টাঙ্গাইলে বাবা হারা ও মা মরা চার শিশুর কষ্টের গল্প

Slider বাংলার মুখোমুখি


টাঙ্গাইল প্রতিনিধিঃ পারভীন আক্তার। মা, বাবার অত্যন্ত আদরের সন্তান ছিলেন তিনি। অল্প বয়সে পাশের ইউনিয়নের মান্নান মিয়ার সাথে পরিবারের সন্মতিতে বিয়ে হয়। বাবা কৃষক হওয়ার সুবাদে অর্থকড়ি দিয়ে মেয়ের জামাতাকে সাহায্য করতে না পারলেও বেশ সুখেই কাটছিল পারভীনের সংসার। বিয়ের দেড় বছরের মাথায় লিজা নামের ফুটফুটে এক কন্যা সন্তানের জন্ম দেয় পারভীন। ঠিক তার এক বছর পরেই নীলা নামের আরেক কন্যা সন্তানের জন্ম দেন এই দম্পত্তি। তখন থেকেই শুরু হয় বিরম্বনা। পর পর দুটি কন্যা সন্তান জন্ম দেয়ায় পারভীনের কপালে নেমে আসে এক ঘোর অমানিশা।

শ্বশুর, শাশুরী ও প্রিয় মানুষটির কাছ থেকে শুরু হয় একের পর এক অত্যাচার ও নির্যাতন। সকল দুঃখ কষ্ট ভুলে প্রিয় দুই সন্তানকে নিয়ে অনাদর অবহেলায় স্বামীর বাড়িতেই মাটি কামড়ে পড়ে থাকতেন।

পুত্র সন্তান জন্ম না দিতে পারায় প্রতিবেশি ও শ্বশুর বাড়ির লোকজনের নানা অপ্রিয় কথা সইতে হত তাকে প্রতিক্ষণ, প্রতি মুহুর্ত। নিজের অজান্তেই তার দু-চোখ বেয়ে অশ্রু ঝড়তো আর দু-হাত তুলে সৃষ্টিকর্তার কাছে সাহায্য প্রার্থনা করতেন।

হঠাৎ এক দিন জানতে পারেন তার সব থেকে আপন মানুষটি আরেকটি বিয়ে করেছেন। খবর শোনার সাথে সাথে তার মাথায় যেন সাত আসমান ভেঙ্গে পড়ে পারভিনের। যদিও তার জীবদ্বশায় তার স্বামীর অন্য স্ত্রীকে দেখে যেতে পারেনি। শুধু লোক মুখে শুনেছেন বিয়ের কথা।

এদিকে দিন দিন অসুস্থ্য হয়ে যায় পারভিনের শরীর। তার উপর আবার সন্তান সম্ভাবনা। কোন উপায়ান্তর না দেখে দরিদ্র কৃষক পিতার বাড়িতে আশ্রয় গ্রহণ করেন তিনি। সাথে দুই অবুঝ সন্তান।

বেশ কয়েকমাস গড়িয়ে গেলেও স্বামী স্ত্রী-সন্তানদের কোনদিন খোঁজ নেয়নি। এ দিকে সন্তান জন্ম দেয়ার সময় ঘনিয়ে এসেছে। এক রাতে প্রচন্ড বৃষ্টির মধ্যে প্রসব ব্যাথায় যখন ছটফট করতে ছিলেন তখন পারভীনের মা পাশের গ্রামের এক দাইকে ডেকে এনে জমজ দুই জন ফুট ফুটে পুত্র সন্তানের প্রসব করেন পারভিন।

তার সকল দুঃখ, অপবাদ ও যন্ত্রনা নিমিষেই দুর হয়ে যায়।

অনেকের মাধ্যমে প্রিয় মানুষটির কাছে দুই পুত্র সন্তানের সংবাদ পাঠিয়েও কাছে না পেয়ে সে পুরোপুরি মানুষিক যন্ত্রনায় ভেঙ্গে পড়ে। পরবর্তীতে আরও অসুস্থ হয়ে মারা যান পারভিন। এতিম হয়ে পড়ে চার অবুঝ সন্তান।

বলছিলাম টাঙ্গাইলের ঘাটাইল উপজেলার ধলাপাড়া ইউনিয়নের কোনাবাড়ি গ্রামের দরিদ্র কৃষক মান্নান মিয়ার মেয়ে পারভীন আক্তারের কষ্টের গল্প।

সরেজমিনে ঘটনার সততা যাচাই করতে গিয়ে বেড়িয়ে আসে বাবা হারা, মা মরা চার অবুঝ শিশু সন্তানের এমনই কষ্টের গল্প।

এলাকাবাসী, স্থানীয় জন প্রতিনিধিদের সাথে কথা বলে জানা যায়, আজ থেকে প্রায় বছর খানিক আগে জমজ সন্তান জন্ম দেয়ার ৭ দিনের মাথায় মারা যায় কোনাবাড়ি গ্রামের দরিদ্র কৃষক মান্নান মিয়ার মেয়ে পারভীন আক্তার।

তার চার সন্তান লিজা (৮), নিলা (৭) নাহিম (১) ও ফাহিম (১) এতিম হয়ে যায়।

স্থানীয়রা জানান, সন্তানের পিতা লিটন স্ত্রী পারভীন মারা যাওয়ার ৬ মাস পর বিয়ে করে চলে যায় সন্তানদের ফেলে রেখে। সন্তানদেরে ভরণপোষণ করছেন না।

এ ব্যাপারে স্থানীয়দের কাছে জানতে চাইলে তারা বলেন, লিটন বাবা হয়ে সন্তানের দায়িত্ব পালন করছে না কথাটা ঠিক, কিন্তু তার যে ইনকাম তা দিয়ে সে নিজেই চলতে পারে না। তবে মাঝেমধ্যে সে কিছু কিছু খরচাপাতি দেয়।

এদিকে বাবা হারা ও মা মরা এতিম চার নাতি-নাতনী নিয়ে বিপাকে পড়ে যায় দিনমজুর নানা মান্নান মিয়া ও নানি ফিরোজা বেগম।

নানার প্রতিদিনের রোজগার দিয়ে তাদের মুখে দু’বেলা খাবার তুলে দিতে পারলেও তাদের পড়ালেখাসহ বেড়ে উঠার সব পথই বন্ধ হয়ে যায়।

বিষয়টি ধলাপাড়া ভুমি অফিসে কর্মরত জাকির হোসেন সাংবাদিকদের জানালে বেশ কয়েকটি স্থানীয় গণমাধ্যম সংবাদ প্রচার করে।

পরবর্তিতে আলোর পথে ফাউন্ডেশনের মুহাম্মদ সাদ্দাম হুসাইন, ডাঃ শাহ আল কামাল, রুবেল অন্তর, ডাঃ মতিউর রহমান স্মৃতি সংসদ, ১০ নং রসুলপুর ইউনিয়ন শাখার সভাপতি শাহরিয়ার কাজল, ঘাটাইল মিডিয়ার আসিক মিয়াকে সাথে নিয়ে ধলাপাড়া ইউনিয়নের কোনাবাড়ি গ্রামের মান্নানের বাড়িতে হাজির হয়ে সমাজের বিত্তবানদের নজরে আনার জন্য বেশকিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেন।

যার ফলশ্রুতিতে এতিম চার নাতি-নাতনী নিয়ে বিপাকে পরা পরিবারের কষ্ট দেখে আলোর পথে ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে পুরো পরিবারের চিকিৎসা, বড় দুই মেয়ের শিক্ষার সকল খরচ, পোশাক এবং জমজ দুই ছেলের শিশুর খাদ্যের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

পাশাপাশি হৃদয়ে ঘাটাইল স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের মোঃ নাজমুল হোসেন শিশু খাদ্য প্রদান, উপজেলায় কম্পিউটার অপারেটর রফিক, এফ.এম কম্পিউটারের সুজন, মুমিন, আব্বাস ও বাবু নগদ অর্থ সহায়তা করেন।

এছাড়াও ডাঃ মতিউর রহমান স্মৃতি সংসদ, ১০ নং রসুলপুর ইউনিয়ন শাখার পক্ষ থেকে কিছু আর্থিক সহায়তা প্রদান করার প্রতিশ্রুতি দেন।

সাময়িক সময়ের জন্য এই জরুরী সহায়তাই এতিম এই শিশুদের জন্য যথেষ্ট নয়। এদের বেঁচে থাকতে হলে সরকারী সহযোগিতার পাশাপাশি স্থানীয় সমাধানের প্রয়োজন বলে মনে করেন এলাকাবাসি সহ ভুক্তভোগী এই পরিবার।

এ ব্যাপারে ধলাপাড়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এজহারুল ইসলাম মিঠু বলেন, বিষয়টি আমার নজরে রয়েছে। ইতিপূর্বে সরকারী যে সাহায্য সহযোগিতা এসেছে আমি স্বাধ্যমত দেয়ার চেষ্টা করেছি। এতিম এই শিশুদের ভরণপোষণের জন্য সরকারী এই সহযোগিতাই যথেষ্ট নয়। আমি সমাজের বিত্তবানদের অনুরোধ জানাই, সবাই এগিয়ে এসে এতিম এই চার শিশু সন্তানদের পাশে দাঁড়ান। ঘটনাটি সত্যিই বেদনাদায়ক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *