আফগানিস্তানে তালেবান উত্থানে জঙ্গি নিয়ে শঙ্কা

Slider জাতীয়


আফগানিস্তানে তালেবান উত্থানে বাংলাদেশি জঙ্গিদের নিয়ে শংকা তৈরি হয়েছে। শত শত যুবক ভারত-পাকিস্তান হয়ে আফগানিস্তানে ‘হিজরত’র চেষ্টা চালাচ্ছেন। ইতোমধ্যে কেউ কেউ হিজরত করেছেন। আফগানিস্তানে সোভিয়েতবিরোধী যুদ্ধ শেষে যেসব যুবক দেশে ফিরেছিলেন তাদের নেতৃত্বে আবারও সুসংগঠিত হওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে হরকাতুল জিহাদ (হুজি)।

বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদেরও জঙ্গিবাদে জড়াতে উৎসাহ দেয়া হচ্ছে। এ প্রেক্ষাপটে আফগান ফেরত সেই ১১১ যোদ্ধার তালিকা হালনাগাদ করেছে গোয়েন্দারা। প্রত্যেকের অবস্থান নিশ্চিত করে তাদের ওপর নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। নব্য জেএমবি, হুজি এবং আনসার আল ইসলাম ছাড়াও হেফাজতে ইসলাম এবং জামায়াত-শিবিরের প্রতিও বিশেষ নজরদারি রেখেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। ভারত, পাকিস্তান এবং আফগানিস্তান গমনেচ্ছুদের (বিশেষ করে যুবক শ্রেণি) ক্ষেত্রে ইমিগ্রেশন ব্যবস্থা কঠোর করার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। সীমান্তে বাড়ানো হয়েছে নজরদারি। এছাড়া রোহিঙ্গা শিবির, কওমি মাদ্রাসা এবং বিভিন্ন আনলাইন গ্রুপকে রাখা হয়েছে বিশেষ পর্যবেক্ষণে। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের প্রধান ও ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার মো. আসাদুজ্জামান যুগান্তরকে বলেন, আফগানিস্তানে তালেবান উত্থানের বিষয়কে কেন্দ্র করে বাংলাদেশি জঙ্গিরা ফায়দা হাসিলের চেষ্টা চালাচ্ছে। তবে তারা সফল হতে পারবে না। কারণ, আমরা তাদের ওপর কঠোর নজরদারি রেখেছি। এরই অংশ হিসাবে মঙ্গলবার নব্য জেএমবির সামরিক শাখার প্রধান প্রশিক্ষক ও বোমা প্রস্তুতকারী জাহিদ হাসান ওরফে রাজু ওরফে ইসমাঈল হাসান ওরফে ফোরকানসহ তিনজনকে গ্রেফতার করেছি। গত কয়েক বছরে ১০ থেকে ১২টি পুলিশ বক্সে বোমা হামলার চেষ্টা চালায় তারা। জাহিদ ড্রোন বানানোর পরিকল্পনা করেছিলেন। ড্রোনের সঙ্গে এক্সপ্লোসিভ যুক্ত করে কোনো জায়গায় আক্রমণের পরিকল্পনা করছিলেন তিনি।

গোয়েন্দা সূত্র জানায়, আশির দশকে সোভিয়েতবিরোধী যুদ্ধে অংশ নিতে আফগানিস্তানে গিয়েছিলেন শতাধিক তরুণ-যুবক। এর একটি বড় অংশ কওমি মাদ্রাসার উগ্রপন্থি শিক্ষক। আফগানিস্তানে তারা গেরিলা যুদ্ধ এবং ভারী অস্ত্র চালানোর প্রশিক্ষণ নেয়। সেই আফগান ফেরত যোদ্ধাদের উদ্যোগে ১৯৯২ সালের ৩০ এপ্রিল এক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে হরকাতুল জিহাদ (হুজি) আল ইসলাম আত্মপ্রকাশ করে। হুজিকে নিষিদ্ধ করা হয় ২০০৫ সালের ১৭ অক্টোবর। গত ৮ বছর ধরে আনসার আল ইসলাম নামে সক্রিয় হুজি সদস্যরা। সম্প্রতি আফগানিস্তানে তালেবান উত্থানে নয়া তৎপরতা শুরু করেছে তারা। এ জঙ্গি সংগঠনের সদস্যরা ফের আফগানিস্তানমুখী হচ্ছে। তাদের এ কাজে উৎসাহ দিচ্ছে আনসার আল ইসলাম বা আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের (এবিটি) শীর্ষস্থানীয় নেতারা।

সাম্প্রতিক আফগান পরিস্থিতি এবিটির জঙ্গিদের কাছে বাংলাদেশে আশীর্বাদ হিসাবে কাজ করছে। তারা বিভিন্ন অ্যাপসের মাধ্যমে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ বাড়াচ্ছে। এমনকি কিছু ইসলামী দল তাদের সমর্থন দিচ্ছে। ইসলামের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে যুবকদের মগজ ধোলাই করা হচ্ছে। এতে তাদের মধ্যে ইসলামী শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা এবং রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের সুপ্ত বাসনা ফের মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। তালেবানদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য তারা নতুন নতুন হামলার পরিকল্পনা করছে। এর আগে আইএসের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য নব্য জেএমবির সদস্যরা দেশে বেশকিছু হামলা চালিয়েছে।

হালনাগাদ গোয়েন্দা তথ্য অনুযায়ী, আফগান যুদ্ধে দুজন বাংলাদেশি মৃত্যুবরণ করেছিলেন। যুদ্ধে অংশগ্রহণ শেষে ১১১ জন বাংলাদেশি ‘মুজাহিদ’ দেশে ফেরত আসে। এদের মধ্যে ১৫ জন শিক্ষক এবং মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল। মামলার পলাতক আসামি একজন। নিখোঁজ আছেন ১৮ জন। বিভিন্ন মামলায় জেলহাজতে আছেন চারজন। মসজিদের ইমাম/খতিব হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন ১০ জন। স্বাভাবিক জীবনে ফিরে ব্যবসা এবং কৃষিকাজ করছেন ২১ জন। মারা গেছেন আটজন। আমেরিকায় অবস্থান করছেন দুজন। সৌদি আরবে আছেন সাতজন। ইতালিতে রয়েছেন দুজন। আরব আমিরাতে সস্ত্রীক অবস্থান করছেন একজন (আল মারকাজুল ইসলামীর প্রতিষ্ঠাতা ও খেলাফত মজলিশের রাজনীতির সঙ্গেও সম্পৃক্ত)। দুবাই/বাহরাইনে অবস্থান করছেন দুজন (আল মারকাজুল ইসলামীর ভাইস চেয়ারম্যান)। এছাড়া লন্ডনে অবস্থান করছে একজন। ফাঁসি কার্যকর হয়েছে দুজনের (মাওলানা শায়খ আব্দুর রহমান ও মুফতি হান্নান)। এতিমখানার প্রদান হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন একজন। অসুস্থ এবং বৃদ্ধাবস্থায় দিনাতিপাত করছেন দুজন। জঙ্গি মামলার আসামি হলেও জামিনে আছেন একজন। নিরাপত্তাকর্মী হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন একজন। ডাক্তারি বা কবিরাজি করছেন দুজন। তাছাড়া পেশাদার মাদক ব্যবসায়ী হিসাবে পুলিশের খাতায় নাম রয়েছে একজনের।

শনিবার রাজধানীর ধানমন্ডিতে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর এলাকা পরিদর্শন শেষে ডিএমপি কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, তালেবানের আহ্বানে যুদ্ধ করার জন্য কিছু বাংলাদেশি আফগানিস্তান গেছেন। দেশ থেকে তালেবানদের সঙ্গে যুদ্ধ করার জন্য অলরেডি কিছু মানুষ হিজরত করেছেন। আমরা ধারণা করছি, কিছু মানুষ ভারতে ধরা পড়েছেন। আর কিছু মানুষ হেঁটে বা অন্য উপায়ে আফগানিস্তানের পৌঁছানোর চেষ্টা করছেন। তিনি বলেন, জঙ্গিদের নজরদারির জন্য সাইবার তৎপরতা বাড়ানো হয়েছে। এখন সারা পৃথিবী সাইবার ওয়ার্ল্ডের মধ্যে বন্দি হয়ে গেছে। জঙ্গিরাও সাইবার মিডিয়ামগুলো ব্যবহার করে তাদের রিক্রুটমেন্ট করার চেষ্টা করছে। সাম্প্রতিক সময়ে আমরা যে প্রবণতাগুলো দেখছি তা হলো, আফগানিস্তানে যাওয়ার জন্য আহ্বান করা হচ্ছে, তালেবানদের পক্ষ থেকে।

মোহা. শফিকুল ইসলাম বলেন, শুধু আমরা নয়, সাইবার ওয়ার্ল্ডে বিভিন্ন সংস্থা তাদের মনিটর করার চেষ্টা করছে। যখনই সন্দেহভাজন কিছু পাওয়া যায়, আমাদের জানানো হয়। যত গোয়েন্দা সংস্থা আছে সবাই তৎপর আছে। যারা তালেবানের ডাকে সাড়া দিয়ে যুদ্ধ করতে আফগানিস্তানে যাচ্ছে তারা দেশেও ছোট ছোট ঘটনা ঘটাচ্ছে। বাংলাদেশে যাতে আর একটিও জঙ্গি হামলার ঘটনা না ঘটে সে ব্যাপারে সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, জঙ্গিদের প্রধান টার্গেট হলো আন্তর্জাতিক মিডিয়ার দৃষ্টি আকর্ষণ করা। এ জন্য ১৫ আগস্টকে তারা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মনে করে। এ জন্য আমরা সর্বোচ্চ সতর্ক আছি।

অ্যান্টি টেরোরিজম ইউনিটের (এটিইউ) অতিরিক্ত ডিআইজি মনিরুজ্জামান বলেন, আফগান পরিস্থিতিতে বাংলাদেশি জঙ্গিদের বিষয়ে আমরা খুবই সতর্ক অবস্থায় আছি। ৮০-এর দশকে যারা আফগানিস্তানে গিয়েছিলেন তাদের বিষয়ে বিশেষ দৃষ্টি রাখছি। দেশকে জঙ্গিবাদ মুক্ত করতে আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাচ্ছি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *