গাজীপুর: বৃষ্টি বর্ষার অহংকার। বৃষ্টিহীন বর্ষা অস্তিত্বহীন ঋতু। বৃষ্টি না হলে গ্রীষ্ম ও শরৎ এর মাঝে বর্ষা হারিয়ে যায়। বৃষ্টি না হলে বর্ষা অর্থহীন, এটাই বাস্তবতা। মৌসুমী বায়ূর প্রভাবে ও বৈষ্যিক উষ্ণতায় কোন কোন বছরের বর্ষা তার স্বকীয়তা হারায়। বৃষ্টি ছাড়া বর্ষা হয়ে উঠে না। তাই বৃষ্টি বর্ষার মৌলিক উপাদান।
বৃষ্টি বর্ষার আশার আলোই শুধু নয়, নদী ও কৃষি মাতৃক বাংলাদেশে বৃষ্টির প্রভাব প্রকৃতির মৌলিকত্বকে প্রসিদ্ধ করে। বৃষ্টিতে যেমন বর্ষা হয় তেমনই বৃষ্টিতে ফসলও হয়। নদী ও কৃষি মাতৃক বাংলাদেশে বৃষ্টি প্রকৃতির একটি মৌলিক নিয়ামক। বৃষ্টি না হলে, আমরা বিভিন্ন ধর্মীয় উপাসনালয়ে প্রার্থনা করি। বৃষ্টির জন্য মানুষ খোলা জায়গায় জমায়েত হয়ে নামাজ আদায় করে। আবার অতি বৃষ্টিতে সৃষ্ট বন্যা দূর্যোগ তৈরি করে। এছাড়াও বর্ষায় বৃষ্টিকে ঘিরে মানবের মৌসুমী প্রেম যুগের পর যুগ সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধও করে। তাই আমরা বৃষ্টির জন্য যেমন কান্না করি তেমনি অতি বৃষ্টির জন্য ভয় পাই। তবে বর্ষার বৃষ্টি স্বাভাবিকভাবে তৃষিত হৃদয়ের খোরাক ।
বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় আয়তনের সিটি কর্পোরেশন গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন। সময়ের বাস্তবতা বলছে, আকাশে মেঘ দেখলেই গাজীপুর নগরবাসী ভয় পায়। কমবৃষ্টি, অতি বৃষ্টি, এমনকি সাধারণ বৃষ্টি নগরবাসির জন্য ভয়ের কারন হয়ে গেছে। কারন সাধারণ বৃষ্টিতেই তৈরি হয় জলাবদ্ধতা। প্রয়োজনীয় সমীকরণে উন্নয়ন অবকাঠামো তৈরি না হওয়ায় বৃষ্টি মানুষের জন্য অভিশাপ হয়ে আছে। বৃষ্টি হলেই জলাবদ্ধতার পাশাপাশি রাস্তাঘাটে দীর্ঘ যানজট লেগে যায়। রাস্তাঘাটে খানা খন্দের, ছোট বড় গর্ত তৈরি হওয়ার পাশাপাশি নির্মাণ বা সংস্কার কাজ সাারা বছর চলমান থাকায় পানি জমে জলাবদ্ধতার তৈরি হয়। ছোট বড় সড়কে পানি জমে খানা খন্দের উপচে যাওয়ায় গণপরিবহন থমকে যায়।
রাজধানী ঢাকার প্রবেশধার আব্দুল্লাহপুর ৫৯টি রুটের টার্নিং পয়েন্ট এবং ৫৯ রুটের অধিকাংশ রুটের যানবাহন গাজীপুর হয়ে যাতায়েত করায় বৃষ্টিতে গাজীপুরের যানজট গণমাধ্যমের শিরনাম হয়।
শিল্প রাজধানীখ্যাত গাজীপুরে গণপরিবহনের পাশাপাশি পণ্য পরিবহন যুক্ত থাকায় ২ থেকে ৩ কিলোমিটাার যানজট হলেই ব্রেকিং নিউজ হয়ে যায় গাজীপুর। আর তখনই জাতির দৃষ্টি গাজীপুরের দিকে চলে আসে। বৃষ্টিতে গাজীপুরে যানজট ও জলাবদ্ধতা এখন জাতীয় খবর।
বাংলাদেশের ৬৪ জেলার মধ্যে বৃষ্টি হলে গাজীপুরের যানজট জাতীয় শিরোনাম হয়ে যায়। গাজীপুরের এই কলঙ্ক যুগের পর যুগ ধরে চলে আসছে। সরকার যায় সরকার আসে কিন্তু গাজীপুরের যানজট ও জলবদ্ধতা শেষ হয় না।
বৃষ্টিতে গাজীপুর যেন মরণ ফাঁদ। বৃষ্টিতে সৃষ্ট যানজট ও জলাবদ্ধতায় যেমন অনাকাঙ্খিত সড়ক দূর্ঘটনা ঘটে তেমনই রাজপথ ও বাড়ির আঙিনায় পানি উঠায় পানিতে ডুবে মৃত্যুর সংখ্যাও বাড়ে।
অতি বৃষ্টি দীর্ঘায়িত হলে জমে থাকা বৃষ্টির পানি ময়লা আবর্জনার সাথে মিশে ডায়রিয়া আমাশা সহ নানা ধরনের মহামারি রোগের জন্ম দেয়।
সাম্প্রতিক সময়ে গাজীপুর মহানগরের ছোট দেওড়া গোরস্থান সহ বেশ কয়েকটি এলাকায় ডায়রিয়ার প্রকোপ ৫ জন মারা যায় ও ৩ শতাধিক মানুষ ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়।
তাই প্রকৃতি ও মানুষের জন্য বর্ষার মৌসুমী বৃষ্টি আশির্বাদ হলেও গাজীপুর বাসির জন্য অভিশাপ। এই অভিশাপ থেকে মুক্তির উপায় নিয়ে ভাবনা শুধু মাত্র রাজনৈতিক বুলি। তবে বর্তমান সময়ে গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের দ্বিতীয় মেয়াদে নির্বাচিত মেয়র জাহাঙ্গীর আলম এই অভিশাপ থেকে নগরবাসীকে মুক্ত করার জন্য বেশ কিছু পদক্ষেপ নিচ্ছেন। সুষ্ঠ ও পরিকল্পিতভাবে নেয়া পদক্ষেপগুলো সফলভাবে বাস্তবায়ন হলে অভিশাপ থেকে গাজীপুর মহানগরবাসীর মুক্তি মিলবে বলে তারা আশবাদী।
এদিকে বিলুপ্ত গাজীপুর ও টঙ্গী পৌরসভা তাদের কার্যকালে এই অভিশাপ থেকে মুক্তির জন্য উল্লেখযোগ্য কোন পদক্ষেপ নিয়েছে কিনা তা আলোর মুখ দেখেনি।
রাজনীতিকেরা বলছেন, গাজীপুরে বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রীর জন্ম ,স্পীকারের জন্ম । একাধিক মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী প্রায় সব সরকারের সময়েই গাজীপুরের ছিল। গাজীপুরের মন্ত্রী প্রতিমন্ত্রী বাংলাদেশে উন্নয়নের আলো জ্বালালেও হ গাজীপুরকে এই অভিশাপ থেকে মুক্ত করতে পারেনি।
মহান মুক্তিযোদ্ধের ১৯ মার্চ প্রথম সশস্ত্র প্রতিরেধ যুদ্ধের মহানায়ক গাজীপুরের এমপি এখন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক। বর্তমান সরকারের সবচেয়ে সিনিয়র মন্ত্রী তিনি। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতির মত শক্তিশালী পদে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী। বর্তমানে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রাণালয়ের প্রতিমন্ত্রী অনেকটা পূর্ণ মন্ত্রীর দায়িত্ব প্রাপ্ত জাহিদ আহসান রাসেল । বি এন পি সরকারের আমলে পূর্ণমন্ত্রী ছিলেন গাজীপুরের আ স ম হান্নান শাহ। প্রতিমন্ত্রী ছিলেন অধ্যাপক এম এ মান্নানও। এম এ মান্নান গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের প্রথম মেয়রের দায়িত্বও পালন করেন। কিন্তু দূর্ভাগ্যের বিষয় গাজীপুর মহানগরে যানজট ও জলাবদ্ধতা নিরসনে তারা ব্যর্থ হয়েছেন। গাজীপুর মহানগর হওয়ার পূর্বে গাজীপুর জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন বি এন পির আলহাজ্ব হাসান উদ্দিন সরকার। তিনি এম পি ও ছিলেন জাতীয় পার্টির আমলে। তবুও হাসান সরকারের বাড়ি টঙ্গী এলাকার যানজটও জলাবদ্ধতা দূর করতে পারেননি।
গাজীপুর মহানগর বাসীর অভিযোগ আওয়ামীলীগ, বি এন পি, জাতীয় পার্টি, তিনটি দলেরই বড় বড় নেতা আমাদের গাজীপুরের হওয়া সত্বেও গাজীপুর বাসীকে জলাবদ্ধাতা ও যনজটের হাত থেকে রক্ষা করতে পারেনি তারা। তবে বর্তমান মেয়র রাস্তাঘাট নির্মাণও সংস্কার করার ক্ষেত্রে যেসব পদক্ষেপ নিচ্ছেন তার পাশাপাশি যানজট-জলাবদ্ধতা নিরসনে বিশেষ প্রকল্প নিয়ে জরুরী ভিত্তিতে বাস্তবায়ন করলে গাজীপুর বাসীর দীর্ঘদিনের অভিশাপ মুক্ত হতে পারে।
বর্তমান সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চারাগাছ খ্যাত গাজীপুর সিটি মেয়র জহাঙ্গীর আলম গাজীপুর বাসিকে এই চিরায়ত অভিশাপ থেকে মুক্ত করতে পারবেন এমন আশাই বুক বেঁধে আছে নগরবাসি। অন্যথায় আগামী সিটি নির্বাচনে এই অভিশাপ ব্যপক প্রভাব ফেলতে পারে বলে নগরবাসীর আশঙ্কা।
গাজীপুর সিটির জলাবদ্ধতা নিরসনে যে সব পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরীঃ ১| শহরের দুই পাশ দিয়ে বয়ে চলা তুরাগ ও চিলাই নদীর পানি প্রবাহ বছরের পুরো সময় নিশ্চিত করতে হবে। ২। এই নদী দুটির যে সকল শাখা ও খাল সংযুক্ত ছিল তা খনন করে প্রবাহমান করতে হবে। ৩। ড্রেনের পানি নদীতে পতিত হওয়ার আগে সব ড্রেনের মাথায় পানি শোধনাগার (সি ই টিপি) স্থাপন করেত হবে যাতে দূষিত পানি নদীতে পরতে না পারে।৪। এবং পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা সংরক্ষনের জন্য আলাদা তদারকীর ব্যবস্থা রাখতে হবে।
চলবে…
(শেষ পর্বে গাজীপুর সিটি মেয়র আলহাজ্ব এ্যাড. জাহাঙ্গীর আলমের সাক্ষাৎকার)