শ্রীপুরে অপচিকিৎসার সেই হাসপাতাল অবশেষে সিলগালা

Slider গ্রাম বাংলা জাতীয় টপ নিউজ সারাদেশ

llkk

ষ্টাফ করেসপনডেন্ট
গ্রাম বাংলা নিউজ২৪.কম
শ্রীপুর অফিস: ‘ডাক্তররে বাপ ডাকছি-খোদার দোহাই দেয়া কইছি, আমি আর সইবার পারতাছি না আমারে ছাইরা দেন। ডাক্তর আমার মুহের ভিতর মোবাইল ফোন ডুহাইয়া দেয়া আত-পাও বাইন্ধা আমার পেট কাটছে। আমি খালি চিক্কার পাইরা খোদারে ডাকছি।’ গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার তেলিহাটী ইউনিয়নের উত্তর পেলাইদ গ্রামের মুদি দোকানদার মো. জামান মিয়া এভাবেই চিকিৎসকের করা নির্মম অপচিকিৎসার বর্ণনা দিলেন। শ্রীপুরের মাওনা বাজার রোডে কদম আলী সুপার মার্কেট এলাকায় শাপলা মেডিক্যাল অ্যা- ডায়াগনস্টিক সেন্টারের চিকিৎসক মফিজুর রহমান ফাহিমের অপচিকিৎসার ¯্রফে একটিমাত্র নজির এটি। এর আগে তাঁর অপচিকিৎসায় আরো তিন প্রসূতি মারা গেছেন। বরাবরই প্রভাবশালীরা ঘটনার ধামাচাপা দিলেও এবার ফেঁসে গেছেন হাসপাতালের পরিচালকসহ চিকিৎসকরা। ভুল চিকিৎসার অভিযোগে গত বুধবার রাতে শ্রীপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ সাদেকুর রহমান হাসপাতালটি সিলগালা করে দেন।

এদিকে অপচিকিৎসার ঘটনায় গত ১৭জুন ভুক্তভোগী মো. জামান মিয়ার বাবা কৃষক হাবিবুর রহমান বাদী হয়ে চিকিৎসক মফিজুর রহমান ফাহিমসহ আট জনকে আসামি করে একটি মামলা দায়ের করেছেন।

জানা গেছে, শ্রীপুরের তেলিহাটী ইউনিয়নের উত্তর পেলাইদ গ্রামের দরিদ্র কৃষক হাবিবুর রহমানের ছেলে মো. জামান মিয়া(২৭) গত ১৬মে সকালে খালি পেটে কাঁঠাল খান। দুপুরের পর তাঁর পেটে ব্যথা অনুভূত হয়। ক্রমশ ব্যথার তীব্রতা বাড়ায় রাত ৯টার দিকে তাঁর স্বজনরা তাঁকে শ্রীপুরের মাওনা বাজার রোডে কদম আলী মার্কেটে শাপলা মেডিক্যাল অ্যা- ডায়াগনস্টিক সেন্টারে নিয়ে যান।

স্বজনরা জানায়, হাসপাতালে নেওয়ার পর কর্তব্যরত চিকিৎসক তাৎক্ষণিক রক্ত ও মূত্র পরীক্ষা করে জানায় তিনি (এপেন্ডিক্সের) অন্ত্র সংলগ্ন নলের প্রদাহে ভুগছেন। এপেন্ডিসাইটিসের চিকিৎসা হিসেবে এখনই তাঁর পেটে অস্ত্রোপচার করতে হবে। নইলে ঘণ্টা খানেকের মধ্যে সংক্রমিত এপেন্ডিক্স ফেটে গিয়ে মো. জামান মিয়া মারা যাবেন।

মো. জামান মিয়ার বড় ভাই নাজমুল ইসলাম জানান, রাত সাড়ে ১২টার দিকে চিকিৎসক মফিজুর রহমান ফাহিম ও তাঁর সহযোগী আরো এক চিকিৎসক ও দুজন নার্সকে নিয়ে মো. জামান মিয়ার পেটে অস্ত্রোপচার শুরু করে। তিন ঘণ্টা ২০মিনিট অস্ত্রোপচার চলে।
অস্ত্রোপচারের পর রক্তক্ষরণ চলতে থাকে জামানের। রক্তক্ষরণ বন্ধ না হওয়ায় চিকিৎসকরা জামানকে জরুরিভাবে ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন। পরদিন সকালে মুমূর্ষু অবস্থায় জামানকে ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সার্জারি ইউনিট-১ নিয়ে যাওয়ার পর কর্তব্যরত চিকিৎসক ডা. মনিরুল ইসলাম পরীক্ষা করে জানান তাঁর ভুল চিকিৎসা হয়েছে। জামানের (এপেন্ডিক্স) অন্ত্র সংলগ্ন নলের প্রদাহ ছিল না বলেও জানান ডা. মনিরুল ইসলাম। একদিন পর গত ১৮মে ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সার্জারি ইউনিট-১এ মো. জামানের পেটে ফের অস্ত্রোপচার করেন চিকিৎসকরা। ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে টানা ১৬দিন চিকিৎসা চলে মো. জামান মিয়ার।
মো. জামান মিয়ার বাবা দরিদ্র কৃষক হাবিবুর রহমান জানান, ছেলের চিকিৎসায় ১৬দিনে দুলাখ টাকা খরচ পড়ে। ধারদেনায় ছেলের চিকিৎসা করে এখন তিনি নিঃস্ব। ফলে চিকিৎসা অসম্পূর্ণ রেখে গত ৩০মে মুমূর্ষু অবস্থায়ও ছেলেকে নিয়ে বাড়ি চলে আসেন তিনি। এখন তাঁর কাছে নিয়তি একমাত্র ভরসা।
তিনি জানান, ভুল অস্ত্রোপচারের কারণে তাঁর ছেলের পায়ুনালী কেটে গেছে। পরে চিকিৎসকরা পেটের বাঁ পাশে বিকল্প মলনালী করে দিয়েছেন। কপাল চাপড়ে হাবিবুর রহমান বলেন, ‘কোন ডাক্তর যেন এইরহম সর্বনাশ আর কেউরে না হরে।’অস্ত্রোপচারের নামে চিকিৎসকের নির্মম অপচিকিৎসার বর্ণনা দিতে গিয়ে মো. জামান মিয়া জানান, অস্ত্রোপচার কক্ষে (ওটি) নিয়ে যাওয়ার পর একজন নার্স এসে তাঁর ডান হাতের বাহুতে একটি ইনজেকশন পুশ করে চলে যান। ১০মিনিট পর চিকিৎসক মফিজুর রহমান ফাহিম ও তাঁর আরো একজন সহযোগী চিকিৎসকসহ দুজন নার্স অস্ত্রোপচার কক্ষে ঢোকেন। মফিজুর রহমান ফাহিম তাঁকে নগ্ন করে পেটে চাপ দেন। তাঁর পেটের ডান পাশে চামড়া কাটতে গেলে তিনি তীব্র ব্যথায় সজোরে চিৎকার দিয়ে ছুটে পালানোর চেষ্টা করেন।
কান্নায় ভেঙে পড়ে মো. জামান মিয়া জানান, দুজন নার্সসহ চারজন তাঁর হাত-পা দড়ি দিয়ে শক্ত করে টেবিলের সঙ্গে বেঁধে অস্ত্রোপচার শুরু করেন। অস্ত্রোপচারকালে তিনি তীব্র ব্যথায় চিৎকার আর মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করেছেন। ছুরি চালানোর প্রতিটি মুহূর্ত তিনি খাবি খেয়েছেন।
তাঁর যন্ত্রণাকাতর ভাষায়, ‘মনে অয়ছিল; ডাক্তরের বেশে আজরাইল আমার জান কবজ করতাছে! আমি দমে দমে খোদারে ডাকছি। হেই রাতের কষ্টের কতা আমি বুঝাইতে পারতাম না। আমি ডাক্তরগরে বারেবারে বাপ ডাকছি। জীবনডা ভিক্ষা চাইছি। ছুরি দেয়া পেট কাইট্যা ফালাইবার সময় আমি জোরে জোরে কান্দি দেইখ্যা ডাক্তর আমার মুহের ভিতর হের মোবাইল ফোনডা ডুহাইয়া দিছে।’
মো. জামান মিয়া চিকিৎসকদের বিচার দাবি করে বলেন, ‘আমি মইরা গেলেও ফাহিম ডাক্তরের যেন ফাঁসি অয়। আমি ডাকাইত ডাক্তরটার ফাঁসি চাই।’
এদিকে ভুল চিকিৎসার অভিযোগ অস্বীকার করে ডা. মফিজুর রহমান ফাহিম বলেন, ‘আমি বারবার রোগীর স্বজনদের এক্স-রে করার পরামর্শ দিয়েছিলাম। কিন্তু তারা রোগীর এক্স-রে করেনি। পরে অপারেশন করতে গিয়ে দেখি রোগীর এপেন্ডিসাইটিস নয়, অন্ত্রের অন্য রোগ। এ অবস্থায় রোগীকে আমি ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে রেফার্ড করেছি।’অপচিকিৎসার ঘটনায় গত ১৭জুন মো. জামান মিয়ার বাবা হাবিবুর রহমান বাদী হয়ে চিকিৎসক মফিজুর রহমান ফাহিম, হাসপাতালের পরিচালক রফিকুল ইসলাম, হান্নান মিয়া, ইজ্জত আলী ফকির, সুবলচন্দ্র দাস ও অজ্ঞাতপরিচয় এক চিকিৎসকসহ দুনার্সকে আসামি করে শ্রীপুর মডেল থানায় একটি মামলা দায়ের করেছেন। মামলা দায়ের হওয়ার পরদিন গাজীপুরের ভারপ্রাপ্ত সিভিল সার্জন ডা. সুভাষচন্দ্র সাহা তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি করেন। তদন্ত কমিটির প্রধান ছিলেন গাজীপুরের সিভিল সার্জন কার্যালয়ের মেডিক্যাল অফিসার (এমওসিএম) ডা. কামরুজ্জামান সুমন।গাজীপুরের ভারপ্রাপ্ত সিভিল সার্জন ডা. সুভাষচন্দ্র সাহা জানান, তদন্ত কমিটি পাঁচ কর্মদিবস পর গত বুধবার বিকেলে তাঁর কাছে প্রতিবেদন জমা দেন। প্রতিবেদনে হাসপাতালটির অপচিকিৎসার ভয়াবহ চিত্র ওঠে এসেছে। আজ-কালের মধ্যে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের কাছে তদন্ত প্রতিবেদনসহ হাসপাতালের সনদ বাতিলের জন্য সুপারিশ পাঠানো হচ্ছে।
তদন্ত কমিটি প্রতিবেদন জমা দেওয়ার পর গত বুধবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে শ্রীপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ সাদেকুর রহমান হাসপাতালটি সিলগালা করে দেন।
শ্রীপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও ম্যাজিস্ট্রেট সাদেকুর রহমান বলেন, ‘হাসপাতালটিতে চিকিৎসার কোন পরিবেশ নেই। নার্সদের নেই কোন প্রশিক্ষণ। চিকিৎসার নামে এই হাসপাতাল ঘিরে আরো অনেক অভিযোগও রয়েছে। চিকিৎসার কোন পরিবেশ না থাকায় তদন্ত কমিটির সুপারিশে হাসপাতালটি সিলগালা করে দেওয়া হয়েছে।’

ভুল অস্ত্রোপচারে তিন প্রসূতির মৃত্যুর অভিযোগঃ গত ২০১৩সালের ২৯মার্চ শ্রীপুরের মাওনা চৌরাস্তা বিল্লাল মাস্টার হাসপাতালে ডা. মফিজুর রহমান ফাহিমের অস্ত্রোপচারে লতিফা আক্তার(২২) নামে এক প্রসূতির মৃত্যু ঘটে। নিহত লতিফা আক্তার শ্রীপুর পৌর এলাকার উত্তরপাড়া গ্রামের বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী রিপন মিয়ার স্ত্রী। একই বছরের ১২মার্চ মাওনা জেনারেল হাসপাতাল ও মডার্ন ডায়াগনস্টিক সেন্টারে তাঁর অস্ত্রোপচারে মারা যান জেসমিন আক্তার(২৩) নামে আরো এক প্রসূতি। নিহত জেসমিন আক্তার শ্রীপুর পৌর এলাকার উজিলাব গ্রামের ব্যবসায়ী ফারুক মিয়ার স্ত্রী।
মাওনা চৌরাস্তার ভাড়ায়চালিত প্রাইভেটকার ব্যবসায়ী জামাল উদ্দিন অভিযোগ করেন, প্রায় দুবছর আগে মফিজুর রহমান ফাহিমের ভুল চিকিৎসায় আরো এক প্রসূতির মৃত্যু ঘটেছিল। প্রতিবারই প্রভাবশালীরা ঘটনার ধামাচাপা দিয়েছেন।
স্থানীয় অনেকেই অভিযোগ করেন, মফিজুর রহমান ফাহিম নিজেকে কখনো অর্থোপেডিক কখনো সার্জারি চিকিৎসক হিসেবে পরিচয় দেন। তিনি বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যা- ডেন্ডাল কাউন্সিলের (বিএমডিসি) নিবন্ধনকৃত চিকিৎসকও নন। তাঁর বাড়ি যশোরের ঝিকরগাছায় বলে জানা গেছে। তিনি কোথায় পড়ালেখা করেছেন তা জানা যায়নি।
তবে অভিযুক্ত মফিজুর রহমান ফাহিম বলেন, ‘আমি একজন অর্থোপেডিক চিকিৎসক। এছাড়া ল-ন থেকে আমি সার্জারির ওপর ডিগ্রি নিয়েছি। দুটো সনদই আমার কাছে রয়েছে।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *