আইনশৃঙ্খলা বাহিনীতেই সর্বাধিক আক্রান্ত

Slider জাতীয় সারাদেশ


ঢাকা: করোনায় একের পর এক আক্রান্ত হচ্ছেন আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, পরিষেবা সংস্থার সদস্যরা। প্রাণঘাতি করোনায় আক্রান্তের তালিকায় রয়েছেন আনসার ভিডিপি, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স, র‌্যাব, পুলিশ ও সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা। দায়িত্ব পালন করতে গিয়েই একের পর এক আক্রান্ত হচ্ছেন তারা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও পরিষেবা সংস্থাগুলোর মধ্যে এখন পর্যন্ত পুলিশেই সবচেয়ে বেশি সদস্য করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। করোনা প্রতিরোধে সর্বত্র যখন লকডাউন। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া বাসার বাইরে বের হচ্ছেন না কেউ তখনও দায়িত্ব পালন করতে হয়েছে তাদের। টহল টিমের সঙ্গে যেতে হচ্ছে প্রধান সড়ক থেকে অলিগলিতে। নিরাপত্তা দিতে হচ্ছে জনগণের জান-মাল থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের।

পাহারা দিতে হচ্ছে বিভিন্ন স্থাপনা-সম্পদের। এমনকি গুরুত্বপূর্ণ মামলার তদন্ত, আসামি গ্রেপ্তারও থেমে নেই। একইভাবে অগ্নিনির্বাপনে জন্য যখন তখন ঘটনাস্থলে ছুটে যেতে হচ্ছে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের। কাছাকাছি যেতে হচ্ছে বিভিন্ন মানুষের। একইভাবে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে আক্রান্ত হচ্ছেন সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরাও।
সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে পুলিশ: প্রাণঘাতি করোনা ভাইরাসে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে পুলিশ সদস্যরা। চেকপোস্ট। টহল। দিন-রাত মহাসড়কে, শহরের অলি-গলিতে দাযিত্ব পালন। এমনকি কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিত করতেও ছুটে যাচ্ছে পুলিশ। অস্বাভাবিকভাবে মৃত্যুর পর লাশ উদ্ধার করে মর্গে নিয়ে যাচ্ছে। এমনকি করোনা আক্রান্ত রোগীর মৃত্যুর পর যখন জানাযা, দাফন করাতে কেউ এগিয়ে যেতে চায় না তখনও এগিয়ে গেছে পুলিশ। পুলিশ কর্মকর্তারা মনে করেন, ঝুঁকিপূর্ণভাবে দায়িত্ব পালন করতে গিয়েই আক্রান্ত হয়েছে পুলিশ সদস্যরা।

এই পর্যন্ত করোনায় প্রাণ দিতে হয়েছে পুলিশের ৭ সদস্যকে। পুলিশ সদর দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, বুধবার পর্যন্ত সারাদেশে পুলিশের ১৯শ’ ২৬ সদস্য আক্রান্ত হয়েছেন। এরমধ্যে ঢাকা মেট্টোপলিটন পুলিশের ৯শ’ ৭ সদস্য। উপসর্গ দেখা দেয়ায় আইসোলেশনে রয়েছেন ১ হাজার ১শ’ ৫৯ জন। কোয়ারেন্টাইনে রয়েছেন ৪ হাজার ৯ শ’ ৬১ জন। এ পর্যন্ত সুস্থ হয়েছেন ২শ’ ৯৮ জন সদস্য।
এসব বিষয়ে পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি সোহেল রানা বলেন, করোনায় আক্রান্ত পুলিশ সদস্যের সুচিকিৎসাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। রাজারবাগ কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালসহ পুলিশের অন্যান্য হাসপাতালগুলোতে করোনা সংক্রান্ত চিকিৎসা সুবিধা বাড়ানো হয়েছে। এছাড়া বিভাগীয় পর্যায়েও করোনা আক্রান্ত পুলিশ সদস্যদের সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। ইতিমধ্যে অনেকে সুস্থ হয়েছেন বলে জানান তিনি।
সিএমএইচে চিকিৎসা নিয়েছেন ৩৪৫ জন: প্রাণঘাতি করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে শুরুতেই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল সমূহ। এখন পর্যন্ত ঢাকা সিএমএইচে সশস্ত্র বাহিনীতে কর্মরত ও অবসরপ্রাপ্ত ৩৪৫ জন সামরিক-অসামরিক সদস্য ও তাদের পরিবারবর্গ কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন। মৃত্যু হয়েছে ৬ জনের। এরমধ্যে চার জন ৭০ বছর ঊর্ধ্ব অবসরপ্রাপ্ত এবং দুই জন কর্মরত সেনা সদস্য। তারা প্রত্যেকেই শারীরিক বিভিন্ন জটিলতায় ভুগছিলেন। এ পর্যন্ত ৮৮ জন রোগী সুস্থ হয়েছেন। আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) জানিয়েছে, অদ্যাবধি এএফআইপিতে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় ৩১৯৪ জনের নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। এছাড়াও সকল সিএমএইচে পর্যাপ্ত পরিমাণ পিপিই, মাস্ক, গ্লাভস এবং প্রয়োজনীয় ওষুধসহ আনুষঙ্গিক চিকিৎসা সরঞ্জামাদি মজুদ রয়েছে। পাশাপাশি সিএমএইচসমূহে পরিকল্পিতভাবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চিকিৎসকদের সার্বক্ষণিক উপস্থিতি নিশ্চিত করা হচ্ছে।
বাংলাদেশ আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষাবাহিনীর ১৬১ জন আক্রান্ত: বাংলাদেশ আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষাবাহিনীর একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন পর্যায়ের ১৬১ সদস্য ও কর্মচারী করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। করোনা ভাইরাসে এ পর্যন্ত এই বাহিনীর একজন সদস্য প্রাণ হারিয়েছেন। তার নাম আব্দুল মজিদ। গত ১১ই মে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু ঘটে। তিনি পিসি, অঙ্গীভূত আনসার। তিনি ডিএমপি’র ভাটারা থানায় কর্মরত ছিলেন।
আক্রান্তদের মধ্যে রয়েছেন বাহিনীর একজন উপ-মহাপরিচালক। ৬৪ জন ব্যাটালিয়ন আনসার, ৯৪ জন অঙ্গীভূত আনসার, এক জন মহিলা আনসার ও এক জন নার্সিং সহকারী। আক্রান্ত সদস্যদের মধ্যে ৫৮ জন ব্যাটালিয়ন আনসার জাতীয় সংসদ ভবনে এবং ৬৬ জন অঙ্গীভূত আনসার সদস্য ঢাকা মহানগর পুলিশের সঙ্গে কর্মরত। এ ছাড়া বাকীদের কেউ সদর দপ্তর এবং কেউ বিভিন্ন জেলায় কর্মরত রয়েছেন।
আক্রান্তদের মধ্যে নিজ বাসায় কোয়ারেন্টিনে রয়েছেন এক জন। প্রাতিষ্ঠানিক ও বিভিন্ন আবাসিক হোটেলে কোয়ারেন্টিনে রয়েছেন ৪৩৪ জন। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল, কুয়েত বাংলাদেশ মৈত্রী সরকারি হাসপাতাল, মুগদা জেনারেল হাসপাতাল, সাজেদা মেডিকেল, ও রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালসহ দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে বাহিনীর ১৫০ জন সদস্য করোনা উপসর্গ নিয়ে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। এ পর্যন্ত করোনা আক্রান্তদের মধ্যে সুস্থ হয়েছেন ১১ জন।
ফায়ার সার্ভিসে আক্রান্ত ১৬ জন: ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স-এর তিন জন কর্মী নতুন করে করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। এ নিয়ে মোট ১৬ জন কর্মকর্তা কর্মচারী করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হলেন। বর্তমানে তাদের মধ্যে একজনকে হোম কোয়ারেন্টিনে এবং বাকি ১৫ জনকে প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনে রাখা হয়েছে। অগ্নি নির্বাপণ ও উদ্ধার কাজে অংশ নিয়ে তাদের কয়েকজন প্রথমে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। পরে তাদের থেকে অন্যরা সংক্রমিত হয়ে থাকতে পারেন। করোনা আক্রান্তদের মধ্যে আট জন সদরঘাট ফায়ার স্টেশনের, দুই জন পোস্তগোলা ফায়ার স্টেশনের, একজন অধিদপ্তরের অফিস শাখার, চার জন সদরদপ্তর সিদ্দিক বাজার ফায়ার স্টেশনের এবং একজন ঢাকা কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ কক্ষের কর্মী। এছাড়া সদরঘাট ফায়ার স্টেশনের আরো সাত জনের নমুনা পরীক্ষার জন্য দেয়া হয়েছে বলে ফায়ার সার্ভিস সদর দপ্তর সূত্রে জানা গেছে।
আক্রান্ত হচ্ছে র‌্যাব সদস্যরা: দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে একের পর এক আক্রান্ত হচ্ছেন র‌্যাব সদস্যরা। গত ৪ঠা মে র‌্যাব-১১ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল ইমরান উল্লাহ সরকার সাংবাদিকদের জানান, নারায়ণগঞ্জে মোট ৫৫ জন র‌্যাব সদস্যের নমুনা পরীক্ষায় করোনা পজিটিভ এসেছে। আক্রান্তদের মধ্যে বেশ কয়েকজন সিনিয়র কর্মকর্তাও রয়েছেন। গত ১২ই মে র‌্যাব-১০ কেরানীগঞ্জ ক্যাম্পের ৫৯ জন সদস্য করোনা পজেটিভ বলে শনাক্ত হন। নারায়ণগঞ্জ ও কেরানীগঞ্জে মোট ১১৪ জন র‌্যাব সদস্য আক্রান্ত হয়েছেন। তবে এ পর্যন্ত সারাদেশে কত জন আক্রান্ত হয়েছেন তা জানাতে পারেনি র‌্যাব সদরদপ্তর। এ বিষয়ে র‌্যাব সদর দপ্তরের সহকারী পরিচালক সুজয় সরকার বলেন, সম্পূর্ণ তথ্য নেই। তবে আক্রান্তদের যথাযথ চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে বলে জানান তিনি।
আক্রান্ত হয়নি বিজিবি: এখন পর্যন্ত আক্রান্ত হননি বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)’র কোনো সদস্য। এ বিষয়ে বিজিবির পরিচালক লে. কর্নেল ফাইজুর রহমান মানবজমিনকে বলেন, বিজিবি সদস্যরা নিয়মিত সীমান্তে কাজ করছেন। করোনা ভাইরাস প্রতিরোধেও বিজিবি কাজ করছে। বিভিন্নস্থানে ত্রাণ দিচ্ছে। জনগণকে সচেতন করছে। তারপরও এখন পর্যন্ত বিজিবি’র কোনো সদস্য আক্রান্ত না হওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, দেশে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণের শুরুতেই বিজিবি অত্যন্ত সচেতন ছিলো। বিজিবি সদস্যদের সুরক্ষা সামগ্রী দেয়া হয়েছে। সচেতনতার সঙ্গে কাজ কারার কারণেই কেউ আক্রান্ত হননি এ পর্যন্ত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *