জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধিতে বহুমুখী প্রভাব অর্থনীতিতে

Slider ফুলজান বিবির বাংলা


কোভিড-১৯ পরিস্থিতির মধ্যেও নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে দফায় দফায়। এখনো ঊর্ধ্বমুখী অনেক পণ্যের দাম। এর মধ্যেই বাড়ানো হয় জ্বালানি তেলের দাম। ১৫ টাকা বেড়ে ডিজেল ও কেরোসিন এক লাফে গিয়ে লিটারে ৮০ টাকায় ঠেকেছে। পাশাপাশি আবারও বেড়েছে তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস (এলপিজি) ও পরিবহনের জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত এলএনজির দাম। এর বহুমুখী প্রভাব পড়েছে অর্থনীতিতে। একে একে বেড়ে যাচ্ছে পরিবহন ভাড়া, বিদ্যুৎ, পানি, বিভিন্ন পণ্য এবং সেবার মূল্য। সব মিলিয়ে রীতিমতো নাভিশ্বাস উঠেছে সীমিত আয়ের মানুষের।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনা ভাইরাসের কারণে বিশ্বের সঙ্গে বাংলাদেশের মানুষের জীবনযাত্রার ওপর ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। বহু লোক কাজ হারিয়েছেন, অনেকের ব্যবসা-বাণিজ্যও বন্ধ হয়ে গেছে। আয় কমে এসেছে একটি বড় অংশের। করোনার সেই বিরূপ প্রভাব কাটিয়ে ওঠার চেষ্টার মধ্যেই জ্বালানি তেলের এ মূল্যবৃদ্ধি সাধারণ মানুষের জীবনযাপনে নেমে আসবে বিপর্যয়। কেননা সরকার একটি পণ্যের দাম বাড়ালেও ভোক্তাকে বহন করতে হয় সংশ্লিষ্ট অনেক পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির ভার।

অর্থবিভাগ সূত্র অবশ্য বলছে, করোনার মহামারীর কারণে সরকারের রাজস্ব আদায় কমে যাওয়ায় বাজেটের বড় ঘাটতির আশঙ্কা করছে সরকার। তাই ভর্তুকি দেওয়া জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয় করে লোকসান ঠেকানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। সেই পরিকল্পনা থেকেই দেশের বাজারে ডিজেল, কেরোসিন, জেট ফুয়েলের দাম বাড়ানো হয়েছে। অবশ্য ডিজেলের দাম বৃদ্ধির বহুমুখী প্রভাব পড়ছে দেশের অর্থনীতিতে। বিশেষ করে এর সরাসরি প্রভাব পড়ছে কৃষি খাতে। সামনের বোরো মৌসুমে কৃষকের উৎপাদন খরচ বাড়বে। একইভাবে বাড়তে পারে কৃষিপণ্যের দামও।

এদিকে রপ্তানি খাতের অবস্থাও খুব একটা ভালো নয়। করোনা মহামারী এ খাতকে এমনিতেই নতুন নতুন চ্যালেঞ্জের মুখে দাঁড় করিয়েছে। আবার ২০২৪ সালের মধ্যে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের কাতারে প্রবেশ করতে যাচ্ছে। তখন রপ্তানির ক্ষেত্রে শুল্কসংক্রান্ত কিছু সুযোগ-সুবিধাও হারাবে, যার প্রভাব এখন থেকেই পড়তে শুরু করেছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি কোনো একক পণ্যের দাম বৃদ্ধি নয়। শুধু পরিবহনই নয় এটার বহুমুখী প্রভাব রয়েছে এবং পুরোটাই নেতিবাচক প্রভাব। এই যেমন কারখানার উৎপাদন খরচ বাড়বে, পরিবহন ভাড়া বাড়বে, বাসাবাড়িতে জেনারেটর চলে সেখানেও খরচ বাড়বে। বিশেষ করে কৃষি ক্ষেত্রে সেচ দিতে ডিজেলের প্রয়োজন হয়, কৃষকেরও উৎপাদন খরচ বাড়বে। আমরা তো এমনিতেই কৃষকের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য দিতে পারি না। সেখানে তাদের খরচ আরও বাড়িয়ে দিলাম। আবার পণ্য পরিবহনেও খরচ বাড়বে। এমনকি সমুদ্রপথে জাহাজে যে পণ্য আসে সেখানেও খরচ বাড়বে। তাই জ্বালানির দাম বাড়ানোর এ সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে আরও ভাবা উচিত ছিল। এটা একটা অপরিপক্ব সিদ্ধান্ত। সেটি পুনর্বিবেচনা করা উচিত। এখনো সরকারের হাতে সময় আছে, এটা পুনর্বিবেচনার করার মতো। অন্যথায় দেশের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।’

টানা দুবছর ধরে চলছে করোনা মহামারী। এর আঘাতে গত বছরের শুরুতে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে অর্থনীতি। সামষ্টিক অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোর আগেই আবারও শুরু হয় করোনার দ্বিতীয় ও তৃতীয় ঢেউ। এতে একদিকে বিপুলসংখ্যক মানুষ বেকার হয়ে পড়ে। অন্যদিকে জীবন রক্ষায় অচল হয়ে যায় জীবনযাত্রা। দৈনন্দিন ব্যয়ের সঙ্গে বেড়ে যায় স্বাস্থ্য পরিচর্যা ব্যয়। দিশেহারা হয়ে পড়ে মানুষ। করোনার প্রভাবে এর মধ্যে প্রায় ১৩ লাখ প্রবাসী দেশে চলে আসতে বাধ্য হন, যাদের বেশিরভাগই কাজে ফেরত যেতে পারেননি। নতুন শ্রমিক পাঠানোর হারও কমছে ক্রমাগত। ফলে গত কয়েক মাস ধরে রেমিট্যান্স প্রবাহে বিরাজ করছে নেতিবাচক ধারা, যা দেশের অর্থনীতিতে এক ধরনের অস্বস্তি সৃষ্টি করছে। আবার দেশের শ্রমবাজারও নতুন করে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। সরকারি খাতের সঙ্গে বেসরকারি খাতেরও উৎপাদন খরচ ও পরিচালন ব্যয় বাড়ছে। এতে সরকারি-বেসরকারি উভয় খাতেই শুরু হয় অর্থনৈতিক টানাপড়েন, যা কেবল বাড়ছেই। দুশ্চিন্তা বাড়ছে কর্মসংস্থান, বিনিয়োগ ও বেকারত্ব নিয়েও। সেখানে নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি যেন মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা।

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, ‘জ্বালানি তেলের দাম বাড়লে পরিবহন ব্যয় বেড়ে যায়। এতে মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে আরও দুর্বিষহ ও অসহনীয় হয়ে উঠবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমরা চাই, অন্তত দুটো ডাল-ভাত খেয়ে যেন জীবনযাপন করতে পারি। কিন্তু দিন দিন যেভাবে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ছে, তাতে ডাল-ভাতও খাওয়া যাবে না। দাম বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করতে হলে, কর্তৃপক্ষকে আরও কঠোর হতে হবে।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *