ঢাকাঃ নারী পাচারে কাজ করে চক্রের তিন ইউনিট। দালাল থেকে শুরু করে মূলহোতা। মূলহোতাদের কবলে পৌঁছে গেলে সেখান থেকে সাধারণত আর ফেরা হয় না। বাংলাদেশ থেকে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে, ভারতে, মালয়েশিয়াতে পাচার করা হয় নারীদের। এমনকি এ দেশের পাহাড়ি নারীদের পাচার করা হচ্ছে চীনে। নারী পাচারের বিভিন্ন চক্র ছড়িয়ে রয়েছে সারা দেশে। এ রকম একটি চক্রের হোতা টিকটক হৃদয়, তাসলিমা বিউটি, নদী ও বাবু। এই চক্রের মূলহোতা নদী।
শতাধিক নারীকে বিভিন্ন দেশে পাচার করেছে এই চক্র। একেকজন নারীকে পাচার করতে দালালকে অর্ধলাখ টাকা দেয় নদী। তারপর নির্দিষ্ট স্থানে নিয়ে পতিতাবৃত্তির প্রস্তাব দেয়া হয়। রাজি না হলে নেমে আসে কঠোর নির্যাতন। অভুক্ত রাখা থেকে শুরু করে দলবেঁধে ধর্ষণ করা হয়। এমনকি গরম ছ্যাঁকা দেয় নদী ও তার সহযোগীরা। এভাবেই বাধ্য করা হয় বাসা বাড়ি থেকে হোটেলে পতিতাবৃত্তিতে। বেশ কয়েক নির্যাতিতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য।
মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগরের বাঘবাড়ি গ্রামের বাবুল সরদারের মেয়ে নদী আক্তার ওরফে ইতি। দেশে- বিদেশে বিভিন্ন নামে পরিচিত ২৮ বছর বয়সী এই তরুণী ভারতের ব্যাঙ্গালুরুতে গড়ে তুলেছে এক বিশাল গ্যাং। ভারতের কয়েক শহরের বিভিন্ন হোটেলে নারী সরবরাহ করে এই চক্র। এমনকি বেঙ্গালুরুর ইলেকট্রনিক সিটি এলাকা, আনন্দপুরা সার্কেল, ক্যাঙ্গারু বাসস্ট্যান্ড এলাকা, চেন্নাই ও কলকাতায় গড়ে তুলেছে মিনি পতিতালয়। একইভাবে দুবাইয়ে নারী পাচার করে এই চক্র। দুবাইয়ের হোটেল প্যারিস, ক্ল্যারিস, ক্যালিফোর্নিয়া, বেনতা, আল-রাজ, ডেরা ফরচুন, ফরচুন প্লাজা, ফুজিরা শহরের ক্লিপটন, তনি আজমান শহরের রেডিসন ব্লু, বৈশাখীসহ বিভিন্ন হোটেলের পার্টিতে এই চক্রের মেয়েরা অংশ নেয়। হোটেলে এমনকি বাসায় পতিতাবৃত্তিতে বাধ্য করা হয় তাদের। বিউটিশিয়ান ভিসা, ভ্রমণ ভিসায় সেখানে নেয়া হয় এসব মেয়েদের। নির্যাতিতার একজন মনোয়ারা বেগম (ছদ্মনাম)। তিনি জানান, গত বছরের শেষের দিকে নদী নিজেই ফেসবুকে যোগাযোগ করে তার সঙ্গে। ভারতে চাকরির প্রলোভন দেয়। সংসারের অভাব। লেখাপড়া বেশিদূর করা হয়নি। চাকরিটা খুব দরকার তার। এসব ভেবে নদীর প্রস্তাবে রাজি হন মনোয়ারা। নদী নিজেই ঢাকার মগবাজারে সাক্ষাৎ করে তার সঙ্গে। তারপর ঢাকা থেকে যশোরগামী বাসে তুলে দেয়। যশোর থেকে সাতক্ষীরা। ১৮ই ডিসেম্বর সাতক্ষীরা সীমান্ত দিয়ে এই চক্রের মেহেদি, বাবু, মহিউদ্দিন, সালাম সীমান্ত পার করে দেয়। ওপারে কয়েক হাত বদল হয়ে কয়েক ঘণ্টা পায়ে হেঁটে বকুল নামে একজনের বাসায় পৌঁছানো হয় মনোয়ারাকে। এই চক্রের ওপারের দালাল পলক মণ্ডল তাদের ভারতের আধার কার্ড তৈরি করে দেয়। সেখান থেকে তিনদিন পর পার্লারের কথা বলে মনোয়ারাকে ব্যাঙ্গালুরুর ইলেকট্রনিক সিটির এক বাসায় নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে ঘটে লোমহর্ষক নির্যাতনের ঘটনা। কিছুতেই রাজি হন না মনোয়ারা। নিজের সম্ভ্রম রক্ষা করতে আপ্রাণ চেষ্টা করেন। মারধর করা হয় তাকে। একপর্যায়ে জোরপূর্বক ধর্ষণ করা হয়। গ্যাং রেপ। মনোয়ারা অসুস্থ হয়ে গেলে পাঠানো হয় ক্যাঙ্গারু বাসস্ট্যান্ডে তাসলিমা বিউটির বাসায়। সেখানে অসুস্থ অবস্থাতেও যৌন নির্যাতন করা হয় তাকে। তারপর তাকে আনন্দপুরা সার্কেলের বাসায় নিয়ে যায় হৃদয় বাবু। সেখান থেকে কখনো হোটেলে কখনো বাসায়, কখনে ম্যাসাজ সেন্টারে পাঠানো হয়। দিনের পর দিন এভাবেই যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছিলেন বাংলাদেশি তরুণী। একপর্যায়ে অন্তঃসত্ত্বা হয়ে যান তিনি। গত ২রা মে ব্যাঙ্গালুরুর একটি ম্যাসাজ সেন্টার থেকে জানালা দিয়ে পালিয়ে কলকাতা হয়ে ৬ই মে ঢাকায় ফিরেন।
সম্প্রতি ভারতে বাংলাদেশি এক তরুণীকে যৌন নির্যাতনের ভিডিও ফাঁস হলে তদন্তে নামে দুই দেশের পুলিশ। এ ঘটনার পর ভারতে ১১ বাংলাদেশি ও এক ভারতীয় গ্রেপ্তার হয়েছে। এরমধ্যে ১০ জনই আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। বাংলাদেশে গ্রেপ্তার করা হয়েছে ১৩ জনকে। এরমধ্যে আটজন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। ডিএমপি’র হাতিরঝিল থানায় এ পর্যন্ত সর্বমোট পাঁচটি মানব পাচার মামলা হয়েছে। গত সোমবার রাতে যশোর থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে নদীসহ সাতজনকে। নদী সম্পর্কে পুলিশ জানিয়েছে, স্কুলের গণ্ডি না পেরুলেও দেখে বোঝার উপায় নেই নদীর শিক্ষার দৌড় কতটুকু। বাংলা, হিন্দি, ইংরেজি, তামিল, মালয় ও আরবি ভাষায় দক্ষ সে। একেক জায়গায় একেক নামে পরিচিত এই তরুণী। ভারতীয় আধার কার্ডে তার নাম জয়া আক্তার জান্নাত। পাসপোর্টে নূরজাহান, সাতক্ষীরার দালালদের কাছে জলি, যশোরে প্রীতি, দুবাইয়ে লায়লা নামে পরিচিত। ২০০৫ সালে শীর্ষ সন্ত্রাসী রাজিব হোসেনের সঙ্গে বিয়ে হয় তার। রাজিব ক্রস ফায়ারে মারা গেলে তিনি হাঁটেন অন্য পথে। ঢাকায় নাটক, সিনেমায় মুখ দেখাতে চেষ্টা করেছেন বেশ। পরিচয় হয় টিকটক হৃদয় বাবুর সঙ্গে। টিকটক হৃদয়, নদীরা বাংলাদেশি অসহায় মেয়েদের টার্গেট করে পাচার করতে থাকে বিভিন্ন দেশে। এই চক্রের হোতারা প্রায়ই মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে, ভারতে, মালয়েশিয়াতে আসা-যাওয়া করে।
তেজগাঁও বিভাগের পুলিশের উপ-কমিশনার (ডিসি) মো. শহিদুল্লাহ বলেন, চাকরির প্রলোভন দিয়ে যশোর সীমান্তের বিভিন্ন বাড়িতে রেখে সুযোগমতো নারীদের ভারতে পাচার করতো চক্রটি। এ ঘটনায় গ্রেপ্তারকৃতরা হচ্ছে নদী আক্তার ইতি (২৮), আল আমিন হোসেন (২৮), সাইফুল ইসলাম (২৮), আমিরুল ইসলাম (৩০), পলক মণ্ডল (২৬), তরিকুল ইসলাম (২৬) ও বিনাশ শিকদার (৩৩)। গ্রেপ্তারের পর আদালতে হাজির করে তাদের রিমান্ড চাইলে চারদিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত। গ্রেপ্তারকৃত নদী ও তার সহযোগীদের এ বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করার পর আরও তথ্য পাওয়া যাবে বলে জানান তিনি।