পেটে পড়ছে না, সইছে পিঠ

Slider বিচিত্র

দেশে করোনা সংক্রমণ রোধে চলছে সর্বাত্মক লকডাউন। সরকারের জারি করা প্রজ্ঞাপনে জরুরি প্রয়োজন ছাড়া যান চলাচল বন্ধ রাখার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা বলছে, এ নির্দেশনা স্রেফ কাগুজে। রাজধানীর রাজপথ দাপড়ে বেড়াচ্ছে প্রাইভেট কারসহ ব্যক্তিগত অসংখ্য গাড়ি। এর ব্যতিক্রম শুধু রিকশার ক্ষেত্রে। গত কয়েকদিন ধরে রাস্তায় নিম্নআয়ের রিকশাচালকদের প্রতি ট্রাফিকের মারমুখী আচরণ, রিকশার গদি আটকে রাখা বা পুরো রিকশাই উল্টে রাখার চিত্র দেখা গেছে রাজধানীর সড়কে। পাস দিয়ে দ্রুতগতিতে চলে যাওয়া প্রাইভেটকারের দিকে কোনো নজর নেই। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বেশ সমালোচনাও চলছে।

সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, নিম্নআয়ের মানুষ, বিশেষ করে দিন আনে দিন খায় শ্রেণির মানুষ যারা, তাদের খাদ্যের সংস্থান না করে কর্মসংস্থানের উপায় বন্ধ করে দেওয়া মোটেও সমীচীন নয়। পেট কিছু না পেলে পিঠ কেন অত্যাচার সইবে? এমন প্রশ্ন রেখেছেন তারা।

গতকাল বিকেলের চিত্র। রামপুরা ওয়াপদা রোডের মুখে যেতেই একটি রিকশা আটকে দেয় ট্রাফিক পুলিশ। চালক জনাবুল হোসেনের অনেক অনুনয় বিনয়ের পরও কাজ হয়নি; বরং তার রিকশাটি উল্টো করে রাখা হয়। সেখানে দেখা যায় আরও দুটি রিকশার একই পরিণতি। পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছে প্রাইভেটকার, সিএনজি অটোরিকশা। সেদিকে ভ্রƒক্ষেপ নেই দায়িত্বরত ট্রাফিক পুলিশের। জনাবুল হোসেন আমাদের সময়কে বলেন, মেরুল বাড্ডা থেকে যাত্রী নিয়ে আসছিলাম। রাস্তা ঘুরতেই আটকে দেয় পুলিশ। লকডাউনে বের হওয়ার কারণ জানতে চাইলে বলেন, ‘আমি একা থাকলে বের হইতাম না। ঘরে বউ-বাচ্চা আছে। বাচ্চারা তো আর লকডাউন বোঝে না। ক্ষুধায় কাতর হয়ে যায়, কান্নাকাটি করে। তাই বাধ্য হয়ে বের হইছি। তিনি আক্ষেপের সঙ্গে বলেন, ‘রাস্তায় অন্য গাড়ি ঠিকই চলছে। শুধু রিকশা দেখলেই আটকাচ্ছে পুলিশ।’

এর আগের দিন রাজধানীর কাকরাইলে রফিক নামের এক প্রতিবন্ধী চালকের রিকশা আটক করা হয়। কান্নাজড়িত কণ্ঠে রফিক জানায়, ট্রাফিক পুলিশ ১২শ টাকা দাবি করেছে। বলছে, টাকা দিতে না পারলে রিকশা ডাম্পিংয়ে পাঠিয়ে দেবে। বিধিনিষেধ সত্ত্বেও রিকশা নিয়ে কেন বের হয়েছেন, এমন প্রশ্নে রফিক বলেন, ‘বাহির হওয়া উচিত না। কিন্তু পেটের ক্ষুধা তো লকডাউন মানছে না। রোগ মানানো গেলেও ক্ষুধা তো মানানো যাচ্ছে না।’

এমন চিত্র ঢাকার অনেক সড়কেই দেখা গেছে। এ বিষয়ে কথা বলতে চাইলে দায়িত্বরত ট্রাফিক পুলিশের তরফে কোনো সদুত্তর মেলেনি। প্রতিবন্ধী রফিকের কাছে টাকা চাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তা প্রত্যাখান করেন সংশ্লিষ্ট ট্রাফিক পুলিশ। তবে তিনি পেশাগত পরিচয় দিয়ে কোনো কথা বলতেও অপারগতা প্রকাশ করেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক আবুল কাশেম মোহাম্মদ জামাল উদ্দিন আমাদের সময়কে বলেন, রিকশাচালকদের বিষয়টি নিয়ে অবশ্যই ভাবতে হবে। সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা নেটওয়ার্কের আওতায় যে অনুদানের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে, সেটা যদি রিকশাচালকসহ দিনমজুরদের দেওয়া হয়, তা হলে তারা ঝুঁকি নিয়ে রাস্তায় বের হবেন না। বিষয়টি কার্যকর হলে তাদের নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব, অন্যথা নয়। পেটে না দিয়ে পিঠে লাঠি মারলে হবে না। সরকারের সামাজিক সুরক্ষার অনুদান কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করলে খেটে খাওয়া মানুষ বের হবে না। অন্যান্য গাড়ির চলাচল প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমার জানা মতে, ব্যক্তিগত গাড়ি মুভমেন্ট পাস নিয়ে চলার কথা।

প্রসঙ্গত, আইনগত কোনো ভিত্তি না থাকলেও লকডাউনের শুরুতে পুলিশবাহিনী নিজ উদ্যোগে ‘মুভমেন্ট ট্রাভেল পাস’ ইস্যুর উদ্যোগ নেয়। প্রথম কয়েকদিন রাস্তায় রাস্তায় পুলিশের চেকপোস্টে বের হওয়া যানবাহন জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখি হলেও গত দুদিন ধরে এ কার্যক্রমও কার্যত স্থবির।

এ দিকে লকডাউন চলাকালে সরকারের কাছ থেকে নিয়মিত খাদ্য ও নগদ অর্থ সহায়তা দাবি করেছে রিকশা, ব্যাটারি রিকশা ও ইজিবাইক চালক সংগ্রাম পরিষদ। গতকাল বৃহস্পতিবার জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে পরিষদের কেন্দ্রীয় পরিচালনা পরিষদ মানববন্ধন ও বিক্ষোভ কর্মসূচির আয়োজন করে। কর্মসূচি থেকে রিকশা ও ইজিবাইক চালকসহ শ্রমজীবী মানুষকে হয়রানি বন্ধের আহ্বান জানানো হয়।

মানববন্ধন ও বিক্ষোভ সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন সংগ্রাম পরিষদের কেন্দ্রীয় আহ্বায়ক খালেকুজ্জামান লিপন। সমাবেশে বক্তৃতা করেন সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক ফ্রন্টের কেন্দ্রীয় কোষাধ্যক্ষ জুলফিকার আলী, সংগ্রাম পরিষদের সদস্য রুবেল মিয়া, বাবু হাসান, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের সভাপতি আল কাদেরী জয় প্রমুখ। সমাবেশে নেতৃবৃন্দ বলেন, করোনা নিয়ন্ত্রণে লকডাউন ঘোষণা করা হলেও সারাদেশে ৫০ লাখ রিকশা, ব্যাটারি রিকশা ও ইজিবাইক চালকের জীবন-জীবিকা রক্ষায় কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ফলে জীবন বাঁচাতে তারা রাস্তায় নামতে বাধ্য হচ্ছেন। রাস্তায় নেমে গাড়ি আটক, ভাঙচুর ও নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। সব মিলিয়ে বর্তমানে এসব চালক ও তাদের ওপর নির্ভরশীল প্রায় আড়াই কোটি মানুষ মানবেতর জীবনযাপন করছেন। এ সকল ঘটনার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছেন তারা। নেতৃবৃন্দ রিকশা ও ইজিবাইক চালক এবং তাদের পরিবার রক্ষায় লকডাউনকালে প্রতিদিনের খাদ্য ও নগদ অর্থ সহায়তা প্রদানের জন্য সরকারের প্রতি জোর দাবি জানান। একই সাথে ঢাকা, বরিশাল, খুলনাসহ সারাদেশে আটক রিকশা ও ব্যাটারি ফেরত দেওয়ার এবং হয়রানি বন্ধের আহ্বান জানান।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *