করোনাকালে লাগামহীন হয়ে উঠছে চিকিৎসায় ব্যয়। সরকারি হাসপাতালের চেয়ে অনেক বেশি ব্যয় হচ্ছে বেসরকারি হাসপাতালে। বেসরকারি হাসপাতালগুলোর আকাশছোঁয়া চিকিৎসা ব্যয়ে লাগাম টেনে ধরা উচিত বলে মনে করেন ভুক্তভোগী অনেক রোগী ও অভিভাবকরা। একই সাথে সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসাসেবার সম্প্রসারণ করাও জরুরি বলে উল্লেখ করে তারা বলছেন, আর্থিক সীমাবদ্ধতার জন্য বেসরকারি হাসপাতালে যাওয়ার আগ্রহ তাদের ছিল না, সরকারি হাসপাতালে সিট না পেয়ে যেতে হয়েছে। করোনার এই সময়ে অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত লোকদের চিকিৎসাব্যয় কমিয়ে আনতে সরকারের পদক্ষেপ কামনা করেছেন রোগী ও তাদের অভিভাবকেরা।
বেসরকারি হাসপাতালগুলো মধ্যে যাদের একটু নামডাক রয়েছে তাদের দুয়েকটি ব্যতিক্রম ছাড়া চিকিৎসা খরচ আকাশছোঁয়া। করোনা রোগী হলেই দেখা যায় অতি মাত্রায় ওষুধের ব্যবহার, অতিরিক্ত টেস্ট, অক্সিজেনের ব্যবহার। এ ছাড়া প্রয়োজন না থাকলেও আইসিইউতে ভর্তি করার একটা প্রবণতা লক্ষ করা যায়। রোগীর স্বজনদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, সরকারি হাসপাতালের চেয়ে বেসরকারিতে অক্সিজেনের দাম অনেক বেশি রাখা হচ্ছে।
পান্থপথ গ্রিন রোডের আশপাশে গড়ে উঠেছে বেশ কিছু বেসরকারি হাসপাতাল। বাইরের চাকচিক্য রোগী ও তাদের স্বজনদের আকৃষ্ট করলেও দুই থেকে তিন দিন থাকলেই চরম অব্যবস্থাপনায় হাঁপিয়ে ওঠে। প্রতিদিন ২০ থেকে ৪০ হাজার টাকা বিল উঠে এখানে কোনো করোনা রোগী ভর্তি করলে। কোনো কোনো সময় এর চেয়ে বেশি বিলও ওঠে। কেবিনে ভর্তি হলে প্রতিদিন ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকা এবং আইসিইউতে ৮০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা পর্যন্ত বিল আসে।
পান্থপথ ও গ্রিন রোডের হাসপাতালগুলোর করোনা আক্রান্ত রোগীদের আইসিইউতে পাঠানোর একটি সাধারণ মাপকাঠি হলো ১৫ লিটারের বেশি অক্সিজেন লাগলেই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ রোগীকে আইসিইউতে পাঠিয়ে দিচ্ছে। আইসিইউতে রোগী ভর্তি করা হলেই প্রতিদিন কিছু পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করা হয়। এ বিষয়টি নিয়ে হাসপাতালগুলোর কর্তৃপক্ষের বক্তব্য জানতে চাইলে তারা নানা কিছু বলে বিষয়টি এড়িয়ে যায়, কথা বলতে চায় না।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, করোনাকালে উপায়ন্তর না পেয়ে পুরো চিকিৎসা না করেই বেসরকারি হাসপাতাল ছেড়ে যাওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। গ্রিন রোডের একটি হাসপাতালে বেসরকারি কোম্পানির একজন কর্মকর্তা শরীফ উদ্দিন ভর্তি হয়েছিলেন। বাসাবো এলাকায় বসবাসকারী শরীফ উদ্দিন এপ্রিলের মাঝামাঝিতে করোনায় আক্রান্ত হয়ে সরকারি হাসপাতালে ভর্তি হতে না পেরে বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। সাত দিন ওই হাসপাতালে থেকে যে বিল হয়েছে তা দেখে শরীফ উদ্দিন ও তার স্বজনরা পরদিন পুরোপুরি সুস্থ না হয়েই বাসায় ফিরে যেতে হয়। সিদ্ধেশ্বরী এলাকার একটি হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছে নাসিমা খাতুন নামে মেরুল বাড্ডার পঞ্চাশোর্ধ্ব নারীকে। নি¤œ বেতনে চাকরি করা তার স্বামীর পক্ষে শেষ পর্যন্ত তার চিকিৎসা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। ওই হাসপাতালে তিনি ছিলেন ৯ দিন। পুরোপুরি সুস্থ হতে তাকে আরো ৫ থেকে ৬ দিন থাকার প্রয়োজন ছিল। এর মধ্যে তার বিল হয় ৭ লাখ টাকা। এই বিলের পুরোটাই তার স্বামী দিতে পারেননি। পরে দেবেন এমন একজনের নিশ্চয়তায় তাকে হাসপাতাল থেকে নিয়ে আসা হয় বাসায়। এমন ঘটনা বেসরকারি হাসপাতালে অহরহ ঘটছে।
বেসরকারি হাসপাতালের লাগামহীন চিকিৎসাব্যয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের গবেষণাতেও উঠে এসেছে। করোনা রোগী ব্যবস্থাপনায় ব্যয়ের আনুমানিক হিসাব বের করাই গবেষণার উদ্দেশ্য ছিল। গবেষকরা ঢাকা শহরের প্রধান চারটি সরকারি করোনা হাসপাতাল এবং দু’টি বড় বেসরকারি হাসপাতালের সাধারণ শয্যার ৩১ হাজার ১৪৭ জন এবং আইসিইউতে ভর্তি ২ হাজার ৯১৮ জন রোগীর ব্যয় বিশ্লেষণ করেছেন। সরকারি করোনা হাসপাতালে সাধারণ শয্যার একজন রোগীর চিকিৎসায় ব্যয় গড়ে ১ লাখ ২৮ হাজার টাকা হচ্ছে বলে গবেষণায় উঠে এসেছে। গবেষণা অনুসারে সরকারি হাসপাতালের তুলনায় বেসরকারি হাসপাতালের ব্যয় দেড় থেকে দুই গুণ বেশি।
গবেষকেরা বলছেন, গত বছরের এপ্রিল থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত চারটি সরকারি হাসপাতালে করোনা রোগীদের জন্য খরচ হয়েছিল ৪৬৬ কোটি ৭ লাখ টাকা। ব্যয়ের মধ্যে ছিল যন্ত্রপাতি, চিকিৎসক-নার্সসহ কর্মকর্তা-কর্মচারী ও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীর বেতন-ভাতা, তাদের হোটেল ভাড়া, যাতায়াত ও খাওয়ার খরচ, ওষুধ, রোগ নির্ণয় পরীক্ষা, অক্সিজেন সরবরাহ, পিপিই, হ্যান্ডস্যানিটাইজার, রোগীর খাবার, বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানি, লন্ড্রি, ফোন, ইন্টারনেট ও পরিচ্ছন্নতার কাজে। এর মধ্যে ৬০ দশমিক ১ শতাংশ ব্যয় হয়েছে চিকিৎসক-নার্সসহ কর্মকর্তা-কর্মচারী ও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীর বেতন-ভাতা, তাদের হোটেল ভাড়া, যাতায়াত ও খাওয়া বাবদ। অর্থাৎ প্রায় ২৮০ কোটি টাকা খরচ হয় চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের পেছনে।
অন্য দিকে দু’টি বেসরকারি হাসপাতালে সাধারণ শয্যায় ৫৬৩ জন এবং ২১৮ জন আইসিইউ রোগীর আত্মীয়রা খরচ করেছিলেন ২৪ কোটি ৭৩ লাখ টাকা। এর ৫ দশমিক ৭ শতাংশ চিকিৎসক-নার্সসহ কর্মকর্তা-কর্মচারী ও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীর জন্য ব্যয় করেছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। সরকারি হাসপাতালে ওষুধ ও রোগ নির্ণয় খাতে খরচ হয় যথাক্রমে ১৫ দশমিক ৮ শতাংশ ও ২ দশমিক ৪ শতাংশ। বেসরকারি হাসপাতালে এই হার যথাক্রমে ৩০ ও ১৭ দশমিক ৭ শতাংশ।
গবেষকরা দেখেছেন, বেসরকারি হাসপাতালে রোগীর গড় অবস্থানকাল সরকারি হাসপাতালের চেয়ে কম। সরকারি হাসপাতালে সাধারণ শয্যায় একজন রোগী গড়ে চিকিৎসা নেন ১০ দিন। বেসরকারি হাসপাতালে ৬ দশমিক ৫২ দিন। একইভাবে সরকারি হাসপাতালে আইসিইউতে একজন রোগী গড়ে চিকিৎসা নেন ৮ দিন, বেসরকারি হাসপাতালে গড় অবস্থানকাল ৭ দশমিক ৩৯ দিন। তবে সরকারি হাসপাতালের তুলনায় বেসরকারি হাসপাতালের আইসিইউতে রোগী ভর্তি করানোর প্রবণতা বেশি।
তবে বেসরকারি হাসপাতালে দৈনিক গড় খরচও বেশি। সরকারি হাসপাতালে সাধারণ শয্যা ও আইসিইউতে দৈনিক গড় খরচ যথাক্রমে ১২ হাজার ৮১১ টাকা এবং ৫১ হাজার ৬ টাকা। বেসরকারি হাসপাতালে দুই ধরনের শয্যায় দৈনিক গড় খরচ যথাক্রমে ৩৭ হাজার ১২৮ টাকা এবং ৬৮ হাজার ৮৮৫ টাকা।
চীনের ৭০ জন রোগীর খরচ নিয়ে গবেষণার তথ্য আছে বাংলাদেশের এই গবেষণা প্রবন্ধে। তাতে দেখা যাচ্ছে, চীনে গড়ে একজন রোগীর জন্য ব্যয় হয়েছে ৬ হাজার ৮২৭ মার্কিন ডলার বা ৫ লাখ ৮০ হাজার ২৯৫ টাকা। এর মধ্যে ওষুধের জন্য খরচ হয় ৪৫ শতাংশ, আর পরীক্ষা-নিরীক্ষার খরচ ১৯ শতাংশ। তবে দীর্ঘস্থায়ী রোগে ভোগা ব্যক্তিরা করোনায় আক্রান্ত হলে তাদের জন্য খরচ হয়েছে বেশি, প্রায় ৮ লাখ ১০ হাজার টাকা।
এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ বলেন, করোনাকালে মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থা খুবই খারাপ। এই অবস্থায় সরকার বেসরকারি হাসপাতালগুলোর ক্যাটাগরি (এক্রিডিটেশন) অনুযায়ী দাম নির্ধারণ করে দেয়া উচিত। সে অনুযায়ী প্রতিটি হাসপাতালে শয্যা ভাড়া, কোন পরীক্ষা কী দাম, চিকিৎসকদের কনসালটেশন ফি টানিয়ে দিতে পারে। এতে রোগী অথবা রোগী অভিভাবকেরা হিসাব করে নিতে পারবেন ওই হাসপাতালে চিকিৎসা নিলে তাদের কী রকম খরচ হতে পারে। এটা করলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকবে না।
অধ্যাপক সৈয়দ আব্দুল হামিদ বলেন, করোনাকালে সরকার হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে বলতেই পারে এ সময় মুনাফা না করতে। বেসরকারি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে করসুবিধা দিয়ে করোনাকালে সরকার একটি চুক্তিতেও যেতে পারে যেন জনসাধারণ সরকারি হাসপাতালের মতোই বেসরকারি হাসপাতালে সুলভে চিকিৎসাসুবিধা পায়।
সরকারের বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে স্বল্প বরাদ্দের কারণে সরকারি খাতে চিকিৎসাসেবা প্রয়োজন অনুপাতে সম্প্রসারণ করা যাচ্ছে না। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ন্যাশনাল হেলথ অ্যাকাউন্টের তথ্য দেখা যাচ্ছে, স্বাস্থ্য খাতে জিডিপির মাত্র ০.৬৯ শতাংশ খরচ করে বাংলাদেশ সরকার। ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির স্কুল অব পাবলিক হেলথের ড. মোশতাক চৌধুরী গণমাধ্যমকে বলেন, ‘বাংলাদেশের জিডিপির পয়েন্ট ফোর পার্সেন্ট সরকারের হেলথ প্রোগ্রামে দেয়া হয়। এটা পৃথিবীর সবচেয়ে কম। শ্রীলঙ্কাতেও তারা আমাদের চার গুণ বরাদ্দ দেয়। এটা তো জানা বিষয় যে আমাদের পাবলিক হেলথ সেক্টরটা গত তিন চার দশকে অবহেলার মধ্য দিয়ে গেছে।’