মুক্ত’ কাবুল, ‘অনিশ্চিত’ আফগানিস্তান

Slider সারাবিশ্ব


ডেটলাইন অনুযায়ী শেষ মার্কিন সেনা কাবুল ছেড়েছেন আর আতশবাজি ফাটিয়ে উল্লাস করেছে রক্ষণপন্থী তালেবান গোষ্ঠী, এখন যাদের কর্তৃত্বাধীন বিমানবন্দর, রাজধানী এবং পুরো দেশ। কাবুল আপাত ‘মুক্ত’ হলেও আফগানিস্তানের ‘অনিশ্চয়তা’ কেটে গেছে বলে মনে করার কারণ নেই। বরং চরম ট্রানজিশন বা ক্রান্তিকালের মুখোমুখি হয়েছে দক্ষিণ ও পশ্চিম এশিয়ার সঙ্গমস্থলের এই ল্যান্ড-লকড দেশটি।

অতীতে বার বার এমন সন্ধিক্ষণে উপনীত হয়েছে আফগানিস্তান। সোভিয়েত বাহিনী বিদায় নেওয়ার সময় আহমাদ শাহ মাসুদ, আবদুর রশিদ দোস্তাম, বোরহানউদ্দিন রাব্বানি, গুলবদন হেকমতিয়ার প্রমুখ নেতৃবৃন্দের নিয়ন্ত্রণাধীন মোজাহেদিন বাহিনীও আপাত বিজয়ের স্বাদ পেয়েছিল। নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব-সংঘাতে এবং আন্তঃকোন্দলে তা স্থায়ী না হয়ে বিলীন হয়ে গিয়েছিল অনিশ্চয়তার অন্ধকারে।

ঘোরতর সঙ্কুলতার মধ্যে সে সময় উত্থান ঘটে তালেবান গোষ্ঠীর এবং ক্ষমতা দখল করে তারা। তারপরেও অনিশ্চয়তা কাটেনি। ২০০১ সালে ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ ঘোষণা করে আফগান মাটিতে নামে প্রেসিডেন্ট বুশের মার্কিন বাহিনী।

হামিদ কারজাই, আশরাফ গণি প্রমুখকে ক্ষমতায় এনে চেষ্টা করে স্থিতিশীলতার। কিন্তু ২০ বছরে ২ ট্রিলিয়ন ডলারেরও বেশি ব্যয়ের ‘মিশন কাবুল’ ব্যর্থ হয়। পুনরায় ক্ষমতায় আসে তালেবানরা। কিন্তু এর ফলে পূর্ণ শান্তি এসেছে, তা বলা যাচ্ছে না। আফগানিস্তানকে ঘিরে দেশের ভেতরে ও বাইরে সঙ্কট ঘণীভূত হচ্ছে। অনিশ্চয়তার অবসান এখনই ঘটছে না।

তবে, দৃশ্যত সাঙ্গ হয়েছে মিশন কাবুল। শেষ মার্কিন সেনা হিসেবে কাবুল বিমানবন্দর ছেড়েছেন মার্কিন মেজর জেনারেল ক্রিস ডোনাহিউ। আর এতেই ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিলেন এই মার্কিন সৈনিক। নির্ধারিত সময়ের একদিন আগেই কাবুল বিমানবন্দর থেকে সেনা প্রত্যাহার করে নিয়েছে আমেরিকা। কাবুল বিমানবন্দর থেকে সোমবার (৩০ আগস্ট) মধ্যরাতে শেষ সামরিক বিমানটি ছাড়ে ঠিক ১২টা বাজতে এক মিনিট আগে। সেই C-17 শেষ বিমানটিতে একদম শেষে পা রাখেন ৮২তম এয়ারবোর্ন ডিভিশনের মেজর জেনারেল ক্রিস ডোনাহিউ। মার্কিন সামরিক বিভাগের তরফে একটি টুইট করে প্রকাশ করা হয় তার ছবি। নাইট ভিশন ক্যামেরায় ধরা পড়েছেন তিনি। ২০ বছরের যুদ্ধের অবসান ঘটিয়ে আফগানিস্তান থেকে ফিরে যাওয়া মার্কিন বাহিনীর শেষ সৈনিক হিসেবে তাই ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই হল ডোনাহিউর।

পেন্টাগনের তরফে মার্কিন সেন্ট্রাল কমান্ডের প্রধান জেনারেল কেনেথ ম্যাকেঞ্জি ঘোষণা করেন, ‘আফগানিস্তান থেকে সেনা সরানোর কাজ শেষ হল ও আমেরিকানদের উদ্ধারকাজও শেষ হল।’ মার্কিন এয়ার ফোর্সের C-17 সামরিক বিমানে চেপে কাবুল ছাড়ে মার্কিন সেনা। বিমানে ছিলেন সেনাবাহিনীর সদস্যরা। তাদের সঙ্গেই দেশে ফিরলেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত রস উইলসনও। একইসঙ্গে কাবুলে মার্কিন দূতাবাস সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। পেন্টাগনের তরফে আরও জানানো হয়েছে, আফগানিস্তানে আমেরিকার আর কোনও কূটনৈতিক প্রতিনিধি নেই। ওই অফিস কাতারের দোহায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে।

এদিকে, কাবুল থেকে আমেরিকান সেনা প্রত্যাহার হতেই উৎসবের মেজাজে তালেবানরা। কাবুল বিমানবন্দরের পূর্ণ দখল পেয়েই রকেট-গোলাবর্ষণ করে সেলিব্রেশনের মুডে তারা। ২০ বছরের যুদ্ধের আনুষ্ঠানিক অবসান হতেই উল্লাসে ফেটে পড়েছে তারা। কেউ শূন্যে গুলি ছুড়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করছেন তো কেউ কেউ আবার রকেট ছুড়তে শুরু করেছেন। কাবুলের আকাশে ঘনঘন শোনা যাচ্ছে রকেট ও গুলির শব্দ। আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় সেসবের খবর ও ছবির বন্যা চলছে্

তালেবান মুখপাত্র জাবিদুল্লাহ মুজাহিদ বলেছেন, ‘শেষ মার্কিন সেনা কাবুল বিমানবন্দর ত্যাগ করা মাত্র পূর্ণ স্বাধীনতা লাভ করল আমার দেশ। যদিও বর্তমানে দেশজুড়ে কিছুটা বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। তবে একবার সরকার দখল হয়ে গেলে সমস্ত সমস্যাই দূর হয়ে যাবে।’

তালেবান কর্তৃপক্ষের এই আশাবাদ কতটুকু ফলপ্রসূ হয়, সেটাই এখন দেখার বিষয়। কারণ গত ৪২ বছরের ইতিহাসে দেশটিকে কেউই ক্ষমতায় স্থায়ী হতে পারেনি। যুদ্ধ ও সংঘাতের রক্তাক্ত পথে একের পর এক ঘটেছে পালাবদল। যদিও ২০০১ সাল আর ২০২১ সাল এক নয় এবং আগের তালেবান ও বর্তমান তালেবান একই রকম নয়, তথাপি তাদের সামনে অপেক্ষমাণ বন্ধুর পথ। আগের তালেবানদের বিরুদ্ধে আমেরিকার নেতৃত্বে পুরো বিশ্ব ছিল একাট্টা। এবারের তালেবানদের সঙ্গে আছে গুরুত্বপূর্ণ অনেক আঞ্চলিক শক্তি। আগের তালেবান বামিয়ামে সাংস্কৃতিক স্থাপনা ধ্বংসসহ নারী ও মানবাধিকারের বিরুদ্ধে চালিয়েছিল প্রচণ্ড তাণ্ডব। বর্তমান তালেবান সবাইকে আস্থায় নিয়ে কাজ করতে চাচ্ছে। অপেক্ষাকৃত ‘নরম’ ও ‘ধীরে চলো’ নীতিতে দেশে-বিদেশে সমর্থন পেতে চাইছে এবার ক্ষমতা দখলকারী তালেবানরা।

আমেরিকার পূর্ণ প্রত্যাহারের ফলে সম্পূর্ণ কর্তৃত্ব যেমন পেয়েছে তালেবানরা, তেমনি সরকার গঠন, শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা ও মসৃণ শাসন চালুর রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ তাদের সামনে রয়েছে। সামরিক দিক দিয়ে সাবেক আফগান বাহিনী ও বিভিন্ন গোষ্ঠীর সশস্ত্র প্রতিরোধ ও অন্তর্ঘাত সামলাতে হচ্ছে তাদের। কূটনৈতিকভাবে আন্তর্জাতিক মহলে বন্ধু বাড়াতে হবে তাদের। লাগাতার যুদ্ধ ও সংঘাতে বিদীর্ণ অর্থনীতিকেও পুনর্গঠন করতে হবে তালেবান গোষ্ঠীকে।

এইসব বহুমাত্রিক চ্যালেঞ্জের সঙ্গে যেকোনও সময় যুক্ত হতে পারে আরও অনেক ইস্যু। কারণ পরিস্থিতি মুহূর্তে মুহূর্তে বদলাচ্ছে। অচিন্তনীয় ও অকল্পনীয় আঘাত ও গোপন হামলা আসছে যখন-তখন। স্থিতিশীলতা বিনষ্টের বহু উপাদান বিরাজ করছে সামাজিক ক্ষেত্রে, রাজনৈতিক কাঠামোতে, সামরিক বিন্যাসে, অর্থনৈতিক স্তরে। ফলে আমেরিকার চলে যাওয়ায় কাবুল আপাতত ‘মুক্ত’ হলেও ‘অনিশ্চয়তা’র পরিপূর্ণ অবসান ঘটেনি। সামনের দিনগুলোতে তালেবানদের কৌশলী, দক্ষ ও সুচিন্তিত পদক্ষেপের মাধ্যমেই নির্ধারিত হবে আফগানিস্তানের ভবিষ্যৎ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *