সরকারি নথি চুরির অভিযোগের মামলায় প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক রোজিনা ইসলাম গ্রেপ্তারের বিরুদ্ধে সরব সব স্তরের সাংবাদিকরা। পাশাপাশি সরকারের কয়েকজন মন্ত্রীও রোজিনা ইসলামের ওপর অন্যায় করা হয়েছে উল্লেখ করে ন্যায়বিচারের আশ্বাস দিয়েছেন। সেখানে রোজিনা ইসলামের ভার্চুয়ালি জামিন শুনানির বিরোধিতা করতে গিয়ে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী রোজিনা ইসলামকে ঘষেটি বেগমের সঙ্গে তুলনা করেছেন।
আজ বৃহস্পতিবার ঢাকা মহানগর হাকিম বাকী বিল্লাহর ভার্চুয়াল আদালতে রোজিনা ইসলামের জামিন শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। রোজিনা ইসলামের পক্ষে সিনিয়র আইনজীবী এহেসানুল হক সমাজী, প্রশান্ত কুমার কর্মকার, ব্যারিস্টার জ্যোর্তিময় বড়ূয়া, আমিনুল গণি টিটো প্রমুখ আইনজীবী জামিন শুনানি করেন।
শুনানিতে রোজিনার আইনজীবী সমাজী বলেন, রোজিনা ইসলামের কাছ থেকে কি ডকুমেন্টস জব্দ করা হয়েছে তার কোনো বর্ণনা নেই এজাহারে। তার কাছ থেকে কোনো ডকুমেন্টস উদ্ধার বা জব্দ করা হয় নাই। তাই অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট অনুযায়ী ১৯২৩ সালের ৩ ধারা এঘটনার সঙ্গে যায় না। এটা একটি জামিনযোগ্য মামলা। তিনি একজন নারী, সেই সাথে অসুস্থ। তাই তাকে জামিন দেওয়া হোক। তিনি জামিনের কোনো অপব্যবহার করবেন না। তিনি বলেন, তার বিরুদ্ধে এই মামলাটি সাজানো, মিথ্যা এবং বানোয়াট। বিগত ৫০ বছরের মধ্যে কোনো সাংবাদিকের বিরুদ্ধে এ ধরনের মামলা হয় নাই।
আইনজীবী আমিনুল গনি টিটো বলেন, রোজিনা ইসলামকে স্বাস্থ্য মন্ত্রীর বিরুদ্ধে লেখা-লেখি ও ভ্যাকসিনের বিষয়ে জাতীয়ভাবে তুলে ধরার কারণে তাকে শত্রু মনে করেন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীসহ সকল কর্মকর্তাগণ। তাকে ফাঁসানো হয়েছে। তিনি ঘটনার সাথে জড়িত নন। তাই যে কোনো শর্ত ছাড়া রোজিনা ইসলামের জামিন মঞ্জুর করা হোক।
ব্যারিস্টার জ্যোর্তিময় বড়ুয়া বলেন, রোজিনা ইসলামের কাছ থেকে কি ডকুমেন্টস উদ্ধার করা হয়েছে সে বিষয়ে কোনো অভিজ্ঞতাই নাই। যাই হোক তিনি অসুস্থ, তাই বিশেষভাবে অনুরোধ করছি তার জামিন বিবেচনা করার জন্য।
রাষ্ট্রপক্ষে অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর তাপস কুমার পাল, সহকারী পাবলিক প্রসিকিউটর হেমায়েত উদ্দিন খান হিরণ ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পাঠানো আইনজীবী আসাদুজ্জামান জামিনের বিরোধীতা করেন।
তাদের মধ্যে হেমায়েত উদ্দিন খান হিরণ বলেন, রোজিনা ইসলাম নারী বিবেচনায় জামিন পেতে পারেন না। ঘষেটি বেগমও মহিলা ছিলেন। পলাশীর প্রান্তরে দেশপ্রেমিক নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ের প্রধান কারণ ছিলেন ঘষেটি বেগমের চরিত্রটি। ঘষেটি বেগম, মীর জাফরের বিশ্বাসঘাতকতার কারণেই সেদিন পলাশীর যুদ্ধে সিরাজউদ্দৌলাকে পরাজয় বরণ করতে হয়। আজকের এই অভিযুক্ত নারী সাংবাদিক রোজিনা ইসলাম ঘষেটি বেগমের মতো রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ নথি চুরি করে সরকারকে বিব্রত করতে, বেকায়দায় ফেলতে ঘষেটি বেগমের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। যে কারণে তার জামিন নামঞ্জুরের প্রার্থনা করছি।
উভয়পক্ষের শুনানি শেষে আদালত আদেশ অপেক্ষমান রাখেন এবং বিকেল ৪টায় জানানো হয় আদেশ আগামী রোববার দেওয়া হবে।
এদিকে, শুধু জামিন শুনানিতেই নয়, সাংবাদিকদের সাথে কথা বলতে গিয়ে সেখানেও রোজিনা ইসলামকে ঘষেটি বেগমের সাথে তুলনা করেন হেমায়েত উদ্দিন খান হিরণ। এ সময় সেখানে উপস্থিত সাংবাদিকেরা এর তীব্র প্রতিবাদ করেন। তার এ ধরনের বক্তব্য এক্সপাঞ্চ করতে বলেন সাংবাদিকরা। তবে তিনি তা করেননি।
এর আগে গত মঙ্গলবার রোজিনা ইসলামের পাঁচ দিনের রিমান্ড আবেদন নামঞ্জুর করে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়। একইসঙ্গে জামিন আবেদনের বিষয়ে অধিকতর শুনানির জন্য আজ বৃহস্পতিবার দিন ধার্য করে আদালত।
উল্লেখ্য, গত সোমবার বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে রোজিনা ইসলাম পেশাগত দায়িত্ব পালনের জন্য সচিবালয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে যান। স্বাস্থ্য সচিবের পিএস সাইফুল ইসলামের রুমে ফাইল থেকে নথি সরানোর অভিযোগে তাকে ওই রুমে আটকে রাখা হয় এবং তার মোবাইল ফোন কেড়ে নেওয়া হয়। একপর্যায়ে সেখানে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন।
রোজিনা ইসলামকে আটকে রাখার খবর পেয়ে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের সাংবাদিকরা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে যান। তারা দীর্ঘ সময় ধরে রোজিনাকে আটকে রাখার কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলেও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা কিছুই জানাননি। পরে রাত সাড়ে ৮টা পর্যন্ত সাংবাদিকরা সচিবালয়ের বাইরে জড়ো হয়ে রোজিনা ইসলামকে হেনস্তা ও আটকে রাখার প্রতিবাদ করেন।
রাত সাড়ে ৮টার দিকে রোজিনা ইসলামকে স্বাস্থ্য সচিবের পিএসের রুম থেকে থেকে বের করে শাহবাগ থানায় নিয়ে যায় পুলিশ। এরপর মধ্য রাতে তার বিরুদ্ধে চুরি ও অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টে মামলা করা হয়।