পীরগঞ্জের ঘটনায় ছাত্রলীগ নেতার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি

Slider বাংলার আদালত

রংপুর: সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পবিত্র কাবা শরীফ নিয়ে আপত্তিকর পোস্ট দেয়ার জের নিয়ে রংপুরের পীরগঞ্জে সংখ্যালঘুদের বাড়িঘরে হামলা ভাংচুর, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ ও ভাংচুরের ঘটনায় র‌্যাবের হাতে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় গ্রেফতার মূল হোতা কারমাইকেল কলেজ ছাত্রলীগের বহিস্কৃত নেতা সৈকত মন্ডল ও তার সহযোগী রবিউল ইসলাম আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।

অন্য দিকে এ ঘটনায় তিন দিনের রিমান্ড শেষে ভাংচুর ও অগ্নি সংযোগের মামলায় ৩৭ জনকে আদালতের নির্দেশে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। এছাড়াও কারমাইকেল কলেজ ছাত্রলীগের কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করেছে মহানগর ছাত্রলীগ।

র‌্যাবের দায়েরকৃত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পীরগঞ্জ থানার এসআই সুদীপ্ত শাহীন জানান, রোববার সন্ধ্যায় রংপুর সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আমলি আদালত-২-এর বিচারক দেলওয়ার হোসেনের আদালতে সৈকত মন্ডল ও রবিউল ইসলামকে হাজির করা হয়। সেখানে তারা ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। সেখানে ঘটনার বর্ণনা দিয়েছে তারা। এছাড়াও ভাংচুর ও অগ্নি সংযোগের মামলায় ৩৭ আসামিকে ৩ দিনের রিমান্ড শেষে একই আদালতে তোলেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পীরগঞ্জ থানার পুলিশ পরিদর্শক মাহবুবুর রহমান। আদালত তাদের জামিন নামঞ্জুর করে আদালতে পাঠানো আদেশ দেন।

এর আগে শুক্রবার টঙ্গি থেকে ছাত্রলীগ নেতা সৈকত মন্ডল ও রবিউলকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। তাকে গ্রেফতারের পর কারমাইকেল কলেজ শাখা ছাত্রলীগ সৈকত মন্ডলকে ছাত্রলীগ থেকে অব্যাহতি দিয়েছে।

কারমাইকেল কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি সাইদুজ্জামান সিজার জানান, সৈকত মন্ডল কারমাইকেল কলেজ ছাত্রলীগের দর্শন বিভাগের সহ-সভাপতি ছিলেন। পীরগঞ্জের ঘটনা নিয়ে আপত্তিকর পোস্টের কারণে তাকে ঘটনার দিনই ছাত্রলীগের সকল কার্যক্রম ও পদবী থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে।

তিনি জানান, ২০১৭-১৮ সেশনে সৈকত কারমাইকেল কলেজে দর্শন বিভাগে ভর্তি হন। এছাড়াও কারমাইকেল কলেজ ছাত্রলীগ সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক জাবেদ আহমেদ স্বাক্ষরিত এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে সৈকত মন্ডলকে দলীয় শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগে দল থেকে অব্যাহতি দেয়ার কথা বলা হয়েছে। সেখানে তারিখ উল্লেখ করা হয়েছে ১৮ অক্টোবর।

দলীয় সূত্র জানায়, কারমাইকেল কলেজ ছাত্রলীগের নেতা হিসেবে রংপুরে ছাত্রলীগের প্রত্যেকটি কার্যক্রমে তার সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল। সৈকত ঘটনাস্থল কসবা বড়করিমপুর এলাকার মো: রাশেদুল হকে ছেলে। একই এলাকার মোসলেম উদ্দিনের ছেলে রবিউল ইসলাম।

অন্য দিকে রোববার বিকেলে রংপুর মহানগর ছাত্রলীগ সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক স্বাক্ষরিত এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ায় কারমাইকেল কলেজ ছাত্রলীগের কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়েছে।

শনিবার ঢাকায় এক প্রেস ব্রিফিংয়ে র‌্যাব জানিয়েছে রংপুরের পীরগঞ্জে হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িতে হামলা ও অগ্নিসংযোগে সৈকত মণ্ডল (২৪) নামের এক শিক্ষার্থী নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। পরিতোষ সরকারের দেয়া পোস্ট ফেসবুকে শেয়ার করে বিভিন্ন ধরনের উসকানিমূলক মন্তব্য এবং মিথ্যা পোস্টের মাধ্যমে গুজব ছড়িয়ে স্থানীয় লোকজনকে উত্তেজিত করেন সৈকত। ঘটনার দিন একটি মসজিদ থেকে মাইকিংয়ের মাধ্যমে উসকানিমূলক বক্তব্য দিয়ে স্থানীয় লোকজনকে জড়ো করেন তার সহযোগী রবিউল ইসলাম (৩৬)। এরপরই হামলা চালানো হয়।

র‌্যাব আরো জানায়, পীরগঞ্জের বড়করিমপুরে পরিতোষ সরকার ও উজ্জ্বল নামের দুই তরুণের মধ্যে ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব ছিল। এর জের ধরে পরিতোষের ধর্ম নিয়ে উজ্জ্বল কটূক্তি করেন। পরে পরিতোষ ফেসবুক ম্যাসেঞ্জারে উজ্জ্বলের ধর্ম নিয়ে পাল্টা মন্তব্য করেন। পরিতোষের ওই মন্তব্য ফেসবুকে পোস্ট করেন উজ্জ্বল। উজ্জ্বলের ওই পোস্ট সৈকত মন্ডল নিজের ফেসবুক পেজে ছড়িয়ে দেন। কুমিল্লার ঘটনার পর থেকেই সৈকত নানা উসকানিমূলক পোস্ট দিচ্ছিলেন। পরিতোষ ও উজ্জ্বলের দ্বন্দ্বের ঘটনাকে সুযোগ হিসেবে নিয়েছিলেন সৈকত। তার একটি ফেসবুক পেজ আছে। সেখানে তার প্রায় তিন হাজার অনুসারী রয়েছে।

র‌্যাব জানায়, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করতে সময়ের জন্য অপেক্ষা করছিলেন সৈকত। পরিতোষের বার্তাকে কেন্দ্র করে সৈকত উসকানি ছড়ানোর পাশাপাশি নেতৃত্ব দিয়ে হামলার ঘটনা ঘটিয়েছেন।

র‌্যাব আরো জানায়, সৈকত জানিয়েছেন, তিনি রংপুরের একটি ডিগ্রি কলেজের শিক্ষার্থী। তিনি ছাত্রলীগের নেতা হিসেবে নিজে থেকে প্রচার করে থাকতে পারেন। তবে এ সংক্রান্ত কোনো তথ্য–প্রমাণ তিনি দিতে পারেননি। সৈকত বিভিন্ন সময় ফেসবুকে নিজের সম্পর্কে মিথ্যা প্রচারণা চালিয়েছেন। কোনো কোনো সময় তিনি নিজেকে ছাত্রনেতা দাবি করেছেন।

এদিকে এ ঘটনায় করা দুটি ডিজিটাল নিরাপত্তা এবং একটি ভাংচুর অগ্নিসংযোগের ঘটনার মামলার ঘটনার দিন থেকে ফেসবুকে পোস্টদানকারী পরিতোষ সরকারসহ মোট ৬২ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এরমধ্যে পীরগঞ্জ থানার এসআই ইসমাইল হোসেন করা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় ৩ জন, র‌্যাবের করা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় ২ জন এবং বাকি ৫৮ জন ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ মামলার আসামি।

অন্য দিকে এ ঘটনায় সরকারি বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় ক্ষত্রিগ্রস্তদের বাড়িঘর করে দেয়া হয়েছে। তৈজসপত্র, আসবাবপত্র, দোকানপাট, শিশু খাদ্য, বই, পোশাক পরিচ্ছদ, মাছ ধরার জালসহ কয়েক মাসের খাবারের বন্দোবস্ত করে দেয়া হয়েছে।

ত্রাণ ও দুর্যোগ প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমান শনিবার দুপুরে ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে বলেছেন, সেখানে এখন পরিস্থিতি স্বাভাবিক। তাদের মধ্যে আর কোনো ভীতি নেই। সবাই মিলেমিশে চলাফেরা করছে।

গত ১৭ অক্টোবর রাতে ওই এলাকার পরিতোষ সরকাদের দেয়া ফেসবুকে কাবাঘর অবমাননাকর পোস্ট দেয়াকে ঘিরে বেশকিছু বাড়িতে হামলা, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট করে দুর্বৃত্তরা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *