সরিষাবাড়ী (জামালপুর): ছোটবেলা থেকেই মেধাবী ছিলেন মুরাদ হাসান। তবে বাবার পরিচয়ে ঘুরতেন সদর্পে। তার বাবা এডভোকেট মতিয়র রহমান তালুকদার ছিলেন প্রভাবশালী নেতা। ’৭৫-পরবর্তী আওয়ামী লীগের কোণঠাসা অবস্থায় ধরেছিলেন স্থানীয় আওয়ামী লীগের হাল। জামালপুর জিলা স্কুলের শিক্ষার্থী মুরাদ স্কুল জীবনেই একাধিকবার কলহে জড়িয়েছিলেন। বাবার পরিচয়ের কারণে শিক্ষার্থীদের মাঝে গড়ে তুলেছিলেন আধিপত্য।
এসএসসির পর চলে আসেন ঢাকায়। ঐতিহ্যবাহী নটর ডেম কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন।
এরপর ভর্তি হন ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে। এরপর থেকে বেপরোয়া হয়ে ওঠেন মুরাদ। জড়ান মাদকে। স্থানীয় যুবলীগের একজন সিনিয়র নেতার ভাষ্য, মেডিকেলের কয়েকজন সহপাঠীকে নিয়ে সরিষাবাড়ীতে ঘুরতে এসেছিলেন মুরাদ। নদীর পাড়ে নেশাগ্রস্ত অবস্থায় মাঝিকে মারধর করেছিলেন। খবর পেয়ে তারা মাঝিদের হাত থেকে মুরাদ ও তার বন্ধুদের উদ্ধার করেছিলেন।
তিনি আরও বলেন, এই ঘটনার পরই মতিয়র ভাই জানতে পারেন ছেলে ছাত্রদলে নাম লিখিয়েছেন। মতিয়র ভাই বলতেন, আমার শরীরে আওয়ামী লীগের রক্ত। আমার ছেলে ছাত্রদল করে। এরপর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর বাবার পরিচয় ও নিজের প্রভাবে ছাত্রলীগে নাম লেখান মুরাদ। ওই নেতা বলেন, মুরাদের বাবা ছিলেন মাটির মানুষ, যোগ্য নেতা। কিন্তু মুরাদ আমার থেকে কম করে ১০ বছরের ছোট। আমাকেসহ আমাদের মাঝেমধ্যে তুই করে নাম ধরে ডাকতো।
এলাকায় খুব একটা যাতায়াত ছিল না মুরাদের। ২০০৭ সালে ঘন ঘন এলাকায় আসা শুরু করেন। এরপর নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন নিয়ে এমপি হন। এমপি হওয়ার পর গড়ে তোলেন নিজস্ব ক্যাডার বাহিনী। দলের নেতাকর্মীরা উপেক্ষিত হতে শুরু করেন। পরের নির্বাচনে অবশ্য মুরাদ দলীয় মনোনয়ন পাননি। জাতীয় পার্টির মামুনুর রশীদ এ আসনে এমপি হন। এরপর আবার এলাকায় যোগাযোগ বন্ধ করে দেন। ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে আবার এলাকায় যাওয়া শুরু করেন। নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন নিয়ে জয়ী হওয়ার পর স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পান মুরাদ। প্রতিমন্ত্রী হওয়ার পর ক্ষমতার দাপটে আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠেন।
স্থানীয় আওয়ামী লীগের সিনিয়র সদস্য মো. সুজন। তিনি মুরাদের বিষয়ে বলেন, ‘মতিয়র চাচাকে আমরা খুবই সম্মান করতাম। কিন্তু মুরাদ এলাকায় আসার পর আমরা দেখি মাদকে আসক্ত। এজন্য তার সঙ্গে আমরা মিশতাম না। তার চরিত্রে নানা সমস্যা রয়েছে। সব থেকে বড় বিষয় মন্ত্রী হওয়ার পর নিজের দলের নেতাকর্মীদের অকল্পনীয় নির্যাতন করেছেন। প্রথমবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর সুগঠিত করে ক্যাডার বাহিনী।’
উপজেলা শ্রমিক লীগের একজন নেতা বলেন, নির্বাচনের পরে মুরাদকে সমর্থন না জানানোয় স্টেশনে আক্রমণ করে। রক্তাক্ত অবস্থায় আমাকে উদ্ধার করা হয়। সেখান থেকে ময়মনসিংহে নিয়ে চিকিৎসা করানো হয়। আমার দোষ একটাই- মুরাদকে আমি সমর্থন করিনি।
মুরাদের বাবা এলাকায় পরিচিত হলেও মুরাদ আলোচনায় আসেন ২০০৭ সালে। দলের ভেতরে অভ্যন্তরীণ মনোমালিন্যের সুযোগ নিয়ে হামলা চালান উপজেলা আওয়ামী লীগের পার্টি অফিসে।
সরকারি খামারিদের প্রণোদনা নিয়ে বেশ অসন্তোষ দেখা দিয়েছিল সরিষাবাড়ীতে। আসল খামারিরা অধিকাংশই প্রণোদনা পাননি। স্থানীয় এক ওয়ার্ড কাউন্সিলরের মাধ্যমে মুরাদ গড়ে তোলেন সিন্ডিকেট। সিন্ডিকেটটি নিয়ন্ত্রণ করতো সব।
তাদের হাত থেকে রক্ষা মেলেনি ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আল মামুনেরও। হারিয়েছেন এক চোখ। বিজয় দিবসের আয়োজনের জন্য প্রস্তুতি চলছিল। এ সময় তাদের ওপর হামলা চালানো হয়। এতে এক চোখ হারান তিনি। আহত হন সভাপতিও।
উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি আল আমিন হোসেন শিবলু বলেন, ‘আমাদের তো মামলা-হামলা করা হয়েছেই। তুচ্ছ ঘটনাতেও হামলা করে তারা। আমার জন্মদিনে ফেসবুকে শুভেচ্ছা জানিয়ে স্ট্যাটাস দিয়েছিল শুভাকাঙ্ক্ষীরা। এজন্য পাঁচজনকে মারধর করেছিল মুকুলের ক্যাডার বাহিনী। মুরাদের একটি অনুষ্ঠানে অনুপস্থিত থাকায় আমাদের ২২ মাস পদ থেকে বহিষ্কার করে রাখা হয়।’
মুরাদের নানা অপকর্মের ফিরিস্তি তুলে ধরেন আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের ১০ জন নেতাকর্মী। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বলেন, ২০১৯ ও ২০২০ সালে টিআর, জিআর, কাবিখা প্রকল্প পরিচালিত হয়। এই প্রকল্পগুলোর প্রায় ২ কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়। মুরাদ ও মুকুল করোনা ও বন্যায় সাহায্যের পণ্য ও অর্থে ভাগ বসায়। সাতশ’ টন চাল ও প্রায় অর্ধকোটি টাকা বরাদ্দ মিললেও মুরাদের অনুসারীরা তার বড় অংশ তসরুফ করে। যা নিয়ে তদন্তও করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। চেয়ারম্যান বলেন, অদৃশ্য কারণে একজন সরকারি কর্মকর্তার ওপর দোষ চাপিয়ে বন্ধ হয়ে যায় তদন্ত। কিন্তু আমরা চেয়ারম্যানরা বরাদ্দ পাই ঠিকই, তা গুদাম থেকেই উধাও হয়ে যায়। ১৭ হাজার ৩৩০ জনের ২০২০ সালের বন্যায় সহযোগিতার তালিকা পাঠানো হয়। যা ওই কাউন্সিলরের অফিস থেকে অর্ধেক যায় বলে অভিযোগ মেলে। ছবি তুলে কিছু বিতরণ করলেও বরাদ্দ ছিল ঢের বেশি।
সব থেকে বড় দুর্নীতি হয় যমুনা সার কারখানায়। এই কারখানায় বস্তাপ্রতি দুই টাকা করে দিতে হয় ওই সিন্ডিকেটটিকে। উপজেলার চিহ্নিত প্রায় শতাধিক স্থানে রয়েছে বালু উত্তোলনের অবৈধ ড্রেজার।
সরকারি সাহায্যের ঘর নির্মাণেও দুর্নীতি করেছেন মুরাদ গং। অভিযোগ মেলে, ১৯৫টি ঘর নির্মাণ করে মনোনীত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। যাতে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত ঘুষ নেন মুরাদ গং। যা নির্মিত হয় অত্যন্ত নিম্নমানের সামগ্রী দিয়ে। আবদুল আউয়াল নামে একজন কৃষক বলেন, আমার কাছ থেকে ৬ হাজার টাকা নিছে। আর এলাকার ডিলারও অধিক দামে সার বিক্রি করে। অভিযোগ জানিয়েছিলাম কৃষি অফিসে। মুকুল আমাকে অফিসে ডেকে নিয়ে বলে, আবার অভিযোগ জানাইলে দ্বিগুণ দাম দিলেও সার পাবা না।
উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক উপাধ্যক্ষ হারুন অর রশিদও মুরাদের বিরুদ্ধে বিস্তর অভিযোগ তোলেন। তিনি বলেন, ‘মুরাদের অস্ত্রধারী গুণ্ডাবাহিনীর কাছে জিম্মি ছিল সবাই। ঢাকার তেজগাঁও কলেজের অধ্যক্ষ আবদুর রশিদ সরিষাবাড়ী উপজেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি। ২০১৯ সালে শিমলাবাজারে আত্মীয়ের বাসায় দাওয়াত খেতে গিয়েছিলেন। সেখানে মুকুল ও নিরবের নেতৃত্বে তাকে আটকে রাখা হয়। এরপর আমরা গিয়ে তাকে উদ্ধার করে নিয়ে আসি’।