বাংলাদেশে নির্যাতনের ঘটনায় চুপ থাকতে পারে না বিশ্ব

জাতীয়

বাংলাদেশে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য-প্রণোদিত সহিংসতা ও অন্যান্য নির্যাতনের ঘটনা অবসানের কোন লক্ষণ নেই। এসব সহিংসতা বিশ্ব আর উপেক্ষা করতে পারে না। যুক্তরাষ্ট্র, বৃটেনসহ কয়েকটি দেশ সহিংসতা অবসানের আহ্বান জানিয়েছে। প্রতিবেশী ভারতেরও উচিত বাংলাদেশে নির্যাতন বন্ধে আবার আহ্বান জানানো।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলসমূহের কাছে ভারতের মতামত গুরুত্বপূর্ণ। চলমান রক্তপাত বন্ধ না হলে অন্যান্য দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের বৈদেশিক সম্পর্কে প্রভাব পড়বে। গতকাল যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচের (এইচআরডব্লিউ) এক বিবৃতিতে এসব কথা বলা হয়েছে।

এতে আরও বলা হয়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীদের দায়মুক্তির রীতি দীর্ঘদিন ধরে প্রচলিত বাংলাদেশে। এর ফলে আইনের শাসন ভেঙে পড়ছে। রক্তপাত হচ্ছে রাজপথে। নিরাপত্তা রক্ষাকারীদের জানা উচিত, মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে তাদের জবাবদিহি করতে হবে। এতে আরও বলা হয়, বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষের নিশ্চিত করা উচিত, এ পরিস্থিতিতে তাদের জবাব যেন সকলের অধিকারের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে হয়। যথেচ্ছ বল প্রয়োগ, ঢালাও গ্রেপ্তার এবং গুম পরিহার করার বিষয়গুলো নিশ্চিত করা উচিত।

একইসঙ্গে, দলের সমর্থকরা যেন বেআইনিভাবে সহিংসতার আশ্রয় না নেয়, তা নিশ্চিত করতে সব রাজনৈতিক দলের স্পষ্ট বিবৃতি দেয়া উচিত। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়া অঞ্চলের পরিচালক ব্র্যাড এডামস বলেছেন, সহিংস অপরাধের ধারাবাহিকতা বন্ধে ও সব ধরনের অপরাধ কর্মকাণ্ডের জন্য দায়ীদের খুঁজে বের করে তাদের গ্রেপ্তার ও বিচার নিশ্চিত করতে সব পক্ষের সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়া উচিত।

তিনি বলেন, বিরোধী দলের কয়েকজন সদস্যের সহিংস কর্মকাণ্ডের জবাবে সরকার পক্ষের হত্যাকাণ্ড, জখম ও অনৈতিক গ্রেপ্তারের ঘটনাসমূহকে ন্যায্যতা প্রদান করে না। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশে নির্যাতনের ঘটনা বিশ্ব আর উপেক্ষা করতে পারে না। গত মাসে দেশজুড়ে প্রায় ৬০ জন নিহত হয়েছেন। শ’ শ’ মানুষ আহত হয়েছেন। হাজার হাজার মানুষকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

বিবৃতিতে বলা হয়, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে সৃষ্ট সহিংসতা ও অন্যান্য মানবাধিকার লঙ্ঘনের দৃশ্যত যেন শেষ নেই। গত বছরের বিতর্কিত নির্বাচনের বর্ষপূর্তিতে প্রতিবাদ কর্মসূচি নিয়ে সহিংসতা আর সরকারি নিরাপত্তা অভিযান শুরু হয়েছে এ বছর জানুয়ারির শুরুতে। বিরোধীদের বর্জনের মধ্য দিয়ে ওই নির্বাচনে ভূমিধস বিজয় অর্জন করে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। সহিংসতা নিয়ন্ত্রণে আনতে সরকারের কৌশল পূর্বের নিয়ম লঙ্ঘনের সঙ্গে মিলে যায়। এর মধ্যে রয়েছে ঢালাও গ্রেপ্তার, হত্যাকাণ্ড আর গুম।

ভয়াবহ পেট্রলবোমা হামলা সহ বিরোধীদের সহিংসতার বর্তমান ধারাবাহিকতা অতীতে এইচআরডব্লিউ’র পর্যবেক্ষণের মতো একই ধারা অনুসরণ করছে। ২০১৪ সালে নির্বাচন সংশ্লিষ্ট সহিংসতায় ৫ শতাধিক মানুষ নিহত হয়েছিল। এইচআরডব্লিউ’র দৃষ্টিতে বাংলাদেশে সহিংসতার অন্যতম ভয়াবহ একটি দিক হলো পেট্রলবোমা হামলা। হরতাল-অবরোধের মধ্যে চলাচল করতে গিয়ে যানবাহনগুলো নির্বিচারে ছোড়া এসব বোমার শিকার হয়। বেশির ভাগ বাংলাদেশী যেহেতু প্রত্যহ আয়ের ওপর নির্ভরশীল, তাই এসব হামলার ঝুঁকি নিয়ে তারা কাজে বের হন।

বিবৃতিতে সহিংস একাধিক পেট্রলবোমা হামলার ঘটনা উল্লেখ করা হয়। এসব হামলায় একাধিক মানুষ নিহত ও আহত হয়েছেন। বিরোধী সদস্যদের হাতে ৪১ জন নিহত হয়েছেন বলে উল্লেখ করেছেন মানবাধিকার কর্মীরা। এর অনেকেই বোমা হামলার শিকার। এছাড়াও কয়েক শ’ মানুষ আহত হয়েছেন। সাংবাদিকরা বলছেন, ঢাকার হাসপাতালগুলোর সব বার্ন ইউনিটে ধারণ ক্ষমতা ছাড়িয়ে গেছে রোগীতে।

উভয় রাজনৈতিক দলের নেতৃত্ব ধারাবাহিতভাবে একে অপরকে দোষারোপ করছে। নিজেদের দায়ভার অস্বীকার করছে। উদাহরণস্বরূপ, ৫ই ফেব্রুয়ারি বিরোধী দল বিএনপির নেত্রী খালেদা জিয়া সহিংসতার নিন্দা জানান। তার দল এসব হামলায় সম্পৃক্ত এমন বিশ্বাসযোগ্য অভিযোগ সত্ত্বেও তিনি আওয়ামী লীগের সদস্যদের ওপর পুরো দোষ চাপিয়ে দেন। অন্যদিকে, ১৭ জন নিহত হয়েছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে। এদের বেশির ভাগই বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী বা তাদের ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মী।

সচরাচর যেমনটা হয়ে থাকে, পুলিশ বলছে, এসব মৃত্যুর অনেকগুলো ঘটেছে ক্রসফায়ার বা শুটআউটের সময়। কয়েকটি ক্ষেত্রে, পুলিশ স্রেফ গুলিবিদ্ধ মৃতদেহ পাওয়ার রিপোর্ট দিচ্ছে অথচ পরিবারের সদস্যরা বলছে, হামলার শিকার ব্যক্তিকে সর্বশেষ নিরাপত্তা বাহিনী গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়। সরকার এসব অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ বন্ধে বা এর তদন্ত ও দোষীদের বিচারের আওতায় আনতে কোন পদক্ষেপ নেয় নি। উল্টো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, এসব পেট্রলবোমা হামলা বন্ধে যখন যা প্রয়োজন তেমন পদক্ষেপ নিতে তিনি নিরাপত্তা বাহিনীকে কর্তৃত্ব দিয়েছেন।
তার কার্যালয় থেকে এ বার্তা আসাটা শুধুমাত্র অতিরিক্ত বলপ্রয়োগে নিরাপত্তা বাহিনীগুলোকে অনুপ্রাণিত করবে।
ব্র্যাড এডামস বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করা এবং নাগরিকদের নিরাপত্তা বিধানের দায়িত্ব সরকারের। কিন্তু, নিরাপত্তা বাহিনীসমূহের জানা উচিত যে, মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য তাদের জবাবদিহি করতে হবে। তিনি আরও বলেন, অপরাধ নিয়ন্ত্রণে নিরাপত্তা বাহিনীকে অতিরিক্ত বল প্রয়োগের অনুমতি দেয়ার দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে বাংলাদেশের। আর এতে আইনের শাসন ভেঙে পড়ছে। এতে রক্তে রঞ্জিত হচ্ছে রাজপথ। নিরাপত্তা বাহিনীগুলো মুখ্য কিছু নেতা সহ প্রধান বিরোধী দলগুলোর ৭ সহস্রাধিক সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে।

বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়াকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলার পদক্ষেপও নিয়েছে সরকার। তাকে ৩রা জানুয়ারি থেকে দু’সপ্তাহের বেশি তার কার্যালয়ে কার্যত গৃহবন্দি করে রাখা হয়। যদিও সেখানকার নিরাপত্তা বেষ্টনী আর গেটের তালা খুলে দেয়া হয়েছে, সরকার ৩১শে জানুয়ারি-১লা ফেব্রুয়ারি তার কার্যালয়ের বিদ্যুৎ ও ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। এছাড়া, সরকার তার বিরুদ্ধে অগ্নিসংযোগ সংক্রান্ত মৃত্যুর জন্য হত্যা মামলা দায়ের করার হুঁশিয়ারি দিয়েছে। যা তাকে গ্রেপ্তারের পথ করে দেবে। সরকার এছাড়াও জামায়াতে ইসলামীর অনেক নেতা এবং শ’ শ’ সমর্থককে গ্রেপ্তার করেছে। অনেকে গ্রেপ্তারের ভয়ে আত্মগোপনে রয়েছেন।

বিবৃতির শেষে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য সহ কয়েকটি দেশ সহিংসতা অবসানের আহ্বান জানিয়েছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে ভারতের মতামত গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিবেশী এ দেশটিরও উচিত নির্যাতন বন্ধে তাদের আহ্বান পুনর্ব্যক্ত করা। ব্র্যাড এডামস বলেন, বাংলাদেশে এসব নির্যাতন বিশ্ব আর উপেক্ষা করতে পারে না। রাজনৈতিক নেতৃত্বকে কঠোরভাবে এ বার্তা কর্ণগোচর করতে হবে যে, এ রক্তপাত বন্ধ না হলে, অন্য দেশের সঙ্গে তাদের সম্পর্কের ওপর প্রভাব পড়বে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *