এম্বুলেন্সে জীবন-মৃত্যুর লড়াই

Slider জাতীয়

হাসপাতালের সামনে সারি করা আটটি এম্বুলেন্স। ছয়টি ফাঁকা আর দু’টিতে সিটের জন্য অপেক্ষায় দু’জন রোগী। রাজবাড়ীর বাসিন্দা রিনা আক্তার ও নরসিংদী থেকে এসেছেন নূরী বেগম। মিলছে না সিট। এম্বুলেন্সে ছটফট করছেন তারা। লড়ছেন জীবন-মৃত্যুর লড়াই। তাদের সিটের ব্যবস্থা হতে না হতেই আসতে থাকে আরও নতুন রোগী। ফের তারাও যুক্ত হন জীবন-মৃত্যুর লড়াইয়ে।

গোটা দেশের করোনা রোগীদের ভরসারস্থল হয়ে উঠেছে রাজধানীর ডিএনসিসি ডেডিকেটেড কোভিড-১৯ হাসপাতাল।

গতকাল শুক্রবার দুপুরে দেখা যায় রোগীরা সহসাই পাচ্ছেন না সিট। অপেক্ষার প্রহর কাটাচ্ছেন বাইরে, এম্বুলেন্সে।

রাজবাড়ী থেকে এসেছেন রিনা আক্তার, বয়স ৪০। করোনা উপসর্গ নিয়ে ভর্তি হয়েছিলেন রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে। সেখানে করোনা পরীক্ষায় আসে নেগেটিভ। অবস্থা খারাপ হতে থাকায় ফের নেয়া হয় আরেক বেসরকারি হাসপাতালে। সেখানে করোনা পরীক্ষায় পজেটিভ আসে। দুই হাসপাতালে কেটে যায় ১৪ দিন। ধীরে ধীরে অবস্থার অবনতি হতে থাকে তার।

চিকিৎসকের পরামার্শে নেয়া হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সিটা না পেয়ে নেয়া হয় কুর্মিটোলা হাসপাতালে, মেলে না সিট। শেষ আনা হয় ডিএনসিসি হাসপাতালে।

হাসপাতালে আনার পরও বেশ ভালো ছিলেন তিনি। কিন্তু এম্বুলেন্সে থাকা অবস্থায় বাড়তে তাকে শ্বাসকষ্ট। শুরু করেন ছটফট। দিদ্বিদিক ছুটতে থাকেন স্বজনরা। এম্বুলেন্সে সঙ্গে থাকা ছোট বোন জুড়ে দেন কান্না। শঙ্কা দেখা দেয় এম্বুলেন্সে অক্সিজেন শেষ হওয়া নিয়েও। রিনার অবস্থা এতটাই খারাপ হতে থাকে যে ভিড় জমে যায় এম্বুলেন্সের পাশে। সেখানেই কেটে যায় ৩০ থেকে ৪০ মিনিট। দ্রুত হাসপাতালের এক কর্তব্যরত কর্মী নিয়ে আসেন স্ট্রেচার। এম্বুলেন্সের অক্সিজেন মাস্ক খুলে দ্রুত নিয়ে যাওয়া হয় ট্রায়াজ রুমে। এরপর অপেক্ষা প্রায় ১০ মিনিটের। রোগীর ছোট ভাই রিয়াদ বাইরে বেরিয়ে বলেন, সিট ফাঁকা নেই। আপাতত ট্রায়াজ রুমেই অক্সিজেনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সিট ফাঁকা হলে ভর্তি করিয়ে নেবে। আপার অক্সিজেন লেবেল ৪০-এ নেমে এসেছিল।

রিনার অবস্থা বেগতিক হওয়ায় নেয়া হয়েছে হাসপাতালে। কিন্তু দীর্ঘ এক ঘণ্টা অপেক্ষা করেও সিটের ব্যবস্থা করতে পারেননি নূরী বেগম। নরসিংদী থেকে এসে রাজধানীর চার হাসপাতাল ঘুরেও মিলছে না সিট। তার ছেলে জসিম বলেন, ডাক্তার বলছেন ফাঁকা হলে দেবেন। এক ঘণ্টা ধরে অপেক্ষা করছি কোনো সাড়া নেই। আম্মার শ্বাসকষ্ট নেই কিন্তু এম্বুলেন্সের অক্সিজেন শেষ হলেই বিপদে পড়বো। এখানে গরমে ঘামে হাঁপিয়ে উঠছেন বারবার।

চান মিয়া খন্দকার। বরিশাল থেকে এসেছেন। এক সপ্তাহ ভর্তি ছিলেন কেরানীগঞ্জের একটি হাসপাতালে। এম্বুলেন্সে নেই অক্সিজেন সুবিধা। তাদের নিজস্ব কেনা অক্সিজেন সিলিন্ডারেই শ্বাস নিচ্ছেন তিনি। কিন্তু এই অক্সিজেন মাস্কে চলছিল না তার। বারবার হাঁপিয়ে উঠছিলেন। জীবন-মৃত্যুর সঙ্গে প্রায় ৫০ মিনিট লড়াই চালিয়ে পান সিট। সঙ্গে থাকা ভাগ্নে অনবরত পিঠ ম্যাসাজ করতে থাকেন। দিতে থাকেন সাহস। এ লড়াই জীবন বাঁচানোর লড়াই। অক্সিমিটারে অক্সিজেনের লেবেল দেখাচ্ছিল ৬০। প্রায়শই কমে আসতে থাকে তা। কমে গেলেই পিঠে ম্যাসাজ করছেন ভাগ্নে।

তার ছেলে ইমন মিয়া বলেন, আব্বা চার ঘণ্টা হলো এম্বুলেন্সে। ভয় ছিল অক্সিজেন না শেষ হয়ে যায়। প্রথমে নিয়ে গিয়েছিলাম ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেখান থেকে মুগদা, মুগদা থেকে নিয়ে এসেছি এখানে। যাক আল্লাহর রহমতে সিট পেয়েছি। তবে আব্বার যে অবস্থা হয়েছিল ভয় পাচ্ছিলাম কি হয়!

কুমিল্লা থেকে এসেছেন বৃদ্ধ ফজলুল হক। করোনায় কাহিল এই রোগীর বয়স ৭০। নেই নড়াচড়ার শক্তিটুকুও। তিনি ভর্তি ছিলেন রাজধানীর মোহাম্মদপুরের আল মানার হাসপাতালে। তার ছেলে মানজুরুল আলমের সঙ্গে এসেছেন ছেলের শাশুড়ি জান্নাত ফেরদৌসী। তারাও বেশখানিক সময় অপেক্ষার পর পান সিট। জান্নাত ফেরদৌসী বলেন, আগের হাসপাতালে কোনো কিছুরই ঠিক ছিল না। ভালোমানের কোনো সেবা দেয়ার সক্ষমতা নেই তাদের। সাতদিন ভর্তি ছিলেন। সাড়ে ৬ লাখ টাকা বিল করেছেন তারা। হাসপাতাল বলে, লাইফ সাপোর্টে নেয়ার জন্য। আমরা না করে অন্য হাসপাতালে নিয়ে যাবার কথা বলি। তারা বলে এখন রোগীর অবস্থা ভালো নিতে হবে না। এভাবে রোগী আটকিয়ে সাড়ে ৬ লাখ টাকার বিল করেছে।

হাসপাতালে আসা অধিকাংশ রোগীই বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। তাদের রেফার করা হচ্ছে ডিএনসিসি হাসপাতালে। আর প্রায় সবাই এসেছেন রাজধানীর বাইরে থেকে। দুপুরে কোনো রোগীকে ফিরে যেতে দেখা যায়নি। কিন্তু অপেক্ষার প্রহর গুনতে হয়েছে হাসপাতালের বাইরে। জীবন-মৃত্যুর যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হয়েছে এম্বুলেন্সে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *