শহীদ তাজউদ্দীনে টেবিল এক লাখ ১৫ হাজার, সোফা ৩ লাখ ৮২ হাজার টাকা!

Slider টপ নিউজ


ঢাকা: অনিয়ম, দুর্নীতি ও আর্থিক কেলেঙ্কারির জালে দেশের স্বাস্থ্য খাতের নানা প্রকল্প। দীর্ঘ সময় ধরে এই খাতে চলছে দুর্নীতি। বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল প্রকল্পে কেনাকাটাতে দুর্নীতির মহোৎসব। কেলেঙ্কারি নিয়ে সমালোচনার পরও থেমে নেই দুর্নীতি। গাজীপুরে শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল প্রকল্পে একনেকের অনুমোদন ছাড়াই শত শত আইটেমের যন্ত্রপাতি ও আসবাবপত্র কেনা হয়েছে অত্যধিক দামে। পরিকল্পনা কমিশনের আর্থসামাজিক অবকাঠামো বিভাগ বলছে, প্রকল্পের আওতায় একনেকের অনুমোদন বহির্ভূত এই ধরনের ব্যয় গুরুতর অনিয়ম। সরকারের অর্থ তছরুপের পর্যায়ে পড়ে, যা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এই প্রকল্পের আর্থিক অনিয়মের তদন্ত করার জন্য মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়েছে। কারা কারা এই অনিয়মের সাথে জড়িত তাদের খুঁজে বের করে আইনের আওতায় আনার সুপারিশ করা হয়েছে।

জানা গেছে, প্রকল্পের আওতায় প্রস্তাবিত আসবাবপত্র ও যন্ত্রপাতির পরিমাণ এবং মূল্য অত্যধিক। মূল অনুমোদিত প্রকল্প প্রস্তাবনায় উল্লেখিত মূল্যের সাথে ইতোমধ্যে ক্রয়কৃত আসবাবপত্র ও যন্ত্রপাতির মূল্যের মারাত্মক অসামঞ্জস্য পাওয়া গেছে। মূল ডিপিপিতে ফুল সাচিবিক টেবিলের দর ২০ হাজার টাকা, সোফা সেট ২৬ হাজার টাকা, হাফ সাচিবিক টেবিল প্রতিটির দর ৭ হাজার টাকা ছিল। কিন্তু এগুলো কেনাতে খরচ দেখানো হয়েছে ফুল সাচিবিক টেবিলের প্রতিটির দর এক লাখ ১৫ হাজার টাকা, সোফা সেট ৩ লাখ ৮২ হাজার টাকা, হাফ সাচিবিক টেবিল প্রতিটির দর ৫৭ হাজার টাকা। আর মূল অনুমোদিত ডিপিপিতে হাসপাতালের আওতায় যন্ত্রপাতির ক্ষেত্রে ইলেক্ট্রোফোরেসিস হিমোগ্লোবিন ১৩ লাখ ১০ হাজার টাকা, ফ্যাকো ইমালসিফায়ার ২০ লাখ টাকা এবং এনেসথেসিয়া ভেন্টিলেটর প্রতিটির দর ৪ লাখ ৮১ হাজার টাকা। কিন্তু এগুলোর ক্রয়মূল্য দেখানো হয়েছে, ইলেক্ট্রোফোরেসিস হিমোগ্লোবিন ১ কোটি ১০ লাখ টাকা, ফ্যাকো ইমালসিফায়ার ৯৩ লাখ ৩৬ হাজার টাকা এবং এনেসথেসিয়া ভেন্টিলেটর প্রতিটির দর ৫৭ লাখ ২৯ হাজার টাকা। অনুমোদিত দামে চেয়ে বেশি দামে এসব কেনা হয়েছে।

একনেক অনুমোদিত ডিপিপিতে কোনো বরাদ্দ ছিল না, তবুও অনেক যন্ত্রপাতি আসবাবপত্র কেনা হয়েছে। প্রতিটির দর টেবিল ফর গাইনোক্লোজি ৩১ লাখ ৮৯ হাজার টাকা, কালার ডপলার আল্ট্রাসনোগ্রাম মেশিন উইথ ফোরডি ১ কোটি ৪২ লাখ টাকা, -৮৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস ইউএলটি ফ্রিজার ১৭ লাখ ৯৪ হাজার টাকা দেখানো হয়েছে। একটি পালস অক্সিমিটার কেনা হয়েছে ৫ লাখ ৫২ হাজার টাকায়। অনুমোদিত ডিপিপিতে সংস্থান না থাকা সত্ত্বেও সম্পূর্ণ আর্থিক বিধিবিধান লঙ্ঘন করে ইএসআর ল্যাব অটোমেশন বাবদ ৫ কোটি ৯৪ লাখ টাকা খরচ করা হয়েছে।

এ ব্যাপারে আর্থ-সামজিক অবকাঠামো বিভাগ প্রকল্প পরিচালকের কাছে এই সব বিধিবহির্ভূত ব্যয়ের মাধ্যমে শত শত আইটেম কেনার ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রয়োজনীয়তা অনুসারে ওই আসবাবপত্র ও যন্ত্রপাতি ক্রয় করা হয়েছে। অতিরিক্ত টাকার সংস্থান সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রকল্পের অন্যান্য খাত থেকে নেয়া হয়েছে।

২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে ৯২৪ কোটি টাকা ব্যয়ে শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল প্রকল্পটি অনুমোদন দেয়া হয়, যা ২০২১ সালের জুনে সমাপ্ত করার কথা। কিন্তু মেয়াদ শেষ হওয়ার দেড় বছর আগে এসে প্রকল্পটির ব্যয় ও সময় বাড়িয়ে সংশোধনের প্রস্তাব পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়। সেখানে প্রকল্পের খরচ মূল ব্যয় থেকে ১৮ দশমিক ৬৩ শতাংশ বাড়িয়ে এক হাজার ৯৬ কোটি ২৫ লাখ ২৫ হাজার টাকা এবং মেয়াদ এক বছর বাড়িয়ে ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত করার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। আর এই প্রস্তাবনা পর্যালোচনায় প্রকল্পের কেনাকাটায় অনিয়ম ধরা পড়ে। জাইকার অর্থায়নে এই হাসপাতালটির ভবন ১৫ তলা করা হবে, যা ৫০০ শয্যাবিশিষ্ট।

কমিশন সংশ্লিষ্টরা বলেন, অনুমোদন ছাড়া এত বেশি দামে তারা কি এসব জিনিস কিনতে পারেন? পিইসি সভায় ওনাকে (অধ্যক্ষ) বললাম, আপনি একজন ভদ্র মানুষ এটা কিভাবে করতে পারলেন? উনি বলেছেন, চাপে পড়ে এই কাজ করতে হয়েছে। উনি অনুমোদন ছাড়াই পণ্য ও জিনিসপত্র কিনেছেন। এসব উনি পারেন না। ওনাকে একটা অনুমোদন রেট (দর) দেয়া আছে। এর চেয়ে বেশি দামে কিনতে হলে ওনাকে অনুমোদন নিতে হবে। এটাকে আবার সংশোধন করে তারপর অনুমোদনের জন্য পাঠাতে বলেছি। অনিয়মের ব্যাপারে প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কেউই দায় এড়াতে পারেন না।

সংশ্লিষ্ট বিভাগ বলছে, তারা খরচ করে বিল-ভাউচার দিয়েছে। আর হিসাব বিভাগ সেসব অনুমোদন দিয়েছে। তারা অনুমোদন দিলো কিসের ভিত্তিতে? ডিপিপি অনুমোদন ছাড়া তারা তো এসব অনুমোদন দিতে পারে না। সেখানে হয়তো হিসাব বিভাগকে ভুল বুঝিয়ে অনুমোদন নেয়া হয়েছে। এখন এই অনিয়মের বিষয়ে একটা প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এসব নিয়ে তো অনেক কিছুই হবে। তদন্ত কমিটি করার জন্য মন্ত্রণালয়কে বলা হয়েছে। এ ব্যাপারে আর্থ-সামাজিক অবকাঠামো বিভাগের সদ্য সাবেক সদস্য (সচিব) আবুল কালাম আজাদের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বর্তমানে আমি অবসরে আছি। তবে প্রকল্পটি পিইসি সভা থেকে বেশ কিছু সুপারিশসহ ফেরত পাঠানো হয়েছে। সুপারিশের আলোকে প্রকল্পটির ডিপিপি সংশোধন করে পাঠাতে বলা হয়েছে। তিনি বলেন, প্রকল্পের ব্যাপারে পিইসি থেকে বেশ কিছু সিদ্ধান্ত ও পর্যবেক্ষণ দেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, আমি অনুমোদন দেইনি।

প্রকল্পের পরিচালক ও শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিক্যালের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা: মো: আসাদ হুসাইনের সাথে ফোনে যোগাযোগ করা হলে তার দফতর থেকে সন্ধ্যায় বলা হয় তিনি ওয়াশরুমে। এরপর কয়েক দফায় সেলফোনে কল দিলে তার ফোন বন্ধ পাওয়া যায়।

স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক এনায়েত হোসেনের কাছে প্রকল্পের ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, পরিকল্পনা কমিশন থেকে প্রকল্পের ব্যাপারে তাদের অবজারভেশন আমাদের কাছে এসেছে। এখন এ বিষয়ে মন্ত্রণালয়ে মিটিং হবে। সেখানেই ওই অবজারভেশনের আলোকে পদক্ষেপ বা সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।
এ ব্যাপারে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব মো: আলী নুরের সাথে গতকাল সন্ধ্যায় জানতে চাইলে তিনি বলেন, পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। আপনারা জানতে পারবেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *