‘আন্দোলন সফলে ঢাকা মহানগর বিএনপি ব্যর্থ’-গত এক যুগ ধরে চলা একটি পুরনো কথা এটি। সম্প্রতি বিএনপির অভ্যন্তরে এই আলোচনা আবারো শুরু হয়েছে। ফলে নীতি-নির্ধারকদের ওপর নতুন করে মহানগরে ‘উপযুক্ত’ নেতৃত্ব ঠিক করার চাপও বেড়েছে। ইতোমধ্যে কমিটির গঠনে প্রাথমিক প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছে। মহানগর উত্তর ও দক্ষিণের কমিটি গঠন নিয়ে দলের স্থায়ী কমিটিসহ গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের সাথে পৃথকভাবে কথা বলা শুরু করেছেন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।
জানা গেছে, আসন্ন নতুন কমিটিতে মহানগরের নেতাদের বাদ দিয়ে কেন্দ্রীয় পর্যায়ের ‘তারকা’ নেতাদের নেতৃত্বে আনার গুঞ্জন শুরু হওয়ায় মহানগর ও কেন্দ্রীয় নেতারা এখন দুই মেরুতে অবস্থান করছেন। এর ফলে বারবার রাজধানীতে নেতৃত্বের ব্যর্থতার বেশ কিছু কারণও আলোচনায় উঠে আসতে শুরু করেছে।
২০১৭ সালের ১৮ এপ্রিল ঢাকা মহানগর বিএনপিকে উত্তর ও দক্ষিণ দুই ভাগে ভাগ করা হয়। মহানগর উত্তরে এম এ কাইয়ুমকে সভাপতি ও আহসান উল্লাহ হাসানকে সাধারণ সম্পাদক করে ৬৬ সদস্যের আংশিক কমিটি ঘোষণা করা হয়। দলের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী দুই বছর মেয়াদি এ কমিটি আরো প্রায় দেড় বছর আগে থেকেই মেয়াদোত্তীর্ণ। এর মধ্যে করোনা আক্রান্ত হয়ে আহসান উল্লাহ হাসান মারা যাওয়ায় গত ২২ জুন সহ-সভাপতি আবদুল আলীম নকীকে মহানগর উত্তরের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক করা হয়।
একই সময়ে মহানগর দক্ষিণে হাবিব-উন নবী খান সোহেলকে সভাপতি ও কাজী আবুল বাশারকে সাধারণ সম্পাদক করে ৭০ সদস্যের আংশিক কমিটি ঘোষণা করা হয়েছিল। উভয় কমিটি ঘোষণাকালে নির্দেশনা ছিল, এক মাসের মধ্যেই পূর্ণাঙ্গ কমিটি করতে হবে। কিন্তু আংশিক কমিটিতেই মেয়াদ পার করেছে তারা। ওয়ার্ড বা থানা পর্যায়েও নেই কমিটি। এ নিয়ে ক্ষোভ রয়েছে তৃণমূল নেতাকর্মীদের। এমন অবস্থায় বেশ কিছু দিন ধরেই নতুন করে কমিটি গঠনের আলোচনা চলছে বিএনপিতে।
নতুন কমিটি গঠনের বিষয়ে দুই ইউনিটের শীর্ষ পর্যায়ের বর্তমান নেতারা বলেছেন, বর্তমান কমিটিকে ব্যর্থ বলা হচ্ছে কোন অর্থে, তা তাদের বোধগম্য নয়। কারণ ২০১৭ সালে কমিটি গঠনের পরে বিএনপি কোনো বড় ধরনের আন্দোলনের কর্মসূচি দেয়নি। পরীক্ষাই হয়নি, সেখানে উত্তীর্ণ বা অনুত্তীর্ণ হওয়া বিষয় আসছে কেন।
তাদের দাবি, আন্দোলনের প্রধান ভূমিকায় থাকে দলের অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠন ছাত্র, যুব ও স্বেচ্ছাসেবক দল। এসব সংগঠনের মহানগর কমিটি অধিকাংশই বছরের পর বছর ধরে মেয়াদোত্তীর্ণ। সেদিকে নজর না দিয়ে মহানগর কমিটি প্রতি দুই বছর পরপর ভেঙে নতুন করলে সমস্যার সমাধান হবে না।
জানা গেছে, প্রথমে বর্তমান কমিটি ভেঙে দিয়ে আহ্বায়ক কমিটি গঠনের কথা ভাবা হয়েছিল, পরবর্তীতে ছোট পরিসরে ৪১ বা ৫১ সদস্যের একটি কমটি গঠনেরও চিন্তা ভাবনা করা হয়। এর মধ্যে ঢাকা মহানগর দক্ষিণের শীর্ষ পদগুলোর জন্য উপদেষ্টা আমান উল্লাহ আমান, বর্তমান সভাপতি হাবিব-উন-নবী খান সোহেল ছাড়াও অবিভক্ত ঢাকা মহানগর বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক সালাহউদ্দিন আহমেদ, বর্তমান কমিটির সাধারণ সম্পাদক কাজী আবুল বাশার, যুগ্ম সম্পাদক হাবিবুর রশীদ হাবিব, সাংগঠনিক সম্পাদক তানভীর আহমেদ রবিন, ফেনী-১ আসনের গত নির্বাচনে অংশ নেয়া যুবদল নেতা রফিকুল আলম মজনু, দক্ষিণ সিটির বিএনপির মেয়র প্রার্থী প্রকৌশলী ইশরাক হোসেনের নাম আলোচনায় উঠে আসে।
আর উত্তরের আলোচনায় সভাপতি এম এ কাইয়ুম ছাড়াও অবিভক্ত ঢাকা মহানগর বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবদুস সালাম, বিএনপির প্রচার সম্পাদক শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানী, উত্তর সিটির বিএনপির মেয়র প্রার্থী তাবিথ আউয়ালের নাম আলোচনায় স্থান পায়।
জানা গেছে, মহানগরের নেতাদের বাদ দিয়ে নতুন কমিটি গঠনের গুঞ্জন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ার পরে দলের অভ্যন্তরে এ নিয়ে ব্যাপক আলোচনা শুরু হয়। নতুন কমিটি গঠনের প্রয়োজনীতা, নগরীর আন্দোলনের ব্যর্থতার কারণসহ নানা দিক নীতিনির্ধারণী ফোরামের নেতাদের অবহিত করতে থাকেন মহানগরের নেতারা। অন্য দিকে সাংগঠনিক ব্যর্থতা কাটাতে মহানগরের কমিটিতে আলোচনায় থাকা কেন্দ্রীয় নেতাদের পক্ষেও কেউ কেউ মত দিতে থাকেন।
ঢাকা মহানগরের নেতারা দলের নীতিনির্ধারকদের জানিয়েছেন, মহানগরের রাজনীতি সম্পর্কে ধারণা না থাকা কেন্দ্রীয় নেতাদের মহানগরের দায়িত্বে টেনে আনার কারণেই আন্দোলন সফল হচ্ছে না। আবারো এই ধরনের ভুল করলে খেসারত দিতে হতে পারে।
মহানগরে ব্যর্থতার কারণ প্রসঙ্গে মহানগরের একাধিক সিনিয়র নেতা বলেন, মহানগর দুর্বল করার বীজ বপন করা হয় ২০০৮ সালের নির্বাচনে ভুল প্রার্থী মনোনয়নের মধ্য দিয়ে। ২০০৮ সালের নির্বাচনে ঢাকা-৪, ঢাকা-৮, ঢাকা ৯, ঢাকা ১৩, ঢাকা-১৬, ঢাকা-১৭ ও ঢাকা-১৮ আসনে ঢাকার বাইরের তারকা নেতাদের দল মনোনয়ন দিয়েছিল। ফলে এসব আসনের মনোনয়নবঞ্চিত নগর নেতাদের মনে একটা ক্ষোভ ছিল। তারা প্রকাশ্যে সে কথা না বললেও বহিরাগত তারকা নেতারা যখন স্থানীয় সংগঠন গোছানোর কাজে হাত দিয়েছেন, তারা তাদের সহযোগিতা করেনি। এর ফলে মহানগরকে শক্তিশালী করা যায়নি। প্রভাব পড়েছে আন্দোলনের মাঠেও। পাশাপাশি ঢাকায় নির্বাচন করা সেইসব নেতা সুবিধা করতে না পেরে অনেকে আবারো নিজ এলাকায় ফিরে গেছেন।
মহানগরের নেতারা বলেছেন, যদি আবারো বহিরাগতদের ঢাকার নেতৃত্বে এনে বসিয়ে দেয়া হয়, তারা একদিনে তৃণমূলের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত করবে আর দ্বিতীয় দিনে বৃহত্তর আন্দোলন করে সরকারের পতন ঘটাবে এমনটা ভাবলে চরম ভুল হবে। ঢাকার নেতাদের নেতৃত্বেই মহানগর কমিটি গঠনের কোনো বিকল্প নেই বলে তারা মনে করেন।
নগর নেতারা বলেছেন, মহাগরের রাজনীতি একেবারেই ভিন্ন। এখানে সাংগঠনিক প্রভাবের পাশাপাশি অর্থেরও প্রয়োজন আছে। উড়ে এসে জুড়ে বসলেই হবে না। কিন্তু কেন্দ্রীয় নেতারা নেতৃত্ব দিতে এসে এবং দলীয় মনোনয়ন নিয়ে নির্বাচন করতে এসে অর্থ খরচ করেন না, কর্মীদের বিপদে আপদে তাদের পাশে পাওয়া যায় না। নির্বাচন করে কেন্দ্রীয় নেতা চলে যাওয়ার পরে শত শত নেতাকর্মীদের মামলার খরচ কে বহন করবে, তা কেউ ভাবে না। আর মহানগরের যে নেতা মনোনয়নবঞ্চিত হয়েছে, সেই নেতা কত দিন ত্যাগ স্বীকার করবে এবং অর্থ খরচে আগ্রহ দেখাবে তাও কেন্দ্রের ভাবা উচিত। এ ছাড়া এমন তথ্যও আছে ঢাকায় নির্বাচন করা কেন্দ্রীয় নেতারা নিজ আসনের নেতাকর্মীদের খবর না নিলেও দলের ফান্ড থেকে নানা সময় অর্থও নিয়েছেন।
এসব কারণে নগর নেতাদের দাবি ঢাকার বাইরের তারকা নেতারা নেতৃত্বে এলে সংগঠনের শক্তি বৃদ্ধি পাবে না, উল্টো আরো ধস নামতে পারে।
জানা গেছে, মহানগরের বাইরে থেকে তারকা নেতাদের দিয়ে কমিটি গঠন করা হলে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে, নগর নেতাদের এই পরামর্শ যৌক্তিক বলে মনে করেছেন বিএনপির সিনিয়র অনেক নেতা। এ জন্য নগর নেতাদের নেতৃত্বে কমিটির গঠনের পক্ষে মত দিয়েছেন তারা। সিনিয়র নেতারা হাইকমান্ডকেও বিষয়টি জানিয়েছেন। সে ক্ষেত্রে আহবায়ক বা পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনে আরো কিছু সময় লাগতে পারে।
বিএনপির সিনিয়র নেতারা বলেছেন, নতুন করে আন্দোলনে নামার আগে ঢাকা মহনগরকে শক্তিশালী করতে হবে। আন্দোলনের মাঠে রাজধানীকে আর তারা ব্যর্থ হিসেবে দেখতে চায় না। এ কারণেই কমিটির নেতৃত্বে কাদেরকে জায়গা দেয়া হবে, তা নিয়ে নানাবিধ হিসাব-নিকাশ করে দেখা হচ্ছে।
এ বিষয়ে চিকিৎসার জন্য সম্প্রতি সিঙ্গাপুর যাওয়ার আগে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, কমিটি গঠন একটি চলমান প্রক্রিয়া। ঢাকা মহানগরসহ মেয়াদোত্তীর্ণ সব কমিটিই পর্যায়ক্রমে দেয়া হবে। করোনাকালে সাংগঠনিক কার্যক্রম সাময়িক স্থগিত ছিল। এখন আবার কার্যক্রম শুরু হয়েছে। যথাসময়ে ঢাকা মহানগরে দুই শাখার কমিটি হবে।