পরীক্ষা নিতে বাধা কোথায়?

Slider শিক্ষা

করোনায় কাবু দেশের শিক্ষাব্যবস্থা। শিক্ষার্থীদের দীর্ঘ ১৬ মাস ফেরানো হয়নি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। এরই মাঝে পরিস্থিতি জটিলতর হচ্ছে পরীক্ষা না হওয়ায়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনা খুব সহজে দেশ তথা বিশ্ব থেকে যাবে না। শিক্ষার্থীদের পরীক্ষাগুলো নেয়ার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। তবে ঢিমেতালে চলছে এই পকিল্পনা।

চার স্তরের পরীক্ষা আটকে থাকায় স্থবির হয়ে উঠেছে শিক্ষা। চলতি বছরের এসএসসি-এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার্থীদের ২০২০ সালের মতো মিলবে না ‘অটোপাস’।

চাপা উৎকণ্ঠায় দীর্ঘ সময় কাটাচ্ছেন ৪০ লাখ পরীক্ষার্থী। বছরের শুরুতে হওয়ার কথা ছিল তাদের পরীক্ষা। কিন্তু পরীক্ষা না হওয়ায় পাসের আগেই অনার্সে সেশন জটে পড়েছেন তারা। আর গত বছরের পাস করা ১৭ লাখ শিক্ষার্থী ভর্তির আগেই পড়েছেন দেড় বছরের সেশনজটে।

চলতি বছরের পরীক্ষার্থীদের তিন বিষয়ে পরীক্ষা নেয়া হবে। প্রশ্ন উঠছে দেশে এতো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কঠোর স্বাস্থ্যবিধি মেনে কেন নেয়া হচ্ছে না পরীক্ষা? কেন নভেম্বর, ডিসেম্বরের পরীক্ষা নেয়ার কথা বলা হচ্ছে।

এখনো নেয়া সম্ভব হয়নি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা। দেশের প্রথমবারের মতো গুচ্ছ পদ্ধতিতে তিন গুচ্ছে পরীক্ষা নিতে সম্মত হয়েছে ৩০ বিশ্ববিদ্যালয়। এখন পর্যন্ত ভর্তি পরীক্ষা নেয়া হয়নি তাদের। ভর্তির আগেই দেড় বছরের সেশনজটে তারা। চলতি মাসেই পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা করেছে আর্মি মেডিকেল ও বিইউপি। আর ডেন্টাল ভর্তি পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা করা হয়েছে ১০ই সেপ্টেম্বর। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের গুচ্ছের ভর্তি পরীক্ষা নেয়া হবে সেপ্টেম্বরে। ১২ই আগস্ট প্রকৌশল গুচ্ছে ভর্তি পরীক্ষার কথা ছিল সেটিও স্থগিত হয়ে যায়। স্থগিত আছে কৃষি গুচ্ছের সাত বিশ্ববিদ্যালয়েরও পরীক্ষা। পরীক্ষা না হওয়ায় নতুন শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে নাম লেখাতে পারছেন না।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার আগেই জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি কার্যক্রম চালু হওয়ায় তালগোল পাকিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। কারণ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে যেসব শিক্ষার্থী ভর্তির সুযোগ পাবেন সম্ভবতই জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বেন না। কিন্তু পাবলিকের আগে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি কার্যক্রম হওয়ায় অনেক শিক্ষার্থী জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবেন। পরে পাবলিকে সুযোগ মেলার পরে চলে যাবেন। ফলে আসন শূন্য থাকা ও ফলাফলে পিছিয়ে থাকা শিক্ষার্থীরা আসন বঞ্চিত হবেন। আজ শেষ হচ্ছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি আবেদন।

এ ব্যাপারে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক ড. মো. মশিউর রহমান বলেন, যাদের ভালো প্রস্তুতি থাকে তারা সাধারণত জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয় না। আমরা দেখেছি মাত্র ১ শতাংশ শিক্ষার্থী চলে যায়। তবে এবার যেহেতু আগেই পরীক্ষা হচ্ছে সেহেতু আসন শূন্য রাখার দুশ্চিন্তা দূর করতে তৃতীয় স্লিপ চালু করা হতে পারে।

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিরাজ করছে চাপা ক্ষোভ। ঝুলে আছে সিংহভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন পরীক্ষা। বিশেষ করে ফাইনাল পরীক্ষাগুলো না হওয়ায় দীর্ঘ হচ্ছে সেশন জট।

কিন্তু শিক্ষার্থীদের ফাইনাল পরীক্ষা নেয়া হচ্ছে না কেন? মাঝে বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষাগুলো নেয়া হচ্ছিল। হঠাৎই বন্ধ করে দেয়া হয় তা। চলতি এই পরীক্ষাগুলোতে কোনো শিক্ষার্থীর করোনা আক্রান্ত হওয়া কিংবা আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণের তথ্য মেলেনি তবুও হঠাৎই এমন সিদ্ধান্ত দেয়া হয়। শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করলেও পরীক্ষার হলে আর বসা হয়নি তাদের। যদিও কিছুটা সুর নরম করেছে সরকার। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর ইউজিসি থেকে জানানো হয়েছে সশরীরে নেয়া যাবে পরীক্ষা। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইনে পরীক্ষার প্রস্তাব করা হয়েছে। তা ঝুলে আছে একাডেমিক কাউন্সিলের সিদ্ধান্তের ওপর। কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক, শিক্ষার্থীদের ট্রেনিংয়ের পরই নেয়া হবে অনলাইনে পরীক্ষা। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন অব্দি কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছায়নি। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনলাইনে কিংবা সশরীরে পরীক্ষা তা নিয়ে সিদ্ধান্ত জানাতে স্ব স্ব বিভাগকে জানাতে বলা হয়।

এদিকে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১২ই সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হচ্ছে অনলাইনে ফাইনাল পরীক্ষা। নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে চলছে অনলাইনে ফাইনাল পরীক্ষা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে শুরু হবে চতুর্থবর্ষের ফাইনাল পরীক্ষা।

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে সেশনজট নতুন কিছু নয়। তবে করোনার পূর্ব পর্যন্ত সেশনজট অনেকটাই লাঘব হয়েছিলো তাদের। উচ্চ পর্যায়ে সর্বাধিকসংখ্যক শিক্ষার্থীর এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা না হওয়ায় দেখা দিয়েছে সেশনজট। যার রেশ বইতে হবে দীর্ঘ সময়। আবার প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের দেয়া হয়েছে শর্ত সাপেক্ষে। যা নিয়েও আছে নানা বিতর্ক। রংপুর মডেল কলেজের শিক্ষার্থী শাকিল চৌধুরী বলেন, ২৩ মাস ধরে আমি দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধিভুক্ত সাত কলেজের নেই অগ্রগতি। জানা যায়, সম্প্রতি এক বৈঠকে সশরীরে পরীক্ষা নেয়ার একটি প্রস্তাবনা রাখা হয়েছে।

এখন প্রশ্ন উঠতে পারে পরীক্ষা নিয়ে শিক্ষার্থীদের ঝুঁকির মুখে ফেলা হবে কিনা? কিন্তু দেশে শিক্ষাছাড়া সবকিছুই সচল। খুলে দেয়া হয়েছে পর্যটন কেন্দ্রও। এছাড়াও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের থেকে পরীক্ষায় অনেক ঝুঁকি কম থাকে। কারণ ক্লাসে সকল শিক্ষার্থী এলেও পরীক্ষা হয় ভাগে ভাগে। এরপশাপাশি টিকা কার্যক্রমের মাধ্যমে সরকারি পর্যায়ের সিংহভাগ শিক্ষক টিকার আওতায় এসেছেন বলে সম্প্রতি জানিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি। শিক্ষামন্ত্রী বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩৪ হাজার শিক্ষার্থী টিকার জন্য রেজিস্ট্রেশন করেছেন যার মধ্যে টিকা পেয়েছেন ৩০ হাজার শিক্ষার্থী। বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ৩ লাখ ৬৩ হাজার ২২২ শিক্ষক কর্মচারীর মধ্যে ২ লাখ ৭৮ হাজার ৪২৬ জন টিকার আওতায় এসেছেন। এই তথ্য শিক্ষামন্ত্রী দেন ৭ই আগস্ট। এরপরও অনেকেই টিকা পেয়েছেন।

আবার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার দাবি জোরালো হচ্ছে দিনকে দিন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভাইস চ্যান্সেলর আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, জরুরি ভিত্তিতে আমাদের পরীক্ষাগুলো নেয়া প্রয়োজন। একেবারে যে সেন্ট্রালি পরীক্ষা নিতে হবে তা না। যেসব এলাকায় সংক্রমণের হার কম সেসব এলাকায় পরীক্ষা নেয়া। শিক্ষক ও যেসব শিক্ষার্থীরা টিকার আওতায় পড়বে তাদের টিকা দিয়ে অঞ্চলভিত্তিক যেসব পরীক্ষা নেয়া সম্ভব তা নিয়ে নেয়া উচিত। তিনি আরও বলেন, ছেলে-মেয়েরা নিঃসঙ্গ বসে আছে। জটিলতা কমাতে সম্ভাব্য পরীক্ষাগুলো দ্রুততার সঙ্গে নেয়ার বিকল্প নেই।

শিক্ষাবিদ ড. সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, শিক্ষার্থীদের সুরক্ষিত রেখে পরীক্ষা নিয়ে নেয়া উচিত। পরীক্ষা পেন্ডিং থাকলে সমস্যাও বাড়বে। তিনি আরও বলেন, করোনাকালে বাধ্য হয়ে আমাদের নানা পথ খুঁজে বের করতে হয়েছে। এর কোনো বিকল্প ছিল। আমি শিক্ষক হিসেবে বুঝি শিক্ষা কতোটা ক্ষতির মুখে পড়েছে। এখন আমাদের ক্ষতি পুষিয়ে নানা পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। যা হতে হবে দীর্ঘমেয়াদি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার পর কিছুদিন অনলাইনেও শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে যেতে হবে। এসব পরিকল্পনা সম্পাদনে তিনি শিক্ষাখাতে বরাদ্দ বৃদ্ধির কথাও বলেন তিনি।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও গণস্বাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে. চৌধুরী বলেন, করোনাকালে শিক্ষাখাত সবথেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এই খাতে পুনরুদ্ধারে চাই বিনিয়োগ। কারণ শিক্ষার সক্ষমতা বাড়াতে বিনিয়োগের বিকল্প নেই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *