অক্সিজেন সংকটের আশঙ্কা

Slider টপ নিউজ

করোনা রোগীদের অন্যান্য উপসর্গের মধ্যে শ্বাসকষ্ট অন্যতম। যেসব রোগীর শ্বাসকষ্ট সহনীয় মাত্রায় থাকে, তাদের শ্বাস গ্রহণের জন্য অক্সিজেন নেয়ার প্রয়োজন হয় না। কিন্তু যাদের শ্বাসকষ্টের মাত্রা অনেক বেড়ে যায়, তাদের শ্বাসযন্ত্র সচল রাখতে বাইরে থেকে অক্সিজেন সরবরাহ করতে হয়। এটি কেবল করোনায় আক্রান্ত রোগী নন, আরো অনেক গুরুতর রোগীর জন্য অক্সিজেন সরবরাহ জরুরি হয়ে পড়ে। করোনা সংকট শুরু হওয়ার আগে হাসপাতালগুলোতে যে পরিমাণ অক্সিজেন লাগতো, বর্তমানে তার চাহিদা বহুগুণ বেড়ে গেছে।

এদিকে, দেশে যেকোনো সময় অক্সিজেনের ভয়াবহ সংকট সৃষ্টি হতে পারে। বন্ধ হয়ে যেতে পারে মেডিকেল গ্রেড অক্সিজেনের মূল জোগানদাতা লিন্ডের দু’টি প্ল্যান্ট। পাশাপাশি করোনা পরিস্থিতিতে ভারতে অক্সিজেনের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় দেশটি অক্সিজেন রপ্তানি বন্ধ করে দিতে পারে।
এসব আশঙ্কা বাস্তবে রূপ নিলে চলমান করোনা সংক্রমণে প্রতিদিন যে পরিমাণ অক্সিজেনের প্রয়োজন তার চার ভাগের এক ভাগও সরবরাহ করা সম্ভব হবে না। ভয়াবহ সমস্যায় পড়তে পারেন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন কোভিড রোগীরা। সমপ্রতি অক্সিজেন সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষ থেকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে এসব তথ্য জানানো হয়েছে।

প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, দেশে বর্তমানে অক্সিজেনের চাহিদা ১৫০ টন। এর মধ্যে লিন্ডে ও স্পেক্ট্রা সরবরাহ করছে যথাক্রমে ৮০ এবং ৩৮ টন। সম মিলিয়ে ১১৮ টন। কিন্তু লিন্ডের দু’টি ইউনিট যেকোনো সময় বন্ধ হয়ে যেতে পারে। সেজন্য অধিদপ্তর ৩টি নতুন উৎসের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। এসব উৎস থেকে পাওয়া যাবে মোট ৭৫ টন। তবে বর্তমানে এই ৩টি প্রতিষ্ঠান মাত্র ৩৫ টন অক্সিজেন দিতে পারবে বলে জানিয়েছে। এর মধ্যে আবুল খায়ের স্টিল মেল্টিং লি. দৈনিক ৭ টন, ইসলাম অক্সিজেন ২০ টন এবং এ কে অক্সিজেন লি. ৮ টন সরবরাহ করতে পারবে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কোভিড পরিস্থিতির আগে দেশে দৈনিক ১০০ টন মেডিকেল গ্রেড অক্সিজেনের চাহিদা ছিল। কোভিড রোগীদের সংখ্যা বাড়ায় হাইফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা, ভেন্টিলেটর ও আইসিইউ’র চাহিদা অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়ায় অক্সিজেনের চাহিদা বাড়ছে, যা বর্তমানে ১৫০ টনে পৌঁছেছে। এই চাহিদা আরো বাড়তে পারে।
লিন্ডে বাংলাদেশে সব সরকারি হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনীয় অক্সিজেনের বড় অংশ সরবরাহ করে। এর মধ্যে নারায়ণগঞ্জে অবস্থিত প্ল্যান্ট থেকে ৬০ টন এবং চট্টগ্রামে অবস্থিত প্ল্যান্ট থেকে ২০ টন অক্সিজেন উৎপাদন করে। ২০২০-এর ১১ই ডিসেম্বর লিন্ডের নারায়ণগঞ্জে অবস্থিত প্ল্যান্টের কমেপ্রসারের মোটর পুড়ে যায়। ফলে অক্সিজেন উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। বর্তমানে এই কারখানা চালু আছে। অন্যদিকে চট্টগ্রামের প্ল্যান্ট যেকোনো সময় বন্ধ হয়ে যেতে পারে বলে তারা জানিয়েছে। গত ৩ থেকে ১২ই ডিসেম্বর পর্যন্ত এই প্ল্যান্ট বন্ধ ছিল।

অন্যদিকে স্পেক্ট্রা অক্সিজেন লি. প্রতিদিন ৩৮ টন অক্সিজেন সরবরাহ করছে। তারা স্থানীয়ভাবে ২০ টন এবং ভারত থেকে ১৮ টন আমদানি করছে। সেখানে আরো বলা হয়, ভারত থেকে লিকুইড অক্সিজেন আনা সময়সাপেক্ষ হওয়ায় এবং সাপ্তাহিক ছুটির দিনে পরিবহন বন্ধ থাকায় অক্সিজেনের সংকট তৈরি হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এ ছাড়া লিন্ডের দু’টি প্ল্যান্টই যেকোনো মুহূর্তে বন্ধ হয়ে যেতে পারে।

এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিকসমূহ) ডা. ফরিদ হোসেন মিয়া মানবজমিনকে বলেন, আমাদের এখন যে অক্সিজেন আছে বা যেভাবে চলছে তাতে সমস্যায় পড়বো না। কিন্তু ভারতেও অক্সিজেনের একটি সংকট আছে। তারা রপ্তানি বন্ধ করে দিলে একটা সংকট সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বিষয়টি নিয়ে অক্সিজেন সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে বৈঠক করেছি। তিনি বলেন, দেশের বর্তমান অক্সিজেন চাহিদা মেটাতে স্থানীয়ভাবে দু’টি কোম্পানি উৎপাদন করছে। পাশাপাশি ভারত থেকে তরলীকৃত অক্সিজেন আমদানি করা হচ্ছে।

তিনি বলেন, ভারত যদি অক্সিজেন রপ্তানি বন্ধ করে দেয়, তাহলে আমাদের হাসপাতালগুলোয় অক্সিজেনের ঘাটতি দেখা দেবে। সেই ঘটতি পূরণে আমরা কিছু ছোট ছোট কোম্পানির সঙ্গে যোগযোগ করছি। ৩টি অক্সিজেন উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আলোচনা করেছি। কিন্তু তাদের তরল অক্সিজেন উৎপাদনের সক্ষমতা অনেক কম, যা দিয়ে ঘটতি পূরণ করা সম্ভব হবে না। সে রকম পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে কী করবেন- জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রাপ্ত অক্সিজেনের সুষম বণ্টন নিশ্চিত করা হবে।

প্রতিদিন যেভাবে করোনা সংক্রমণের পাশাপাশি অক্সিজেনের চাহিদা বাড়ছে তাতে সার্বিক চিকিৎসা পরিস্থিতির অবনতি ঘটার শঙ্কা রয়েছে। এমন তথ্য স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় এবং অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের। দেশে কোভিড চিকিৎসা দেয় (সরকারি বেসরকারি মিলিয়ে) এমন হাসপাতালগুলোয় ১০৩৭টি হাইফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা রয়েছে। শুধু এই হাইফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলাগুলোর মাধ্যমে প্রতিদিন মুমূর্ষু রোগীদের জন্য ৬৪ মিলিয়ন লিটার অক্সিজেন সরবরাহ করতে হয়। এছাড়া আইসিইউতে (ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট-নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র) চিকিৎসাধীন রোগীদের অক্সিজেন সাপোর্টে রাখতে হয়। পাশাপাশি সাধারণ শয্যায় চিকিৎসাধীন অনেক রোগীরও অক্সিজেনের প্রয়োজন পড়ে। এর পাশাপাশি সারা দেশে সাধারণ হাসপাতালে ( যেগুলোয় নন- কোভিড রোগীদের চিকিৎসা দেয়া হয়) প্রতিদিন কয়েক হাজার রোগীর অস্ত্রোপচার হয়ে থাকে। তাদেরও অক্সিজেনের প্রয়োজন হয়। এমনকি দেশে করোনা মহামারি শুরুর পর থেকে অবস্থাপন্ন অনেক ব্যক্তি ও পরিবার বাসাবাড়িতে অক্সিজেন সিলিন্ডার রাখতে শুরু করেছেন।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, কোভিড-১৯ রোগীদের ১৫ থেকে ২০ শতাংশকে হাসপাতালে ভর্তি করার এবং অক্সিজেন সহায়তা দেয়ার প্রয়োজন হয়। প্রায় ১৫ শতাংশ রোগীর মধ্যে গুরুতর লক্ষণ দেখা যায় এবং পাঁচ শতাংশের ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটের প্রয়োজন হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *