আখেরি মোনাজাতের মাধ্যমে শেষ হল ৫০তম বিশ্ব ইজতেমা

Slider জাতীয়

E-300020140126061047

বিশ্ব ইজতেমা ময়দান টঙ্গী থেকে; দিল্লীর মাওলানা যোবায়রুল হাসানের মৃত্যুর পর এবার ভারতের মাওলানা সা’দের পরিচালনায় অনুষ্ঠিত আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে তাবলিগ জামাতের দুই পর্বের ৫০তম বিশ্ব ইজতেমা শেষ হলো।

সকাল ১১মিনিট ২২মিনিট থকে ১১টা ৫৪ মিনিট পযর্ন্ত মোনাজাত অনুষ্ঠিত হয়। ৩২ মিনিট স্থায়ী এই মোনাজাতে দুহাত ঊর্ধ্বমুখী করে বিশ্ব ইজতেমায় অংশ নেওয়া কয়েক লাখ মুসল্লি আমিন আমিন ধ্বনিতে মুখরিত করে তোলেন ইজতেমা ময়দান। পুরো টঙ্গী এলাকা মুখরিত হয়ে ওঠে মোনাজাতের সময়। মোনাজাতে বিশ্ব মুসলিমের সুখ, শান্তি ও সমৃদ্ধি কামনা করা হয়। সেই সঙ্গে বাংলাদেশের জন্যও দোয়া করা হলো।

 

বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্ব শুরু হয়েছিল ৯জানুয়ারি। ১১জানুয়ারি আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে তা শেষ হয়। দ্বিতীয় ও শেষ পর্বের বিশ্ব ইজতেমা শুরু হয় ১৬জানুয়ারি। ১৮ জানুয়ারী রোববার আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে তা শেষ হলো।

 

বিশ্বের ৮৮টি দেশের ৪হাজার ৫৭৪ জন বিদেশী মেহমানসহ কয়েক লাখ মানুষ এই আখেরি মোনাজাতে অংশগ্রহণ করেন। কয়েকটি স্যাটেলাইট টেলিভিশনে সরাসরি মোনাজাত সম্প্রচারের ফলে বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ পরোক্ষভাবে মোনাজাতে শরিক হতে পেরেছেন।

 

হেদায়াতি বয়ান

মোনাজাতের আগে চলে হেদায়াতি বয়ান। বয়ানে বলা হয়, আল্লাহর গজবের বড় স্থান হচ্ছে জাহান্নাম। তিনি আল্লাহর রাস্তায় (তাবলিগে) দাওয়াতি কাজে পায়ে হেঁটে মানুষের কাছে দাওয়াত পৌঁছে দেয়ার পরামর্শ দেন। কারণ পায়ে হেঁটে বেশি মানুষকে দ্বীনের দাওয়াত দেয়া সম্ভব হবে। এতে পায়ে যে ধূলাবালি লাগবে তা জাহান্নামের আগুনকে ঠান্ডা করে দেয়। তিনি তাবলিগের দাওয়াতি কাজে গিয়ে মানুষের কাছে ইহজগতের জন্য ছওয়াল করতে বারণ করে বলেন, যে জামাত ছওয়াল করে আল্লাহর সাহায্যের দরজা তাদের জন্য বন্ধ হয়ে যায়। ছওয়াল করলে দিলে শয়তান স্থান পায়। দাওয়াতি কাজে সবচেয়ে বড় কাজ হলো নিজের নিয়তকে সহি করা এবং অন্যের কাছে ছওয়াল না করা।

 

মোবাইল ফোনে মোনাজাতে অংশগ্রহণ

ইজতেমা স্থলে যেতে পরিবহন সংকট ও ভিড় এড়াতে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে লোকজন মোবাইল ফোনে মোনাজাতে অংশ নেয় বলে জানা গেছে। ইজতেমার মূল মাঠ থেকে প্রায় ১২ কিলোমিটার দূরে গাজীপুর সদরের চান্দনা চৌরাস্তা ঈদগাহ ময়দানে কয়েক হাজার মুসুল্লি জমায়েত হন। পরে তারা মোবাইল ও পুলিশের ওয়াকিটকির মাধ্যমে ইজতেমা স্থলে যোগাযোগ রক্ষা করে বিশ্ব ইজতেমার আখেরি মোনাজাতে শরিক হয়েছেন। একই ভাবে জেলার ভোগড়া, বাসন সড়ক ও শিমুলতলী এলাকায় মোবাইল মোনাজাত অনুষ্ঠিত হয়।

 

মোনাজাত শেষে যান ও জনজট

আখেরি মোনাজাত শেষ হওয়ার পরপরই বিভিন্ন স্থানে অবস্থান নেয়া মানুষ একযোগে নিজ নিজ গন্তব্যে ফেরার চেষ্টা করেন। মুসুল্লিরা শুরু করে দেয় হুড়োহুড়ি এবং আগে যাওয়ার প্রতিযোগিতা। এতে টঙ্গীর আশে-পাশের সড়ক-মহাসড়কগুলোতে সৃষ্টি হয় জনজট ও যানজট। ফলে আবারো পায়ে হেঁটে রওনা দেয় মুসল্লিরা। আর পাঁয়ে হাঁটা মুসুল্লিদের চাপে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে আসা মুসুল্লীদের যানবাহন আটকা পড়ে যায়।

 

 

বিদায় বিশ্ব ইজতেমা ২০১৫

বিশ্বের মুসলমান সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় অনুষ্ঠান পবিত্র হজ্জ্ব পালনের পর দ্বিতীয় অনুষ্ঠান বিশ্ব ইজতেমা। রূপকথার কাহিনী রয়েছে, টঙ্গীর তুরাগ তীরে এক সময় হানিফা সোনাবানের যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধে বীর হানিফাকে প্রতিপক্ষ যুদ্ধা সোনাবান, তুরাগ তীরে মাটির নীচে দাবিয়ে দিয়েছেন বলে প্রবাদ রয়েছে। ১৯৬৬ পূর্ববর্তি সময়ে বিশ্ব ইজতেমা শুরুর পূর্বে এই তুরাগতীর ছিল পর্যটকদের চারণ ক্ষেত্র। এই স্থানে ইজতেমা শুরু হলেও এখনো রুপকথার বিখ্যাত স্থান টঙ্গীর এই তুরাগ তীরে মাঝে মাঝেই পর্যটক এসে পড়ে। বিভিন্ন ইতিহাস থেকে জানা যায়, বিশ্ব ইজতেমা বাংলাদেশে শুরু হয় মূলত দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের পূর্বের বছরে ১৯৮৬ সালে। ১৯৪৬ সালে তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকার কাকরাইল মসজিদে অনুষ্ঠিত হয় প্রথম বিশ্ব ইজতেমার নামাজ। পূর্ব পাকিস্তান সরকারের সিদ্ধান্তে ১৯৪৮ সালে এই ইজতেমাকে চট্টগ্রাম হাজী ক্যাম্পে স্থানান্তর করা হয়। এর ৯ বছর পর নারায়নগঞ্জ জেলার সিদ্ধিরগঞ্জে অনুষ্ঠিত হয় বিশ্ব ইজতেমা। এরপর ১৯৬৬ সাল থেকে গাজীপুর জেলার টঙ্গী পৌর এলাকাধীন ঐতিহাসিক তুরাগ তীরে ১৬০ একর জমির উপর অনুষ্ঠিত হচ্ছে বিশ্ব ইজতেমা। ২০১১ সাল থেকে দুই পর্বে বিভক্ত হয়ে এই ইজতেমা হচ্ছে। প্রথম পর্ব ১৩,১৪ ও ১৫ জানুয়ারি এবং দ্বিতীয় পর্ব ২০, ২১ ও ২২ জানুয়ারি ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয়। দুই পর্বে ১৫ ও ২২ জানুয়ারি দুটি আখেরি মোনাজাত অনুষ্ঠিত হয়। দুটি মোনাজাতই পরিচালনা করেন বিশ্ব তাবলীগ জামাতের মুরুব্বী দিল্লীর মাওলানা জোবায়ারুল হাসান। ২০১২ সালের দুই পর্বের ইজতেমায় প্রায় দুই শতাধিক যৌতুক বিহীন বিয়ে হয়। প্রথম পর্বে ১০৪ টি ও দ্বিতীয় পর্বে ১০৩ টি বিয়ে হয়। ২০১২ সালের ইজতেমায় প্রায় ১’শটি দেশের ২০ হাজারেরও অধিক বিদেশী মেহমান অংশগ্রহণ করেন। ২০১৩ সালের বিশ্ব ইজতেমা দুই পর্বে অনুষ্ঠিত হয়। প্রথম পর্ব ১১,১২ ও ১৩ জানুয়ারী এবং দ্বিতীয় পর্ব ১৮,১৯ ও ২০ জানুয়ারী। ২০১৪ সালে বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্ব শুরু হয়েছিল ২৪ জানুয়ারি। ২৬ জানুয়ারি আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে তা শেষ হয়। দ্বিতীয় ও শেষ পর্বের বিশ্ব ইজতেমা শুরু হয় ৩১ জানুয়ারি। ০২ ফেব্রুয়ারী রোববার আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে তা শেষ হয়।

 

২০১৫ ব্যাত্রিক্রমী ইজতেমা: এই প্রথম দুই পর্বের ইজতেমা জনৈতিক দলের অবরোধের মাধ্য দিয়ে অনুষ্ঠিত হলো।

 

 

বিদেশী মেহমান: বিশ্বের ১৫৫টি দেশের প্রায় ১৫হাজার মুসল্লী এবারের ইজতেমায় অংশ গ্রহন করেন। দেশ গুলোর মধ্যে কয়েকটি হল, মিসর, ওমান, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব-আমিরাত, কাতার, অষ্ট্রেলিঅংশ গ্রহনকারী দেশ গুলো মধ্যে হলো, ব্রনাই, কানাডা, কম্বোডিয়া, ডেনমার্ক, ফিনল্যান্ড, জার্মানী, ইরান, জাপান, মাদাগাস্কার, মালি, মোজাম্বিক, নাইজেরিয়া, পানামা, সেনাগাল, দঃ আফ্রিকা, তাঞ্জেনিয়া, ত্রিনিদাদ, রাশিয়া, আমেরিকা, জিম্বাবুই, বেলজিয়াম, ক্যামারুন, চীন, কমোরেস, ফিজী, ফ্রান্স, ইন্দোনেশিয়া, ইটালী, কেনিয়া, মালয়শিয়া, মায়ানমার, নিউজিল্যান্ড, নরওয়ে, ফিলিপাইন, সিঙ্গাপুর, শ্রীলঙ্কা, সুইডেন, থাইল্যান্ড, তার্কি, যুক্তরাজ্য, জাম্বিয়া, কোরিয়া, আলজিরিয়া, ডিজিবুতি, ইথোপিয়া, ইরাক, ফিলিস্তিন, কুয়েত, মরক্কো, কাতার, সোমালিয়া, সিরিয়া, তিউনিসিয়া, ইয়েমেন, পাকিস্তান, বাহরাইন, ইরিত্রিয়া, জর্দান, মৌরিতানিয়া, ভারত, সুদান, দুবাই।

 

মুসল্লীর মৃত্যু; ২০১৫ সালে ইজতেমায়র দুই পর্বে মোট ১৭মুসল্লী মারা যায়। ১মপর্বে ৯জন ও ২য় পর্বে ৮জন। এরমধ্যে শীতে ও হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা যায়, ১৫জন। ট্রেনে কাটা পড়ে ১জন। তবে ইজতেমা এলাকার বাইরে ট্রেনে কাটা পড়ে মারা গেছেন আরো ৩জন।

 

২০১৩ সালের দুই পর্বে ২১ জন মুসল্লি ইজতেমা ময়দানে মার যান। প্রথম পর্বে ১১ জন ও দ্বিতীয় পর্বে ১০ জন মারা যান।

 

 

যৌতুক বিহীন বিয়ে; প্রথা অনুযায়ী প্রতি বছর বিশ্ব ইজতেমায় যৌতুক বিহীন বিয়ে হয়ে থাকে। ১ম পর্বে ১২০টি ও ২য় পর্বে ৯০টি সহ মোট ২১০টি যৌতুক বিহীন বিয়ে সম্পন্ন হয়েছে।

 

আটক; টঙ্গী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা(ওসি) ইসমাইল হোসেন এবারের বিশ্ব ইজতেমায় মোট ৩৫ জন কে বিভিন্ন অপরাধে আটক করা হয়েছে।

 

জড়িমানা; ১০টি ভ্রাম্যমান আদালত দুই পর্বে ২লাখের বেশী টাকা জড়িমানা করে মামলা দায়ের করেছেন।

 

এ বারে টঙ্গীর বিশ্ব ইজতেমা উপলক্ষে সরকার সর্বোচ্চ নিরাপত্তা মূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। এর মধ্যে বিভিন্ন ভাবে প্রায় ১২ হাজারের মত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য নিয়োজিত ছিলেন। রাত ২টা পূর্ব নির্ধারিত সময়সূচী অনুযায়ী ভোগড়া বাইপাস থেকে টঙ্গীর ইজতেমা ময়দান পর্যন্ত ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক বন্ধ হয়ে যায়।

 

এদিকে শনিবার বিকেল থেকেই মুসল্লিদের ঢল নামে ময়দান অভিমুখে। মহাসড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেয়ার আশঙ্কায় অন্ধকার থাকতেই তীব্র শীত উপেক্ষা করে মুসল্লিরা ময়দান অভিমুখে যাত্রা করে। তারা ব্যাক্তিগত পরিবহন, বাস, রিক্সা, অটোরিক্সা যোগে অথবা পায়ে হেঁটে ময়দানের এসে পৌছে। ভোর ৫ টার দিকে ঢাকা- ময়মনসিংহ মহাসড়কের আব্দুল্লাহপুর এবং ভোগড়া পয়েন্টে যান চলাচল বন্ধ করে দিয়েছে পুলিশ। ফলে পায়ে হেঁটে দীর্ঘ পথ পেড়িয়ে মানুষ ফজরের জামায়াতে অংশগ্রহন করে। এদিকে মুসল্লিরা ইবাদত, জিকির-আসকার, ধর্মীয় আলোচনার মাধ্যমে ইজতেমা ময়দানে নির্ঘূম রাত কাটিয়েছে।

 

নিরাপত্তা ব্যবস্থা; আইন শৃঙ্খল বাহিনীর পক্ষে টঙ্গী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ইসমাইল হোসেন বাংলানিউজকে বলেছেন, দ্বিতীয় পর্বের ইজতেমা সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে সম্পন্ন করতে সরকারের পক্ষ থেকে ব্যাপক প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। এবারও ইজতেমার আইন শৃঙ্খলা রক্ষায় ১২ সহস্রাধিক সদস্য নিয়োজিত আছে। ইজতেমা মাঠে মুসল্লীদের সুবিধার্থে প্রথম পর্বের নেয়া সব ধরনের প্রস্তুতি অটুট রয়েছে। পর্বের মতই ৬০ টি সি সি টিভি ক্যামেরা, ৯টি ওয়াচ টাওয়ার ও মাল্টিমিডিয়ার মাধ্যমে প্রতিমুহূর্তের গতিবিধি পর্যবেক্ষন করা হচ্ছে।

 

বাংলাদেশ সময়: ১০৩৫ ঘন্টা, ফেব্রুয়ারী ০২,১০১৫

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

মীর ফারুক, তুহীন সারোয়ার
বিশ্ব ইজতেমা ময়দান টঙ্গী থেকে; দিল্লীর মাওলানা যোবায়রুল হাসানের মৃত্যুর পর এবার ভারতের মাওলানা সা’দের পরিচালনায় অনুষ্ঠিত আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে তাবলিগ জামাতের দুই পর্বের ৫০তম বিশ্ব ইজতেমা শেষ হলো।

সকাল মিনিট থকে মিনিট পযর্ন্ত মোনাজাত অনুষ্ঠিত হয়। মিনিট স্থায়ী এই মোনাজাতে দুহাত ঊর্ধ্বমুখী করে বিশ্ব ইজতেমায় অংশ নেওয়া কয়েক লাখ মুসল্লি আমিন আমিন ধ্বনিতে মুখরিত করে তোলেন ইজতেমা ময়দান। পুরো টঙ্গী এলাকা মুখরিত হয়ে ওঠে মোনাজাতের সময়। মোনাজাতে বিশ্ব মুসলিমের সুখ, শান্তি ও সমৃদ্ধি কামনা করা হয়। সেই সঙ্গে বাংলাদেশের জন্যও দোয়া করা হলো।

বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্ব শুরু হয়েছিল ৯জানুয়ারি। ১১জানুয়ারি আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে তা শেষ হয়। দ্বিতীয় ও শেষ পর্বের বিশ্ব ইজতেমা শুরু হয় ১৬জানুয়ারি। ১৮ জানুয়ারী রোববার আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে তা শেষ হলো।

বিশ্বের ৮৮টি দেশের ৪হাজার ৫৭৪ জন বিদেশী মেহমানসহ কয়েক লাখ মানুষ এই আখেরি মোনাজাতে অংশগ্রহণ করেন। কয়েকটি স্যাটেলাইট টেলিভিশনে সরাসরি মোনাজাত সম্প্রচারের ফলে বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ পরোক্ষভাবে মোনাজাতে শরিক হতে পেরেছেন।

হেদায়াতি বয়ান
মোনাজাতের আগে চলে হেদায়াতি বয়ান। বয়ানে বলা হয়, আল্লাহর গজবের বড় স্থান হচ্ছে জাহান্নাম। তিনি আল্লাহর রাস্তায় (তাবলিগে) দাওয়াতি কাজে পায়ে হেঁটে মানুষের কাছে দাওয়াত পৌঁছে দেয়ার পরামর্শ দেন। কারণ পায়ে হেঁটে বেশি মানুষকে দ্বীনের দাওয়াত দেয়া সম্ভব হবে। এতে পায়ে যে ধূলাবালি লাগবে তা জাহান্নামের আগুনকে ঠান্ডা করে দেয়। তিনি তাবলিগের দাওয়াতি কাজে গিয়ে মানুষের কাছে ইহজগতের জন্য ছওয়াল করতে বারণ করে বলেন, যে জামাত ছওয়াল করে আল্লাহর সাহায্যের দরজা তাদের জন্য বন্ধ হয়ে যায়। ছওয়াল করলে দিলে শয়তান স্থান পায়। দাওয়াতি কাজে সবচেয়ে বড় কাজ হলো নিজের নিয়তকে সহি করা এবং অন্যের কাছে ছওয়াল না করা।

মোবাইল ফোনে মোনাজাতে অংশগ্রহণ
ইজতেমা স্থলে যেতে পরিবহন সংকট ও ভিড় এড়াতে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে লোকজন মোবাইল ফোনে মোনাজাতে অংশ নেয় বলে জানা গেছে। ইজতেমার মূল মাঠ থেকে প্রায় ১২ কিলোমিটার দূরে গাজীপুর সদরের চান্দনা চৌরাস্তা ঈদগাহ ময়দানে কয়েক হাজার মুসুল্লি জমায়েত হন। পরে তারা মোবাইল ও পুলিশের ওয়াকিটকির মাধ্যমে ইজতেমা স্থলে যোগাযোগ রক্ষা করে বিশ্ব ইজতেমার আখেরি মোনাজাতে শরিক হয়েছেন। একই ভাবে জেলার ভোগড়া, বাসন সড়ক ও শিমুলতলী এলাকায় মোবাইল মোনাজাত অনুষ্ঠিত হয়।

মোনাজাত শেষে যান ও জনজট
আখেরি মোনাজাত শেষ হওয়ার পরপরই বিভিন্ন স্থানে অবস্থান নেয়া মানুষ একযোগে নিজ নিজ গন্তব্যে ফেরার চেষ্টা করেন। মুসুল্লিরা শুরু করে দেয় হুড়োহুড়ি এবং আগে যাওয়ার প্রতিযোগিতা। এতে টঙ্গীর আশে-পাশের সড়ক-মহাসড়কগুলোতে সৃষ্টি হয় জনজট ও যানজট। ফলে আবারো পায়ে হেঁটে রওনা দেয় মুসল্লিরা। আর পাঁয়ে হাঁটা মুসুল্লিদের চাপে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে আসা মুসুল্লীদের যানবাহন আটকা পড়ে যায়।
বিদায় বিশ্ব ইজতেমা ২০১৫
বিশ্বের মুসলমান সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় অনুষ্ঠান পবিত্র হজ্জ্ব পালনের পর দ্বিতীয় অনুষ্ঠান বিশ্ব ইজতেমা। রূপকথার কাহিনী রয়েছে, টঙ্গীর তুরাগ তীরে এক সময় হানিফা সোনাবানের যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধে বীর হানিফাকে প্রতিপক্ষ যুদ্ধা সোনাবান, তুরাগ তীরে মাটির নীচে দাবিয়ে দিয়েছেন বলে প্রবাদ রয়েছে। ১৯৬৬ পূর্ববর্তি সময়ে বিশ্ব ইজতেমা শুরুর পূর্বে এই তুরাগতীর ছিল পর্যটকদের চারণ ক্ষেত্র। এই স্থানে ইজতেমা শুরু হলেও এখনো রুপকথার বিখ্যাত স্থান টঙ্গীর এই তুরাগ তীরে মাঝে মাঝেই পর্যটক এসে পড়ে। বিভিন্ন ইতিহাস থেকে জানা যায়, বিশ্ব ইজতেমা বাংলাদেশে শুরু হয় মূলত দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের পূর্বের বছরে ১৯৮৬ সালে। ১৯৪৬ সালে তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকার কাকরাইল মসজিদে অনুষ্ঠিত হয় প্রথম বিশ্ব ইজতেমার নামাজ। পূর্ব পাকিস্তান সরকারের সিদ্ধান্তে ১৯৪৮ সালে এই ইজতেমাকে চট্টগ্রাম হাজী ক্যাম্পে স্থানান্তর করা হয়। এর ৯ বছর পর নারায়নগঞ্জ জেলার সিদ্ধিরগঞ্জে অনুষ্ঠিত হয় বিশ্ব ইজতেমা। এরপর ১৯৬৬ সাল থেকে গাজীপুর জেলার টঙ্গী পৌর এলাকাধীন ঐতিহাসিক তুরাগ তীরে ১৬০ একর জমির উপর অনুষ্ঠিত হচ্ছে বিশ্ব ইজতেমা। ২০১১ সাল থেকে দুই পর্বে বিভক্ত হয়ে এই ইজতেমা হচ্ছে। প্রথম পর্ব ১৩,১৪ ও ১৫ জানুয়ারি এবং দ্বিতীয় পর্ব ২০, ২১ ও ২২ জানুয়ারি ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয়। দুই পর্বে ১৫ ও ২২ জানুয়ারি দুটি আখেরি মোনাজাত অনুষ্ঠিত হয়। দুটি মোনাজাতই পরিচালনা করেন বিশ্ব তাবলীগ জামাতের মুরুব্বী দিল্লীর মাওলানা জোবায়ারুল হাসান। ২০১২ সালের দুই পর্বের ইজতেমায় প্রায় দুই শতাধিক যৌতুক বিহীন বিয়ে হয়। প্রথম পর্বে ১০৪ টি ও দ্বিতীয় পর্বে ১০৩ টি বিয়ে হয়। ২০১২ সালের ইজতেমায় প্রায় ১’শটি দেশের ২০ হাজারেরও অধিক বিদেশী মেহমান অংশগ্রহণ করেন। ২০১৩ সালের বিশ্ব ইজতেমা দুই পর্বে অনুষ্ঠিত হয়। প্রথম পর্ব ১১,১২ ও ১৩ জানুয়ারী এবং দ্বিতীয় পর্ব ১৮,১৯ ও ২০ জানুয়ারী। ২০১৪ সালে বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্ব শুরু হয়েছিল ২৪ জানুয়ারি। ২৬ জানুয়ারি আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে তা শেষ হয়। দ্বিতীয় ও শেষ পর্বের বিশ্ব ইজতেমা শুরু হয় ৩১ জানুয়ারি। ০২ ফেব্রুয়ারী রোববার আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে তা শেষ হয়।

২০১৫ ব্যাত্রিক্রমী ইজতেমা: এই প্রথম দুই পর্বের ইজতেমা জনৈতিক দলের অবরোধের মাধ্য দিয়ে অনুষ্ঠিত হলো।
বিদেশী মেহমান: বিশ্বের ১৫৫টি দেশের প্রায় ১৫হাজার মুসল্লী এবারের ইজতেমায় অংশ গ্রহন করেন। দেশ গুলোর মধ্যে কয়েকটি হল, মিসর, ওমান, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব-আমিরাত, কাতার, অষ্ট্রেলিঅংশ গ্রহনকারী দেশ গুলো মধ্যে হলো, ব্রনাই, কানাডা, কম্বোডিয়া, ডেনমার্ক, ফিনল্যান্ড, জার্মানী, ইরান, জাপান, মাদাগাস্কার, মালি, মোজাম্বিক, নাইজেরিয়া, পানামা, সেনাগাল, দঃ আফ্রিকা, তাঞ্জেনিয়া, ত্রিনিদাদ, রাশিয়া, আমেরিকা, জিম্বাবুই, বেলজিয়াম, ক্যামারুন, চীন, কমোরেস, ফিজী, ফ্রান্স, ইন্দোনেশিয়া, ইটালী, কেনিয়া, মালয়শিয়া, মায়ানমার, নিউজিল্যান্ড, নরওয়ে, ফিলিপাইন, সিঙ্গাপুর, শ্রীলঙ্কা, সুইডেন, থাইল্যান্ড, তার্কি, যুক্তরাজ্য, জাম্বিয়া, কোরিয়া, আলজিরিয়া, ডিজিবুতি, ইথোপিয়া, ইরাক, ফিলিস্তিন, কুয়েত, মরক্কো, কাতার, সোমালিয়া, সিরিয়া, তিউনিসিয়া, ইয়েমেন, পাকিস্তান, বাহরাইন, ইরিত্রিয়া, জর্দান, মৌরিতানিয়া, ভারত, সুদান, দুবাই।

মুসল্লীর মৃত্যু; ২০১৫ সালে ইজতেমায়র দুই পর্বে মোট ১৭মুসল্লী মারা যায়। ১মপর্বে ৯জন ও ২য় পর্বে ৮জন। এরমধ্যে শীতে ও হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা যায়, ১৫জন। ট্রেনে কাটা পড়ে ১জন। তবে ইজতেমা এলাকার বাইরে ট্রেনে কাটা পড়ে মারা গেছেন আরো ৩জন।

২০১৩ সালের দুই পর্বে ২১ জন মুসল্লি ইজতেমা ময়দানে মার যান। প্রথম পর্বে ১১ জন ও দ্বিতীয় পর্বে ১০ জন মারা যান।
যৌতুক বিহীন বিয়ে; প্রথা অনুযায়ী প্রতি বছর বিশ্ব ইজতেমায় যৌতুক বিহীন বিয়ে হয়ে থাকে। ১ম পর্বে ১২০টি ও ২য় পর্বে ৯০টি সহ মোট ২১০টি যৌতুক বিহীন বিয়ে সম্পন্ন হয়েছে।

আটক; টঙ্গী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা(ওসি) ইসমাইল হোসেন এবারের বিশ্ব ইজতেমায় মোট ৩৫ জন কে বিভিন্ন অপরাধে আটক করা হয়েছে।

জড়িমানা; ১০টি ভ্রাম্যমান আদালত দুই পর্বে ২লাখের বেশী টাকা জড়িমানা করে মামলা দায়ের করেছেন।

এ বারে টঙ্গীর বিশ্ব ইজতেমা উপলক্ষে সরকার সর্বোচ্চ নিরাপত্তা মূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। এর মধ্যে বিভিন্ন ভাবে প্রায় ১২ হাজারের মত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য নিয়োজিত ছিলেন। রাত ২টা পূর্ব নির্ধারিত সময়সূচী অনুযায়ী ভোগড়া বাইপাস থেকে টঙ্গীর ইজতেমা ময়দান পর্যন্ত ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক বন্ধ হয়ে যায়।

এদিকে শনিবার বিকেল থেকেই মুসল্লিদের ঢল নামে ময়দান অভিমুখে। মহাসড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেয়ার আশঙ্কায় অন্ধকার থাকতেই তীব্র শীত উপেক্ষা করে মুসল্লিরা ময়দান অভিমুখে যাত্রা করে। তারা ব্যাক্তিগত পরিবহন, বাস, রিক্সা, অটোরিক্সা যোগে অথবা পায়ে হেঁটে ময়দানের এসে পৌছে। ভোর ৫ টার দিকে ঢাকা- ময়মনসিংহ মহাসড়কের আব্দুল্লাহপুর এবং ভোগড়া পয়েন্টে যান চলাচল বন্ধ করে দিয়েছে পুলিশ। ফলে পায়ে হেঁটে দীর্ঘ পথ পেড়িয়ে মানুষ ফজরের জামায়াতে অংশগ্রহন করে। এদিকে মুসল্লিরা ইবাদত, জিকির-আসকার, ধর্মীয় আলোচনার মাধ্যমে ইজতেমা ময়দানে নির্ঘূম রাত কাটিয়েছে।

নিরাপত্তা ব্যবস্থা; আইন শৃঙ্খল বাহিনীর পক্ষে টঙ্গী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ইসমাইল হোসেন বাংলানিউজকে বলেছেন, দ্বিতীয় পর্বের ইজতেমা সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে সম্পন্ন করতে সরকারের পক্ষ থেকে ব্যাপক প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। এবারও ইজতেমার আইন শৃঙ্খলা রক্ষায় ১২ সহস্রাধিক সদস্য নিয়োজিত আছে। ইজতেমা মাঠে মুসল্লীদের সুবিধার্থে প্রথম পর্বের নেয়া সব ধরনের প্রস্তুতি অটুট রয়েছে। পর্বের মতই ৬০ টি সি সি টিভি ক্যামেরা, ৯টি ওয়াচ টাওয়ার ও মাল্টিমিডিয়ার মাধ্যমে প্রতিমুহূর্তের গতিবিধি পর্যবেক্ষন করা হচ্ছে।

বাংলাদেশ সময়: ১০৩৫ ঘন্টা, ফেব্রুয়ারী ০২,১০১৫

 

 

 

 

 

 

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *