ৬ মাস পর পর সে নতুন নতুন প্রতারণার ফাঁদ খোলে।

২০১৩ সালে ইসহাকের দ্বারা ৪৪ জন ব্যক্তি প্রতারিত হয়েছিলেন। প্রতারিতরা গণস্বাক্ষর করে সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে জমা দিয়েছিলেন। এই অভিযোগের ভিত্তিতে অভিযান চালিয়ে সিআইডি ২০১৪ সালে তাকে গ্রেপ্তার করে। শুধু তাই নয় ২০০৬ সালে ময়মনসিংহের মুক্তাগাছায় একটি এনজিও প্রতিষ্ঠানের নামে ইসহাক অর্ধশতাধিক গরিব ও অসহায় মানুষকে সেলাই মেশিন ও অন্যান্য সুবিধা দেয়ার কথা বলে প্রত্যেকের কাছ থেকে বিভিন্ন অংকের কয়েক লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়। এছাড়া বিভিন্ন পত্রিকা অফিস খুলে সাংবাদিক নিয়োগ ও সাংবাদিকদের গাড়ি এবং মোটরসাইকেল দেয়ার নাম করে জামানত হিসেবে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে যায়। যাদেরকে এসব গাড়ি দেয়া হয়েছে সেগুলো রেন্ট-এ কারের কাছ থেকে ভাড়ায় আনা গাড়ি ছিল। ভুক্তভোগী সাংবাদিকরা জানিয়েছেন, তাদেরকে জেলা প্রতিনিধি, ব্যুরো অফিস ও গাড়ি দেয়ার কথা বলে টাকা নিয়েছে।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা বলেছেন, প্রতারণার মাস্টার ইসহাকের মূল অস্ত্র ছিল অত্যাধুনিক অফিস সেটআপ। অফিস দেখিয়েই মূলত মানুষকে বোকা বানাতো। সে কাউকেই নগদ টাকা দিতো না। ভুয়া চেক দিতো লম্বা তারিখ লিখে। উচ্চ বেতনে চাকরি দেয়ার নাম করে লাখ লাখ টাকা জামানত নিতো। বিভিন্ন ব্যক্তিদের স্বাক্ষর জাল করার দক্ষতাও ছিল। কোনো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করতে হলে নিজে নিজেই চুক্তি করতো। পক্ষ-বিপক্ষ কাউকে রাখতো না। ভুয়া ডকুমেন্ট তৈরি করার দক্ষতাও ছিল তার। এছাড়া অফিস উদ্বোধনসহ বিভিন্ন কার্যক্রমে সমাজের নামিদামী ব্যক্তিদের হাইলাইটস করতো।

পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)-এর পরিদর্শক সালাউদ্দিন করিম মানবজমিনকে বলেন, ভুক্তভোগীদের করা ২টি মামলার তদন্ত করছে সিআইডি। বেশ কয়েক বছর আগে আরেকটা মামলার তদন্ত করে তার বিরুদ্ধে চার্জশিটও জমা দেয়া হয়েছে। এছাড়া পিবিআই, পুলিশ ও সিআইডি তদন্ত করছে এ রকম ১৫টি মামলার তথ্য আমরা পেয়েছি। তিনি বলেন, গুলশানের তাহের টাওয়ারে সাড়ে ৬ হাজার স্কয়ার ফুটের অফিস ভাড়া নেয়ার সময় নগদ টাকা না দিয়ে ব্যাংকের চেক দিয়ে ভাড়া নেয়। তারপর ডেকোরেশনের জন্য আরএফএল থেকে এসি, হাতিল থেকে ফার্নিচার, ওই ভবনের দ্বিতীয় তলা থেকে ৯০ লাখ টাকার ল্যাপটপ, অফিস উদ্বোধনের দিন গুলশানের প্রিমিয়াম সুইটস থেকে ২ লাখ ৯৫ হাজার টাকার মিষ্টি নিয়ে টাকা দেয়নি। একেবারে বিনা পুঁজিতে বাকিতে পণ্য এনে প্রতারণা করতো। এটি প্রতারণার একটি নতুন ডাইমেনশন। উত্তরায় একটি প্রতিষ্ঠান থেকে জেনারেটর এনে বিক্রি করে দিয়েছিল। তিনি বলেন, তার কাজই হচ্ছে ভিআইপি এলাকায় অফিস নিয়ে অত্যাধুনিক ডেকোরেশন করা। তারপর অফিসে যত সরঞ্জামাদি লাগে সবকিছু বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে বাকিতে নিতো। সব প্রতিষ্ঠানকেই চেক দিতো। লালমাটিয়ায় একটা প্রতিষ্ঠান করে বহু ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে ঠকিয়েছে। বসুন্ধরায় পুরো একটি ভবন নিয়ে একটি পত্রিকা অফিস খুলে সাংবাদিকদের গাড়ি ও প্রতিনিধি করার কথা বলে লাখ লাখ টাকা নিয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *