নেত্রকোনা: ঘন সবুজ গারো পাহাড়ের বুক চিরে অবিরাম বয়ে চলা স্বচ্ছ পানি আর অপরূপ প্রাকৃতিক নৈসর্গিক মনোমুগ্ধকর পরিবেশ প্রথম দেখাতেই যে কেউ বিমোহিত হতে পারেন। পাশের সুসং দুর্গাপুরের বিরিশিরির সাদা পাহাড় ও সুমেশ^রী নদীর টলমলে স্বচ্ছ পানি দেখে ভ্রমণপিপাসুরা মুগ্ধ হলেও মন হরণ করা এমন স্নিগ্ধ নয়নাভিরাম কোলাহলমুক্ত জায়গাটি আজো অনেকের কাছে অজানা। অদূর ভবিষ্যতে ভ্রমণপিপাসুদের কাছে এ জায়গাটি হতে পারে একটি উত্তম বিনোদন কেন্দ্র। এটির অবস্থান নেত্রকোনার সীমান্তবর্তী উপজেলা কলমাকান্দার রংছাতি ইউনিয়নের পাঁচগাঁও ও লেঙ্গুরার সাত শহীদ মাজার এলাকা।
ঢাকা থেকে যেতে হলে দু’ভাবেই যাওয়া যায় ট্রেন অথবা বাসে। ট্রেনে যেতে চাইলে কমলাপুর অথবা বিমানবন্দর রেলস্টেশন থেকে মোহনগঞ্জগামী মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস অথবা হাওর এক্সপ্রেস ট্রেনে যাওয়া যাবে। সোমবার ছাড়া প্রতিদিন বেলা ১.৪৫ মিনিটের সময় ছেড়ে যায় মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস। ময়মনসিংহ হয়ে নেত্রকোনায় পৌঁছায় সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায়। এখান থেকে বাস, সিএনজি কিংবা মোটর সাইকেলেও কলমাকান্দা যাওয়া যায়। আর যদি রিজার্ভ নেয়া যায়। তবে সরাসরি পাঁচগাঁও কিংবা লেঙ্গুরায় যাওয়া যাবে। নেত্রকোনা থেকে কলমাকান্দার দূরত্ব ৩২ কিলোমিটার আর সেখান থেকে পাঁচগাঁও সীমান্তের দূরত্ব আরো ১২ কিলোমিটার। এছাড়া কলমাকান্দা সদর থেকে সীমান্তের লেঙ্গুরা কালিকাপুর সাত শহীদের মাজারের দূরত্ব ২২ কিলোমিটার। আর বুধবার ছাড়া প্রতিদিন রাত সাড়ে ১০টায় কমলাপুর স্টেশন থেকে ছেড়ে যায় হাওর এক্সপ্রেস।
এছাড়া মহাখালী বাসটার্মিনাল থেকেও গেইটলক বাসে করে নেত্রকোনা এবং কলমাকান্দায় যাওয়া যায়। সরাসরি পাঁচগাঁও যেতে হলে সেখানেও কয়েকটি গেইটলক বাস পাওয়া যাবে। আর ময়মনসিংহ থেকে যেতে চাইলে শম্ভুগঞ্জ ব্রিজের মাথায় পাট গুদাম মোড়সংলগ্ন বাস টার্মিনালে নেত্রকোনা ও কলমাকান্দাগামী বাস, সিএনজি যে কোনো একটিতে চড়লেই যাওয়া যাবে।
কলমাকান্দা হয়ে পাঁচগাঁও সীমান্তের দিকে এগোতেই উত্তরের দৃষ্টিসীমানায় দেখা যাবে মন হরণ করা নীলাভ পাহাড় আর পাহাড়। মুহূর্তে পথের সব ক্লান্তি দূর হয়ে প্রশান্তি বয়ে যাবে। ভারতের মেঘালয় রাজ্যের এই পাহাড় দুই দেশের সীমানাকে করে রেখেছে বিভক্ত। সৌন্দর্য উপভোগ আর বুকভরা বিশুদ্ধ নিশ^াস নেয়ার জন্য এটি একটি আদর্শ জায়গা। অনেক ঝক্কি-ঝামেলা পেরিয়ে এখানে পৌঁছার পর মুহূ র্তে যে কারো মন সহজেই প্রফুল্ল হয়ে উঠতে পারে। দ্রুতই মুছে যায় সব ক্লান্তি ও অবসাদ। সৃষ্টির অপরূপ সৌন্দর্য বিমুগ্ধ নয়নে দিগন্ত প্রসারিত নয়নে আরো দেখা যাবে মানাছড়া পাহাড়ের বিস্তৃত সবুজ প্রকৃতির অকৃত্রিম মনজুড়ানো রূপ। পাহাড়ের ঢালে এই প্রান্তরটিকে দেখে মনে হতে পারে সবুজ গালিচায় মোড়ানো কোলাহলমুক্ত হেলেদুলে পড়া নাম না জানা অজস্র গাছ-গাছালি আপনাকেই স্বাগত জানাচ্ছে। সেখানে ইচ্ছেমতো ঘোরাঘুরি, বিশ্রাম এমনকি রান্না-বান্নাও করা যেতে পারে। এমনকি দুই পাহাড়ের মাঝ দিয়ে বয়ে আসা ছড়ার মধ্যে বিশাল বিশাল পাথরের ওপর দিয়ে হেঁটে হেঁটে গা শিহরণ জাগানো অনুভূতি পাওয়া যায়। আর পাহাড়ের এই স্থান দিয়েই বন্য হাতির পাল বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ঢোকে। তাই ওই স্থানে যথেষ্ট সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত।
রংছাতি ইউনিয়নের পাঁচগাঁওয়ে রয়েছে উপজাতি গারো ও হাজং পল্লী। খুব সুন্দর সাজানো-গোছানো গ্রাম। উপজাতি সম্প্রদায়ের লোকজন খুব সহজ-সরল। এদের অধিকাংশই কৃষি ও শ্রমজীবী। ইচ্ছে করলে উপজাতি পল্লী ঘুরে দেখা যাবে। আরো কিছুদূর অগ্রসর হলে দেখা মিলবে চন্দ্রডিঙ্গা পাহাড়ের। ওই স্থানে যে মন্দির রয়েছে প্রতি বছর সেখানে যে উৎসব হয়ে থাকে তাতে হিন্দু সম্প্রদায়ের নারী-পুরুষ যোগ দিয়ে থাকেন।
এ ছাড়া একই উপজেলার রংছাতির ইউনিয়নের পাশের লেঙ্গুরার কালিকাপুরে গনেশ^রী নদীর তীরে ছায়াশীতল স্থানে রয়েছে সাত শহীদের মাজার। ১৯৭১ সালে এই স্থানে পাক সেনাদের সাথে সম্মূখযুদ্ধে স্বাধীনতাকামী সাত বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। এই স্থানেই তাদের কবরস্থ করা হয়। প্রতিদিন এখানে বহু দর্শনার্থীর আগমন ঘটায় স্থানটি ক্রমে পর্যটন কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে।
পাশেই টহলরত বিএসএফ’দের দেখা মিলবে। আরো দেখা যাবে পাহাড়ের উপর ওদের ক্যাম্প। এখানে তাই বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। পাহাড় থেকে নেমে আসা গনেশ^রী নদীতে বয়ে চলা বরফঠান্ডা পানি থেকে শ্রমজীবী নারী-পুরুষদের কয়লা ও নূড়ি পাথর উত্তোলনের দৃশ্য দেখা যাবে।
সাত শহীদ মাজারের অদূরে কালিকাপুর বাজারসংলগ্ন পাহাড়সম যে টিলা রয়েছে, সেখানে উঠলে দেখা যাবে ইউ টার্ন নদী ও দিগন্ত প্রসারিত অপরূপ প্রাকৃতিক দৃশ্য, যা অবলোকনে মন-প্রাণ জুড়িয়ে প্রশান্তি এনে দেবে। নগরজীবনের ব্যস্ততা ও একঘেয়েমি দূর করতে এই স্থানটি এখন ভ্রমণকারীদের কাছে আকর্ষণীয় স্থানে পরিণত হয়েছে। নেত্রকোনার সীমান্তের এই এলাকায় যা রয়েছে তার সবই প্রাকৃতিকভাবে গড়ে ওঠা। যদি এসব স্থান কে পর্যটনের আওতাভুক্ত করে গড়ে তোলা যায় তবে এটি হতে পারে দেশের অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র। এতে অসংখ্য দেশি-বিদেশি ভ্রমণপিপাসুদের আগমন ঘটতে পারে। যোগাযোগ ব্যবস্থার খুব একটা উন্নতি না হওয়ায় কষ্টকর যাওয়া-আসার কারণে অনেকেই ক্লান্ত হয়ে পড়েন। খাবার-দাবারেরও তেমন কোনো সুব্যবস্থা নেই। কাজেই সেখানে যাওয়ার আগে-ভাগেই সাথে পছন্দসই শুকনো খাবার ও পানীয় নিয়ে নিতে হবে।
ফেরার পথে পাঁচগাঁও অথবা কলমাকান্দা বাজারে দুপুরের খাবার সেরে নেয়া যাবে। এবার ফেরার পালা। রিজার্ভ কোনো গাড়িতে আসলে সেভাবেই ফিরে যাওয়া যাবে। নইলে পাঁচগাঁও নতুন বাজার থেকে ইজিবাইক অথবা মোটর সাইকেলে কলমাকান্দা থেকে বাস, সিএনজিতে দেয়া যাবে। সরাসরি ময়মনসিংহ কিংবা ঢাকা যেতে চাইলে পাঁচগাঁও পূরাতন বাজার থেকে প্রতিদিন রাত ৮টায় ঢাকার উদ্দেশ্যে গেটলক বাস ছেড়ে যায়। ভ্রমণপিপাসুদের অবসর জীবনের মধুময় স্মৃতিমন্থনের প্রেরণা হয়ে উঠতে পারে কলমাকান্দার সীমান্তের মেঘালয় রাজ্যের পাদদেশের এই ভ্রমণ।
ঢাকার উত্তরা থেকে বেড়াতে আসা চৈতী গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের জিএম শহিদুল ইসলাম সোভন বলেন, ‘ভালো লাগার মতো এত চমৎকার নয়নাভিরাম জায়গা যে এখানে রয়েছে, না এলে বিশ^াসই করতে পারতাম না।
কলমাকান্দা উপজেলার বিদায়ী নির্বাহী কর্মকর্তা সোহেল রানা বলেন, সীমান্তের এই উপজেলায় যে কয়টি মনোরম স্পট রয়েছে, তা পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা গেলে এই স্থানটি দেশের অন্যতম বিনোদন কেন্দ্রে পরিণত হওয়ার উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে।