এক বিশ্ববিদ্যালয়ে দুই ভিসি

Slider শিক্ষা


একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যের (ভিসি) দায়িত্বে আছেন দুজন। এই দুজনই আবার ভারপ্রাপ্ত। তারা কেউ আচার্য ও রাষ্ট্রপতি থেকে মনোনীত নন। তাদের নিয়োগ দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের বোর্ড অব ট্রাস্টি। এই ট্রাস্টি বোর্ড গঠন নিয়েও রয়েছে অনিয়মের অভিযোগ। এমন ‘নজিরবিহীন’ ঘটনা ঘটেছে রাজধানীর বনানীতে অবস্থিত প্রাইমএশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে।

২০০৩ সালের ২৬ আগস্ট যাত্রা শুরু করে প্রাইমএশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়। প্রতিষ্ঠার পর আচার্য ও রাষ্ট্রপতির মাধ্যমে দুজন উপাচার্য দায়িত্ব পালন করেন। তারা হলেন অধ্যাপক গিয়াস উদ্দিন আহমেদ ও অধ্যাপক ড. আবদুল হান্নান চৌধুরী। অধ্যাপক আবদুল হান্নান চৌধুরী তার মেয়াদ শেষ করার তিন মাস আগে ২০২০ সালের অক্টোবরে বিশ্ববিদ্যালয়টি থেকে চলে যান।

অধ্যাপক ড. আবদুল হান্নান চৌধুরী বলছেন, নিজের ক্যারিয়ারের বিষয়টি মাথায় রেখে তিন মাস আগে প্রাইমএশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদ ছেড়ে চলে যান। বিশ্ববিদ্যালয়টির ট্রাস্টি বোর্ডে দুটি পক্ষ আছে বলেও জানান তিনি।

জানা গেছে, গত বছরের অক্টোবর থেকে প্রাইমএশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য হিসেবে দায়িত্বে রয়েছেন অধ্যাপক ড. ইঞ্জিনিয়ার মো. হুমায়ূন কবীর। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়টির উপ-উপাচার্য। বোর্ড অব ট্রাস্টি তাকে ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব দেন। তিনি সেই দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। এরই মধ্যে গত ৩১ মে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক মেসবাহ উদ্দিন আহমেদকে (মেসবাহ কামাল) প্রাইমএশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান উপদেষ্টা এবং ভারপ্রাপ্ত উপাচার্যের দায়িত্ব দেওয়া হয়। বিশ্ববিদ্যালয়টির বোর্ড অব ট্রাস্টি তাকে সেই দায়িত্ব দেয়। অধ্যাপক মেসবাহ উদ্দিন আহমেদ ওই দিনই বিশ্ববিদ্যালয়টিতে তার পদে যোগদান করেন।

সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, ‍অধ্যাপক মেসবাহ উদ্দিন আহমেদকে বিশ্ববিদ্যালয়টির ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব দেওয়ার আগে বা পরে ওই পদে থাকা অধ্যাপক ড. ইঞ্জিনিয়ার মো. হুমায়ূন কবীরকে অব্যাহতি দেওয়া হয়নি। তিনি ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য হিসেবে থাকাবস্থায় আরেকজন একই পদে এসে যোগদান করেছেন। তাই এখন মো. হুমায়ূন কবীর অফিস করছেন না।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে অধ্যাপক ড. ইঞ্জিনিয়ার মো. হুমায়ূন কবীর বলেন, ‘উনি (অধ্যাপক মেসবাহ উদ্দিন আহমেদ) এসে জয়েন করেছেন। আমি ভিসি (ভারপ্রাপ্ত) ছিলাম। উনি এসে জয়েন করলেন (ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য হিসেবে)। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম অনুযায়ী তো, আমি অব্যাহতি দেব, দেন আরেকজন নতুন এসে জয়েন করবে।’

গত ৩১ মে দায়িত্ব গ্রহণ করেন অধ্যাপক মেসবাহ উদ্দিন আহমেদ

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্বে থাকা ব্যক্তি কীভাবে উপাচার্যের দায়িত্ব পান, সেটা নিয়ে প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষকদের প্রশ্ন উঠেছে। এসব বিষয়ে বক্তব্য জানতে অধ্যাপক মেসবাহ উদ্দিন আহমেদকে তিনদিন একাধিকবার ফোন করা হয়। মুঠোফোনে খুদেবার্তা পাঠানো হয়। কিন্তু তিনি ফোন ধরেননি বা খুদেবার্তার কোনো উত্তর দেননি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সদস্য অধ্যাপক বিশ্বজিৎ চন্দ বলেন, মহামান্য রাষ্ট্রপতি ও আচার্য কর্তৃক মনোনিত কোনো উপ-উপাচার্য থাকলে তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া যায়। তিনি না থাকলে আচার্য কর্তৃক মনোনিত কোষাধ্যক্ষকে ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য করা যেতে পারে। এর বাইরে কাউকে ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য করার নিয়ম নেই।

ট্রাস্টি বোর্ড গঠন নিয়ে ‘অনিয়ম’

প্রাইমএশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে গিয়ে দেখা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে রয়েছে মো. নজরুল ইসলামের নাম। ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে রয়েছেন কে এম খালেদ ও মো. রায়হান আজাদ। এ ছাড়া বোর্ডের সদস্য হিসেবে রয়েছেন আরও ১১ জন।

‘প্রাইম ফাউন্ডেশন’ এবং প্রাইমএশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বোর্ড অব ট্রাস্টিজের সদস্য না হয়েও মো. রায়হান আজাদ হঠাৎ করেই প্রতিষ্ঠানটির ট্রাস্টি বোর্ডের ভাইস চেয়ারম্যান হয়েছেন। তিনি কীভাবে এই পদে এলেন, তা নিয়ে সংশ্লিষ্টদের মাঝে প্রশ্ন রয়েছে।

মো. নজরুল ইসলাম ‘অবৈধভাবে’ প্রাইমএশিয়া বিশ্ববিদ্যাল ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান হয়েছেন এবং বিশ্ববিদ্যালয়টি দখল করে নিয়েছেন বলে অভিযোগ আছে। এ সংক্রান্ত একটি অভিযোগ বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছেন ট্রাস্টের সেটেলার ও ফাউন্ডার চেয়ারম্যান এম এ ওহাবের ছেলে ওয়াহিদ মুরাদ জামিল। তিনিও ওই ট্রাস্টের সদস্য ছিলেন। গত বছরের ১ মার্চ তিনি এই অভিযোগ করেন।

ওই অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়, এম এ ওহাব প্রাইমএশিয়া বিশ্ববিদ্যালয় তথা ‘প্রাইম ফাউন্ডেশন’ এর উদ্যোক্তা সদস্য ও পরবর্তীতে চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্বরত ছিলেন। আমরা দুই ভাই ওয়াহীদ মুরাদ জামিল ও ওয়াহীদ মাহদুম খালেদ, এই ফাউন্ডেশনের সদস্য তথা প্রাইমএশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বোর্ড অব ট্রাস্টিজের সদস্য।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০১০ এর বিধান ও সরকার এর নির্দেশনা মতে, প্রাইমএশিয়া বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার জন্য ‘প্রাইমএশিয়া ইউনিভার্সিটি ট্রাস্ট’ নামে একটি ট্রাস্ট গঠন করা হয়। ওই ট্রাস্ট গঠনের সময় এম এ ওহাব ট্রাস্টের সেটেলার ও ফাউন্ডার চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন। পরে প্রাইমএশিয়া ইউনিভার্সিটি ট্রাস্টের ২০১৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর ষষ্ঠতম সভার মাধ্যমে উদ্যোক্তা সদস্য এম এ খালেককে ট্রাস্টের চেয়ারম্যান নির্বাচন করা হয়। পরে ২০১৮ সালের ১০ ডিসেম্বর ‘প্রাইমএশিয়া ইউনিটিভার্সিটি ট্রাস্ট’ এর ১৭তম সভার মাধ্যমে এম এ ওহাব ট্রাস্টের তথা বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।

জালিয়াতির মাধ্যমে ‘প্রাইমএশিয়া ইউনিটিভার্সিটি ট্রাস্ট’ এর রেজিস্ট্রেশন গ্রহণের অপচেষ্টার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়ে ওই অভিযোগপত্রে আরও উল্লেখ করা হয়, ট্রাস্টের দুজন সদস্যের সহযোগিতায় ‘প্রাইমএশিয়া ইউনিটিভার্সিটি ট্রাস্ট’ এর চেয়ারম্যানসহ আরও সাতজন বৈধ সদস্যদের অগ্রাহ্য করে ২০১৮ সালের ১৩ ডিসেম্বর ১৮তম সভার মাধ্যমে সম্পূর্ণ অবৈধভাবে নিজেকে ‘প্রাইমএশিয়া ইউনিটিভার্সিটি ট্রাস্ট’ এর চেয়ারম্যান ঘোষণা করেন মো. নজরুল ইসলাম। একইসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়টি দখল করে নেন। এ বিষয়ে আদালতে একটি মামলা করা হয়েছে।

উল্লেখ্য, ‘প্রাইমএশিয়া ইউনিটিভার্সিটি ট্রাস্ট’ এর চেয়ারম্যান এম এ ওহাব মারা যান ২০১৯ সালের ২৭ ডিসেম্বরে।

এ বিষয়ে ট্রাস্টি বোর্ডের বর্তমান চেয়ারম্যান হিসেবে থাকা মো. নজরুল ইসলামকে একাধিকবার ফোন করা হয়। পরে খুদেবার্তা পাঠানো হয়। কিন্তু তিনি উত্তর দেননি।

পরে প্রাইমএশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে থাকা মো. রায়হান আজাদকে ফোন করা হয় এবং খুদেবার্তা পাঠানো হয়। তিনি ফোন ধরেননি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *