অরক্ষিত রেলগেটে যানজট দুর্ঘটনা

Slider জাতীয়

রাজধানীর বিমানবন্দর রেলস্টেশনের পাশেই আশকোনা হজ ক্যাম্প রেলক্রসিং। ট্রেন চলাচলের জন্য প্রতিদিন এই রেলক্রসিংয়ে ১১৪ বার প্রতিবন্ধক বার ফেলে বন্ধ করা হয় গাড়ি চলাচল। গড়ে প্রতিবার ৩ মিনিট করে বন্ধ রাখলে এই ক্রসিংয়েই দিনে যানবাহন বন্ধ থাকে ৫ ঘণ্টা ৪২ মিনিট। কখনো তা ৭-৮ ঘণ্টায় গিয়ে দাঁড়ায়। ফল হিসেবে রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ বিমানবন্দর সড়কে গাড়ির জটলা কখনো কখনো জসিমউদ্দিন ছাড়িয়ে আজমপুর পর্যন্ত পৌঁছে যায়। একইভাবে পুরো রাজধানীতে যানজট বাড়াচ্ছে অর্ধশতাধিক বৈধ-অবৈধ রেলক্রসিং। সেই সঙ্গে একের পর এক দুর্ঘটনার কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে রেলক্রসিংগুলো। ঘটছে প্রাণহানি।

গত রবিবারও নারায়ণগঞ্জে একটি রেলক্রসিংয়ে বাস-ট্রেন সংঘর্ষে চারজনের প্রাণহানি হয়েছে। রেলওয়ের তথ্যমতে, গত সাত বছরে কেবল রেলক্রসিংয়ে ট্রেনের সঙ্গে অন্য যানবাহনের ১৩২টি দুর্ঘটনায় অন্তত ১৪৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। ট্রেন দুর্ঘটনার ৮৯ শতাংশই ঘটেছে অরক্ষিত লেভেল ক্রসিংয়ে। সূত্রমতে, সারা দেশে দুই হাজার ৮৫৬ রেলক্রসিং রয়েছে, যার ১ হাজার ৩৬১টিরই নেই অনুমোদন। আবার ১ হাজার ৪৯৫টি যে বৈধ ক্রসিং তার ৬৩২টিতে নেই গেটম্যান। এদিকে, সিডিউল অনুযায়ী অধিকাংশ ট্রেন ঢাকায় ঢুকছে ও ঢাকা থেকে বের হচ্ছে সকালে ও সন্ধ্যায়, যা অফিস শুরু ও ছুটির সময়। এই সময়ে একদিকে সড়কে গাড়ি বাড়ছে, অন্যদিকে রেলক্রসিংয়ে বারবার প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিতে যানজট তীব্র হচ্ছে। গতকাল সরেজমিন রাজধানীর বিমানবন্দর রেলস্টেশনের পাশে আশকোনা হজ ক্যাম্প রেলক্রসিংয়ে দেখা যায়, মাত্র ৩৪ মিনিটে চারবার প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির কারণে রেলক্রসিংয়ে ১৬ মিনিট আটকে থাকে সড়কের গাড়ি। যার প্রভাব পড়ে মূল সড়কে। যানজট ছাড়িয়ে যায় বিমানবন্দর থেকে আজমপুর পর্যন্ত। দুপুর ১টা ২৮ মিনিটে রেলক্রসিংটি অতিক্রম করে কমলাপুরের দিকে চলে যায় আন্তঃনগর সিল্কসিটি ট্রেন। এ জন্য প্রতিবন্ধক বার ফেলে দুই মিনিট বন্ধ রাখা হয় রেলক্রসিং। ১টা ৩৭ মিনিটে রেলস্টেশনে এসে থামে বিআর-৩০০২ নম্বরের একটি কার্গোবাহী ট্রেন। ১টা ৩৮ মিনিটে রেলগেটটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। খুলে দেওয়া হয় ১ টা ৪৭ মিনিটে কমলাপুর থেকে ছেড়ে আসা আন্তনগর মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস অতিক্রম করার পর। ঢাকামুখী আন্তনগর হাওর এক্সপ্রেস আসায় ৫ মিনিটের মাথায় আবারও রেলক্রসিং বন্ধ করে ৩ মিনিট পর খুলে দেওয়া হয়। ২টা ২ মিনিটে বনলতা এক্সপ্রেস এলে আবারও রেলক্রসিংয়ে আটকে পড়ে গাড়ি। বিমানবন্দর রেলস্টেশনের স্টেশন মাস্টার মো. হালিমুজ্জামান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, প্রতিদিন ৭২টি আন্তনগর ট্রেন, ২৬টি মেইল ট্রেন ও ১৬টি মালবাহী ট্রেন এই রুট দিয়ে আসা-যাওয়া করে। মাঝেমধ্যে সিডিউল ছাড়াও মালবাহী ট্রেন চলে। সকাল ৭টা থেকে দুপুর ১২টা এবং বিকাল ৫টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত সর্বাধিক ট্রেন চলাচল করে। জানা গেছে, রাজধানীসহ আশপাশের ৩৫ কিলোমিটার রেলপথে রেলক্রসিং রয়েছে ৫৮টি। এর মধ্যে ২৩টি অরক্ষিত ও অননুমোদিত। প্রতিটি রেলক্রসিংয়ে ৫ ঘণ্টা ৪২ মিনিট করে গাড়ি আটকে থাকলে সব রেলক্রসিংয়ে দৈনিক যানবাহন আটকে থাকছে ৩৩০ ঘণ্টা ৩৬ মিনিট, যা প্রায় ১৪ দিনের সমান। রেলক্রসিংয়ে আটকে পড়া গাড়ির এই চাপ গিয়ে পড়ছে মূল সড়কে। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (ট্রাফিক উত্তর) আবু রায়হান বলেন, রেলক্রসিং কমলে ঢাকায় যানজট কমবে। শুধু আশকোনা রেলক্রসিংয়ের কারণে বিমানবন্দর এলাকায় গাড়ির চাপ সামলাতে আমাদের হিমশিম খেতে হয়। এই সড়কে দুই মিনিট গাড়ি বন্ধ হলে অন্তত ৩ কিলোমিটার যানজট সৃষ্টি হয়ে যায়। রেলক্রসিং সমস্যার সমাধান প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ও পরিবহন বিশেষজ্ঞ ড. শামসুল হক বলেন, ট্রেন আর সড়কের যানবাহন যতদিন পাশাপাশি চলবে, এই সমস্যা যাবে না। জাপানের টোকিওতে ২ কোটি মানুষের বাস। তবুও সেখানে ৩৫০ কিলোমিটার গতিতে ট্রেন চলে। সেখানে তিন স্তরবিশিষ্ট পরিবহন ব্যবস্থা। দুর্ঘটনা এড়াতে ঢাকায় ট্রেন চলে মাত্র ৩০ কিলোমিটার গতিতে। আমাদেরকে অন্তত দুই স্তরবিশিষ্ট সড়ক ব্যবস্থা করতে হবে। সড়ক থাকবে নিচে, মাথার ওপর দিয়ে চলবে মেট্রোরেল। দূরপাল্লার ট্রেন থাকবে ঢাকার বাইরে। সেখান থেকে মেট্রোরেল বা কমিউটার ট্রেনে মানুষ শহরে ঢুকবে বা চলাচল করবে। রেলক্রসিংয়ে ওভারব্রিজ বা আন্ডারপাস করে সমাধান করা যেত। স্থাপনা গড়ে ওঠায় সেটা এখন কঠিন। তিনি বলেন, মেট্রোরেল আমাদের জন্য সুখবর। তবে এটা রেলওয়েকে বাস্তবায়ন করতে দিলে তারা রেলের সঙ্গে সমন্বয় করে পরিকল্পনা করতে পারত। আলাদা ডিপার্টমেন্ট তৈরির কারণে সমন্বয়ে সমস্যা দেখা দিতে পারে। রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, ঢাকা ছাড়াও চট্টগ্রামের মেইন লাইনসহ শহর এলাকার মধ্যে চট্টগ্রাম-ভাটিয়ারি, চট্টগ্রাম-ফতেয়াবাদ জংশন পর্যন্ত ৫৫টি, রাজশাহী নগরীতে সাতটির ওপরে রেলক্রসিং রয়েছে। নগরীর বাইরেও রয়েছে শত শত রেলক্রসিং। রেলপথ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, অবৈধ ক্রসিংয়ের বেশির ভাগই তৈরি হয়েছে এলজিইডি, পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদ, সিটি করপোরেশন এবং সড়ক ও জনপথ বিভাগের রাস্তার কারণে। রেলওয়ের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (এডিজি-অপারেশন) সরদার শাহাদাত আলী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, রেলওয়েতে একাধিক উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ চলমান। এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে। রেলক্রসিংগুলো নিয়েও দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা কাজ করছেন। অবৈধ লেভেল ক্রসিং বন্ধ করাসহ ক্রসিং ঘিরে নানা উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। সূত্র জানায়, সম্প্রতি আন্তমন্ত্রণালয়ের একটি সভায় ঝুঁকিপূর্ণ অবৈধ ক্রসিংয়ের অবস্থান নিয়ে একটি প্রতিবেদনে গত ১৩ বছরে রেল দুর্ঘটনায় ২৯৮ জনের মৃত্যুর কথা বলা হয়েছে। সভায় ঝুঁকিপূর্ণ ক্রসিংগুলোর দুই পাশে (সড়কে) দ্রুত সময়ের মধ্যে স্পিড ব্রেকার স্থাপন, আন্ডারপাস কিংবা ওভারপাস নির্মাণ, রেলক্রসিং কমানোসহ কিছু নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। পূর্বাঞ্চল রেলওয়ের প্রধান প্রকৌশলী সুবক্তগীন বলেন, পূর্বাঞ্চল রেলে মোট ১ হাজার ৩৭৭টি রেলক্রসিংয়ের মধ্যে ৮১১টির ওপরে অবৈধ। পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের পরিবহন বিভাগের কর্মকর্তা আবদুল আওয়াল বলেন, পশ্চিমাঞ্চলে মোট ১ হাজার ২২৫টি রেলক্রসিংয়ের মধ্যে প্রায় ২২২টির ওপরে অবৈধ রয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *