ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় মোদিবিরোধী আন্দোলন : আরো ৬ জন নিহত

Slider সারাদেশ


ব্রাহ্মণবাড়িয়া: মোদিবিরোধী আন্দোলনে আরো উত্তাল হয়ে উঠছে ব্রাহ্মণবাড়িয়া। হেফাজতের সাথে পুলিশ ও ছাত্রলীগের ত্রিমুখি সংঘর্ষে রণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে জেলা শহরসহ বেশকিছু এলাকা। শনিবার পৃথক পৃথক হামলায় নিহত হয়েছেন ছয়জন। পুলিশসহ আহত হয়েছে অন্তত অর্ধশত জন।

নিহতরা হলেন নন্দনপুর হারিয়া গ্রামের আব্দুল লতিফ মিয়ার ছেলে ওয়ার্কশপের দোকানি জুরু আলম (৩৫), সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার দাবিড় মিয়ার ছেলে শ্রমিক বাদল মিয়া (২৪), ব্রাহ্মণবাড়িয়া বারিউড়া মৈন্দ গ্রামের জুরু আলীর ছেলে সুজন মিয়া (২২), জামেয়া ইউনুছিয়া মাদরাসার শিক্ষার্থী কাউছার (২৪), জুবায়ের (২৪) ও জাকারিয়া (১৭)।

তাদের হাসপাতালে আনা হলে সদর হাসপাতালে কর্তব্যরত চিকিৎসক আব্দুল্লাহ আল মামুন মৃত ঘোষণা করেন।

এ ছাড়া আহতদের উদ্ধার করে সদর হাসপাতালসহ বিভিন্ন জায়গায় চিকিৎসা দেয়া হয়।

শনিবার বিকেলে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নন্দনপুরে কয়েক হাজার বিক্ষুব্ধ জনতা মহাসড়কে অবস্থান করে। এ সময় পুলিশ-বিজিব সদস্যরা তাদের ধাওয়া করলে সেখানে উত্তেজনা দেখা দেয়। পরে ব্যাপক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে বেশ কয়েকজন আহত হয়।

এ দিকে স্থানীয় এমপির নেতৃত্বে নৈরাজ্য বিরোধী মিছিল থেকে জেলার প্রধান দ্বিনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জামেয়া ইউনুছিয়া মাদরাসায় ছাত্রলীগের কর্মীরা হামলা চালালে মাদরাসার ছাত্রদের সাথে ব্যাপক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। শহরের টিএ রোড দিয়ে আওয়ামী লীগের মিছিলটি জামিয়া ইসলামিয়া ইউনুছিয়া মাদরাসার এলাকা অতিক্রম করার সময় পেছন দিক থেকে মাদরাসার কয়েকজন ছাত্রকে ধাওয়া করে। এ সময় ছাত্ররাও পাল্টা ধাওয়া করে। তখন অর্ধশত ককটেল বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। কিছুক্ষণ পর কান্দিপাড়া এলাকা থেকে মাইকে মাদরাসা রক্ষার ঘোষণা দেয়া হলে হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমে আসে। পরে ছাত্রলীগকর্মীরা পিছু হটে। ক্ষুব্ধ লোকজন প্রধান সড়ক অবরোধ করে রাস্তায় আগুন ধরিয়ে দেয়। এতে যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেয়। এ সময় শহরের দোকানপাট বন্ধ হয়ে যায়। পরে বিজিবি সদস্যরা ঘটনাস্থলে পৌঁছে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত মাদরাসা এলাকায় থেমে থেমে পুলিশের সাথে সংঘর্ষ চলছিল।

অন্য দিকে সরাইল উপজেলার অরুয়াইলে স্থানীয়দের বিক্ষোভ মিছিল থেকে পুলিশ ক্যাম্পে হামলা চালানো হয়েছে। এতে ক্যাম্পে থাকা ২৫ পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন। আহত পুলিশ সদস্যদের নাম জানা যায়নি। তাদেরকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়া হয়েছে। পুলিশ অন্তত ৪০ রাউন্ড রাবার বুলেট নিক্ষেপ ও ১৫ রাউন্ড টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।

সরাইল থানা পুলিশের পরিদর্শক (তদন্ত) কবির হোসেন জানান, বিক্ষোভ মিছিল থেকে হঠাৎ করে পুলিশ সদস্যদের ওপর হামলা চালানো হয়। এ ছাড়া গুলিবিদ্ধ অবস্থায় আলী আহমেদের ছেলে কাউসার মিয়া, সাইদ মিয়ার ছেলে নুরুল আমিন (৩৫), আব্দুল সাত্তারের ছেলে বাছির মিয়া (২৮) ও আবদুল হোসেনের ছেলে ছাদের মিয়া (৩৫) হাসপাতালে আনা হয়।

বর্তমানে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে জেলা শহরসহ বিভিন্ন স্পটে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। টহল দিচ্ছে বিজিবি, র‌্যাব ও এপিবি বাহিনীর সদস্যরা।

৩ মামলায় আসামি ছয় হাজার, আটক ১৪
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় মাদরাসাছাত্রদের মোদিবিরোধী আন্দোলনে ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় তিনটি মামলা করা হয়েছে। শনিবার দুপুরে পুলিশ বাদি হয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর মডেল থানায় মামলাগুলো দায়ের করে। এর মধ্যে পুলিশ সুপারের কার্যালয় ও সদর মডেল থানার দুই নম্বর ফাঁড়িতে হামলা, ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় সদর মডেল থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) মিজানুর রহমান দুটি এবং জেলা সদরের মেড্ডা এলাকায় ভাংচুরের ঘটনায় এসআই মোসলেহ উদ্দিন একটি মামলা করেছেন। পুলিশ সুপারের কার্যালয় এবং পুলিশ ফাঁড়ির মামলা দুটিতে অজ্ঞাত পাঁচ হাজার জনকে আসামি করা হয়েছে। আর মেড্ডার মামলায় আসামি দেড় হাজার। ইতোমধ্যে এ ঘটনায় ১৪ জনকে আটক করেছে পুলিশ। তবে আটকদের মধ্যে কোনো মাদরাসাছাত্র আছে কি-না সেটি জানায়নি পুলিশ।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পুলিশ সুপার (এসপি) মো: আনিসুর রহমান জানান, বিকেল ৩টার দিকে মামলাগুলো নথিভুক্ত করা হয়েছে। অন্য ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষও মামলা করবে।

এর আগে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরের প্রতিবাদে শুক্রবার বিকেল ৩টা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদরের বিভিন্ন পয়েন্টে অবস্থান নিয়ে ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ করেন বিক্ষুব্ধ মাদরাসাছাত্ররা। তারা ব্রাহ্মণবাড়িয়া রেলওয়ে স্টেশনে হামলা চালিয়ে ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ করেন। এরপর শহরের কাউতলি এলাকায় পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে গিয়েও হামলা চালান বিক্ষোভকারীরা।

এ সময় পুলিশ শর্টগানের গুলি ছোড়ে। এ ঘটনায় আশিক (২০) নামে এক যুবক আহত হন। পরে তাকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। নিহত আশিক জেলা সদরের দাতিয়ারা এলাকার সাগর মিয়ার ছেলে।

এ ঘটনায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর মডেল থানা পুলিশের দুই নম্বর ফাঁড়ির পরিদর্শক (ইন্সপেক্টর) নূরে আলমসহ অন্তত ১৫ জন আহত হয়েছেন। এর মধ্যে নূরে আলমকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় ঢাকায় পাঠানো হয়েছে।

হরতালের সমর্থনে হেফাজতে মিছিল
রোববার হেফাজতে ইসলামের ডাকা হরতালের সমর্থনে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় মিছিল হয়েছে। শনিবার দুপুরে হেফাজতে ইসলাম ব্রাহ্মণবাড়িয়ার উদ্যোগে জামিয়া ইসলামিয়া ইউনুছিয়া মাদরাসা চত্বর থেকে একটি মিছিল বের হয়ে শহরের প্রধান সড়ক টিএ রোড প্রদক্ষিণ করে। পরে ফকিরাপুল ব্রিজের উপরে এক সংক্ষিপ্ত সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। এতে বক্তব্য রাখেন দারুল আরকাম মাদরাসার প্রিন্সিপাল মাওলানা সাজিদুর রহমান, জামিয়া ইসলামিয়া ইউনুছিয়া মাদরাসার প্রিন্সিপাল মাওলানা মুফতি মোবারক উল্লাহসহ শীর্ষ স্থানীয় আলেমগণ।

এ সময় বক্তারা, মোদির বাংলাদেশ সফরের নিন্দা জানান এবং এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে চট্টগ্রাম ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় মাদরাসাছাত্রদের উপর হামলা ও হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ জানিয়ে এর বিচার বিভাগীয় তদন্ত দাবি করেন। একই সাথে আজ হেফাজতে ইসলামের ডাকা দেশব্যাপী হরতাল সফল করার লক্ষ্যে সকলের প্রতি আহ্বান জানান।

শহরে বিজিবির টহল
এ ঘটনায় এখনো থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় ১০ প্লাটুন বিজিবি সদস্য গান কার নিয়ে শহরের বিভিন্ন এলাকায় টহল দিচ্ছে। শহরের বিভিন্ন পয়েন্টে পুলিশ ও এবিপিএন সদস্যদের মোতায়েন করা হয়েছে।

উল্লেখ্য, স্বাধীনতা দিবসে নরেন্দ্র মোদির ঢাকায় সফরকে ঘিরে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের বিভিন্ন সরকারি স্থাপনায় ভাংচুর চালায় আন্দোলনকারীরা। এ সময় তারা সড়কের বিভিন্ন পয়েন্টে টায়ারে আগুন লাগিয়ে বিক্ষোভ করতে থাকে। পরে বিক্ষুব্ধরা বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে রেল স্টেশনে গিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। রেল স্টেশনের সিগন্যাল, মাস্টার রুম, কন্ট্রোল রুম অন্য কর্মকর্তাদের কক্ষ ব্যাপক ভাংচুর করে। সমস্ত মালামাল একত্রিত করে আগুন ধরিয়ে দেয়। রেল লাইনের স্লিপার তুলে ফেলে বিক্ষুব্ধরা। সিগন্যাল বক্স ভেঙ্গে আগুন ধরিয়ে দেয়। এ ছাড়াও পুলিশ সুপারের কার্যালয়সহ বিভিন্ন সরকারি দফতরে হামলা, ভাংচুর ও অগ্নি সংযোগ করে এবং জেলা পরিষদ, পৌর মুক্ত মঞ্চ, পৌর মার্কেটসহ বিভিন্ন স্থানে বঙ্গবন্ধুর ম্যুারাল ভেঙ্গে ফেলে। এসব ঘটনায় পুলিশসহ প্রায় ১০ জন আহত হয়। সদর হাসপাতালে চিকিৎসারত অবস্থায় আশিক নামে এক যুবকের মৃত্যু হয়। তিনি শহরের কাউতলীর দাতিয়ারা গ্রামের সাগর মিয়ার ছেলে। পরে বিক্ষুব্ধরা লাশ নিয়ে শহরের প্রধান প্রধান সড়কে বিক্ষোভ করে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *