দ্রব্যমূল্যের চাপে অসহায় মানুষ

Slider জাতীয়

ঢাকা: চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে হঠাৎ করেই বেড়ে যায় পিয়াজের দাম। দাম বেড়ে প্রতি কেজি বিক্রি হয় ১০০ টাকার উপরে। দরকারি এই পণ্যটির দাম বাড়তি থাকার মধ্যে ভোজ্যতেল ও চালের দাম বেড়েছে। এক সপ্তাহের ব্যবধানে রাজধানীতে পামওয়েল ও খোলা সয়াবিন তেলের দাম লিটারে অন্তত ১০ টাকা করে এবং সব ধরনের চালের দাম কেজিতে ২ টাকা করে বেড়েছে। এ ছাড়া সবজির দাম প্রতি সপ্তাহে বেড়েই চলেছে। পাশাপাশি বেড়েছে ডালের দামও। রাজধানীর কয়েকটি বাজার ঘুরে এমন চিত্র পাওয়া গেছে।

এভাবে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ায় চাপে পড়েছে নিম্ন আয়ের মানুষ। করোনার কারণে একদিকে আয় কমেছে, অন্যদিকে বেড়েছে সব ধরনের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে অনেক কর্মজীবীর মুখের হাসি চলে গেছে। তেলের দাম বাড়ার পেছনে কেউ কেউ বিশ্ববাজারের দোহাই দিলেও চালের দাম বাড়ার কোনো ‘যৌক্তিক কারণ’ দেখাতে পারছেন না বিক্রেতারা।

সরকারি বিপণন সংস্থা টিসিবি’র তথ্যও বলছে, গত সপ্তাহের তুলনায় মোটা চালের দাম বেড়েছে দুই শতাংশ। আর চিকন চালের দাম বেড়েছে এক শতাংশ। রাজধানীর বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে সংসার চালাতে তারা হিমশিম খাচ্ছেন। চাকরিজীবীদের করোনার কারণে বেতন কমে গেছে। আর রিকশাচালকদের আয় কমে গেছে। ফলে খরচের লাগাম টানতে মাঝে মধ্যে দুপুরে না খেয়ে থাকেন অনেকেই।

চাল: সরকারি প্রতিষ্ঠান ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাব অনুযায়ী, গত বছরের তুলনায় বর্তমানে মোটা চালের দাম ১৮.৯২ শতাংশ বাড়তি। তুলনামূলক কম বেড়েছে চিকন চালের দাম। গত বছরের তুলনায় চিকন চাল বিক্রি হচ্ছে ৮.৭৪ শতাংশ বেশি দামে।

কাওরান বাজারে রনি রাইস এজেন্সির মনিরুল ইসলাম বললেন, এক সপ্তাহের মধ্যে পাইজামের দর ৪৫ টাকা থেকে বেড়ে ৪৭ টাকা হয়েছে। সাধারণ মানের মিনিকেট ৪৮ টাকা থেকে বেড়ে ৫১ টাকা হয়েছে। বিআর আটাশ সাড়ে ৪২ টাকা থেকে বেড়ে ৪৪ টাকা হয়েছে। রশিদ, মোজাম্মেল ও বিশ্বাসসহ অন্যান্য নামি ব্র্যান্ডের মিনিকেটের ৫০ কেজির বস্তা ২৫০০ টাকা থেকে বেড়ে ২৭০০ টাকায় উঠেছে।

ভোজ্যতেল: টিসিবি’র হিসাবে, গত বছরের তুলনায় এখন সুপার পামঅয়েল ২৬.১৫ শতাংশ বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। লুজ সয়াবিন তেল বিক্রি হচ্ছে ১৩.১৩ শতাংশ বেশি দামে। লুজ পামঅয়েলের দাম বেড়েছে ২৯.১৭ শতাংশ। ৫ লিটার বোতলের সয়াবিন তেলের ৪.৮৪ শতাংশ এবং এক লিটারের ২.৪৪ শতাংশ দাম বেড়েছে। টিসিবি’র হিসাবে, এক সপ্তাহ আগে খোলা সয়াবিন তেল বিক্রি হচ্ছিল প্রতি লিটার ৮৪ টাকা থেকে ৮৮ টাকায়, এখন তা বিক্রি হচ্ছে ৯০ টাকা থেকে ৯৩ টাকায়। পামওয়েল যেটা ৭০ টাকায় বিক্রি হচ্ছিল সেটা এখন বিক্রি হচ্ছে সর্বোচ্চ ৮৪ টাকায়।

কাওরান বাজারে মুদি দোকানি জাহাঙ্গীর আলম বলেন, চারদিন ধরে পাইকারি বাজারে ভোজ্যতেলের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে চলছে, যার প্রভাব পড়েছে খুচরা বাজারে। তিনি জানান, পাম তেল ও সয়াবিন তেল লিটারে ১০ টাকার মতো বেড়েছে। খুচরায় ৭৩ টাকার পাম তেল এখন বিক্রি হচ্ছে ৮৪ টাকায়। ৮৫ টাকার সয়াবিন তেল বিক্রি হচ্ছে ৯৫ টাকায়। এক সপ্তাহ আগে পামওয়েলের ড্রাম (৫ মণ) ছিল ১২ হাজার টাকা, এখন সেটা হয়েছে ১৬ হাজার ৪০০ টাকা। সয়াবিন তেল আগে ছিল ১৫ হাজার এখন সেটা হয়েছে ১৭ হাজার ৬০০ টাকা।

পুরান ঢাকার মৌলভীবাজারের পাইকারি ভোজ্যতেল ব্যবসায়ী সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবুল হাশেম বলেন, গত সপ্তাহে কয়েকদিনের জন্য ভোজ্য তেলের দাম বেড়ে গিয়েছিল। বিশ্ববাজারে দাম বাড়ার পর এর প্রভাব দেশীয় বাজারে পড়েছে।

আলু-ডাল: খাদ্য হিসেবে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত এক কেজি আলু ৪০ টাকার নিচে মিলছে না কোথাও। টিসিবি বলছে, গত বছরের তুলনায় আলু এখন ৬৪.৪৪ শতাংশ বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। সারাদিন পরিশ্রম করে নিম্ন আয়ের একজন মানুষ ডাল আর আলুভর্তা দিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে দু’মুঠো ভাত খাবেন, তারও উপায় নেই। মাঝারি দানার মসুর ডালের দাম গত বছরের তুলনায় ৩৮.৪৬ শতাংশ বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। বড় দানার মসুর ডাল ২১.৭৪ শতাংশ এবং ছোট দানার ডালের দাম ৯.৫২ শতাংশ বেড়েছে।

পিয়াজ-মরিচ: আগের চেয়ে কিছুটা দাম কমলেও ১০০ টাকার নিচে এক কেজি দেশি পিয়াজ মিলছে। আমদানি করা ভারতের পিয়াজ কিনতে লাগছে ৬০ থেকে ৭০ টাকা। টিসিবি বলছেন, গত বছরের তুলনায় বর্তমানে দেশি পিয়াজ ১৩.৩৩ শতাংশ বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। তবে আমদানি করা পিয়াজ ৭.১৪ শতাংশ কম দামে পাওয়া যাচ্ছে। এদিকে বাজারে ২৫০ গ্রাম কাঁচা মরিচ কিনতে গুনতে হচ্ছে ৫০ টাকা। শুকনা মরিচের কেজি ২২০ টাকার নিচে নেই। টিসিবির হিসাবে, গত বছরের তুলনায় দেশি শুকনা মরিচের দাম ৫০ শতাংশ বেড়েছে। এ ছাড়া আমদানি করা আদার দাম বেড়েছে ৪২.৪২ শতাংশ।

সবজি: দু’-একটি বাদে বেশির ভাগ সবজির কেজি ৫০ টাকার উপরে। এমনকি ১০০ টাকার উপরে বিক্রি হচ্ছে একাধিক সবজি। এ ছাড়া বাজারে শসার কেজি বিক্রি হচ্ছে ৪০-৬০ টাকায়, পেঁপে ৪০-৬০ টাকা, করলা ৫০-৭০ টাকা, পাকা টমেটো ১২০-১৪০ টাকা, শিম ১২০-১৪০ টাকা, গাজর ৮০-১০০ টাকা, বরবটি ৬০-৮০ টাকা, বেগুন ৫০-৭০ টাকা, ঝিঙে ৫০-৬০ টাকা, পটল ৪০-৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

দ্রব্যমূল্যের দাম বাড়ায় ক্ষোভ ঝাড়েন একটি বেসরকারি কোম্পানির কর্মকর্তা। তিনি বলেন, মাসিক বেতন ছিল ২০ হাজার টাকা। করোনাভাইরাসের প্রকোপ শুরুর পর চলতি বছরের মে মাস থেকে বেতন দুই হাজার টাকা কমে হয়েছে ১৮ হাজার টাকা।

বাসা ভাড়ার পেছনে প্রতি মাসে খরচ হয় ১০ হাজার টাকা। বাকি টাকা দিয়ে খাবার ও অন্যান্য খরচ মেটাতে হয় তাকে। পরিবারের তিন সদস্যের জন্য মাসে চাল লাগে দেড় হাজার টাকার। অফিসে যাতায়াতে খরচ হয় আরো দেড় হাজার টাকা। ১৮ হাজার টাকার মধ্যে ১৩ হাজার টাকা চলে যায় এ তিন খাতে। বাকি ৫ হাজার টাকার ওপর ভর করে চলতে হয় পুরো মাস। মাঝে মধ্যে মাছ-মাংস কিনতে গেলে শেষ হয়ে যায় মাসের পুরো টাকা। মাস শেষে হাতে কোনো টাকা জমা থাকে না। এমনকি মাসের বেশির ভাগ সময় নিরামিষ খেয়ে থাকতে হয় তাদের। দুপুরে অধিকাংশ সময় না খেয়ে কাটাতে হয় তাদেরকে, এটা আর কেউ জানে না।

তিনি বলেন, ছেলে বড় হচ্ছে। সামনে স্কুলে ভর্তি করতে হবে। তখন কীভাবে চলবো, সারাক্ষণ সেই চিন্তাই করি। আশা ছিল বেতন বাড়বে। কিন্তু করোনায় উল্টো বেতন কমে গেছে। আবার সবকিছুর অস্বাভাবিক দাম।
তিনি বলেন, ১০০ টাকার কাঁচাবাজারে এখন একদিনও চলে না। দুই প্রকার সবজি কিনলে টাকা শেষ। মাসে বড়জোর এক-দু’দিন ব্রয়লার মুরগির মাংস খাওয়া হয়। গরুর মাংস কোরবানির ঈদের পর আর খাওয়া হয়নি। এরপরও মাস শেষে হাতে কোনো টাকা থাকে না। পরিবার নিয়ে খুব কষ্টে আছি।

রাজধানীতে বসবাস করা একটি বড় অংশের জীবনযাত্রার চিত্র এখন এরকমই। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে অনেক কর্মজীবীর মুখের হাসি চলে গেছে। অনেকে পরিবার-পরিজনদের বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছেন। স্বল্প আয়ের এসব মানুষের হাসি-কান্না অনেকটাই নির্ভর করে নিত্যপণ্যের মূল্যের উপর। মূল্য কম থাকলে তারা পেটভরে দু’মুঠো খেতে পারেন। মূল্য লাগামছাড়া হলে অনেক সময় না খেয়ে কাটাতে হয় তাদের।

এদিকে খেটে খাওয়া দিনমজুর ও রিকশাচালকদের অবস্থা আরো করুণ।
মধুবাগের বাসিন্দা রিকশাচালক মাজেদুর বলেন, পরিবার গ্রামে থাকে। ঢাকায় মেসে থাকি। সকাল ও রাতের খাওয়া আর থাকার ভাড়াবাবদ মাসে দিতে হয় ৫ হাজার টাকা। প্রতিদিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত রিকশা চালিয়ে আয় হয় ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা। রিকশার ভাড়াবাবদ গ্যারেজে দিতে হয় ৮০ টাকা। গ্রামের বাড়িতে স্ত্রী, দুই সন্তান এবং মা থাকেন। তাদের জন্য মাসে পাঠান তিন হাজার টাকার মতো।

তিনি বলেন, সবকিছুর দাম বাড়ার কারণে গত মাস থেকে মেস ভাড়া বাড়ার কথা বলেছে। অনেক অনুরোধ করে এ মাস পর্যন্ত সময় নিয়েছি। সামনের মাস থেকে ৫০০ টাকা বেশি দিতে হবে। এখনই যে খরচ তাতে বেশির ভাগ দিন দুপুরে না খেয়ে থাকতে হয়। আগামী মাস থেকে ৫০০ টাকা বেশি দিতে হলে কষ্ট আরো বেড়ে যাবে। জিনিসপত্রের দাম কম থাকলে হয়তো মেস ভাড়া একটু কম দেয়া যেত।

বাজার করতে আসা আলী হোসেন বলেন, বাজারে গিয়ে যেকোনো পণ্যের দাম শুনলে মন খারাপ হয়ে যায়। করোনার কারণে একদিকে আয় বাড়ার পথ বন্ধ হয়ে গেছে, অন্যদিকে, সবকিছুর দাম বাড়তি। কোনোভাবেই আয়-ব্যয়ের হিসাব মিলাতে পারছি না। এখন নতুন করে চাল, পিয়াজের দাম বেড়েছে। এ দুর্দিনে খাদ্যপণ্যের দাম যদি কম থাকত, তাহলেও কিছু খরচ বাঁচানো যেত। কিন্তু চাল, ডাল, সবজির বাড়তি দাম ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ হিসেবে আমাদের উপর পড়ছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *