রুপের নদী গণেশ্বরীর রুপ সায়রে ডুবসাঁতার

কৃষি, পরিবেশ ও প্রকৃতি বাংলার মুখোমুখি

DSC_0300

মো. মনির হোসেন: ভারতের মেঘালয় রাজ্যের চেংমাং  নামক গারো পাহাড় থেকে নেমে আসা এক চপলা-চঞ্চলা নদীর নাম গণেশ্বরী। নদীর একপাশে ভারত সীমান্তে সারি সারি উঁচু পাহাড়। ঘন সবুজ অরণ্য। আরেক পাশে ছোট ছোট টিলা। টিলার পাশ ঘেঁষে গারো, হাজং, হদি, কোচ প্রভৃতি আদিবাসী  সম্প্রদায়ের বৈচিত্র্যময় জনবসতি। নদীর বুকে চিকচিক করে স্বচ্ছ সিলিকা বালি। আর বালির স্তরের নিচ দিয়ে ছুটে চলে জলের ধারা। বলা যায়, ঝরনা ধারা। মাথার ওপর ভেসে বেড়ায় নীল-সাদা মেঘ। নদীতে জলচুম্বন করতে আসা কপোত – কপোতির রোমান্টিক মূহুর্ত  আগুন্তককে সঙ্গীর প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করতে শেখায় ।এ যেন এক অপরূপ, শান্ত, সুনিবিড় ও বৈচিত্র্যময় জনপদ। শুধু নৈসর্গিক সৌন্দর্যই নয়, মুক্তিযুদ্ধ, টঙ্ক ও ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের নানা ইতিহাস-নিদর্শনও ছড়িয়ে আছে সেখানে। বিচিত্র এ জনপদের নাম লেংগুরা। আার লেংগরার সাত শহিদের মাঝারে শ্রদ্ধা নিবেদনের মধ্য দিয়ে আমাদের গণেশ্বরী নদী ভ্রমণ শুরু হয়।

DSC_0336

লেংগুরা  নেত্রকোনা জেলার কলমাকান্দা উপজেলার একটি পাহাড়ী-সীমান্ত  অঞ্চল। দিন দিন এ জনপদ হয়ে ওঠেছে পর্যটক-ভ্রমণপিপাসুদের এক আকর্ষণীয় স্থান। যদিও পর্যটন শিল্পের বিকাশে আজও তেমন কিছুই করা হয়নি  এই সম্ভাবনাময় জনপদে। যোগাযোগ ব্যবস্থা বলতে যা বুঝায় তার ছিটেফোঁটাও নেই এখানে। পর্যটকদের জন্য  থাকার ব্যবস্থা হিসেবে নেই কোন হোটেল মোটেল এমনকি একটি খাবারের দোকানও । তারপরও প্রকৃতিপ্রেমীরা গণেশ্বরীর রুপের মায়ায় চলে আসেন লেংগুরায় , ডুবসাঁতার দেন গণেশ্বরীর রুপ সায়রে।

DSC_0487

পাহাড়ী এলাকায় নদী এঁবেবেঁকে চলে, আর এটি নির্ধারিত হয় পাথরের বুকে খাঁজ কেটে কেটে। পাহাড় থেকে নদীর বুকে নেমে আসে পাথরের বড় বড় চাঁই,যা নদীর তলায় গড়িয়ে গড়িয়ে চলে। চলার পথে পাথরের এই বড় বড় খন্ডগুলো ভেঙ্গে ছোট ছোট টুকরোয় পরিণত হয এবং তার পাশের ধারালো অংশগুলি ক্ষয় হয়ে পাথরের খন্ডটি একটি মসৃণবোল্ডারে পরিণত হয়। পর্যায়ক্রমে  এইবোল্ডারগুলো ভাঙতে ভাঙতে প্রথমে নুড়ি পাথর,পরে মোটা বালু ও সবশেষে মিহি বালু এবং কাদামাটিতে পরিণত হয়।

FF

বাংলাদেশের সীমান্ত ছুঁয়ে সারি সারি পাহাড়, টিলা, নদী, আদিবাসী জীবনধারা ও ইতিহাসÑসবকিছু মিলিয়ে লেঙ্গুরা মানেই এক নয়নাভিরাম দৃশ্য। পাহাড়ের গহীন অরণ্য আর জীব-জানোয়ারের সঙ্গে মিতালী করে গারো, হাজং, হদি, কোচ প্রভৃতি আদিবাসীরা তাদের প্রতিদিনকার কাজ করেন।

moru_5031699

বড় পাহাড়গুলো ভারত সীমানায় অবস্থিত হওয়ার কারণে সেগুলোতে ওঠা যায় না। কিন্তু তাতে কী, দেখতে তো বাধা নেই! লেঙ্গুরায় বাংলাদেশের সীমানায়ও আছে কয়েকটি ছোট পাহাড়। এগুলো টিলা নামে পরিচিত। যেমনÑমমিনের টিলা, চেয়ারম্যানের টিলা, গাজীর টিলা প্রভৃতি। নানান প্রজাতির গাছ-গাছালি, পাখ-পাখালিতে পরিপূর্ণ টিলাগুলোতে ওঠলে মন হারিয়ে যায় প্রকৃতির রাজ্যে। মমিনের টিলাটি ভ্রমণপিপাসুদের জন্য সবচেয়ে সুবিধাজনক। বেশ বড় এবং বিশাল এলাকাজুড়ে বিস্তৃত। সমতল থেকে অনেক উঁচু টিলাটিতে ওঠার জন্য জেলা পরিষদের উদ্যোগে নির্মাণ করা হয়েছে পাকা সিঁড়ি। সিঁড়ি ছাড়াও গাছের পাতা-লতা আঁকড়ে ধরে পাথর-মাটির বিকল্প পথ দিয়েও ওঠা যায় ওপরে। ভ্রমণপিপাসুদের সুবিধার্থে টিলার ওপর নির্মাণ করা আছে বেশকিছু পাকা বেঞ্চ ও ছাতা। টিলায় দাঁড়িয়ে উত্তর-পূর্ব দিকের বড় বড় পাহাড়গুলো আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে আয়নার মতো। আর টিলার নিচের এক পাশ দিয়ে দেখা যায় গণেশ্বরী নদীর বিচিত্র রূপ। ছবির মতো এক নদী।

গারো পাহাড় থেকে অনেকটা ঝরনার মতো নেমে আসা এ নদীটি বর্ষায় থাকে খরস্রোতা। আর শুষ্ক মৌসুমে এর বুকজুড়ে দেখা যায় শুধুই বালি আর বালি। কিন্তু অবাক হতে হয়Ñ বালির নিচেই পানির প্রবাহ দেখে। নদীর বুকে সামান্য গর্ত করে খানিক অপেক্ষা করলেই তা টলটলে পানিতে ভরে যায়। আর তা দিয়েই গোসলসহ দৈনন্দিন চাহিদা মেটান স্থানীয়রা। অনেকে আবার নদীর বুক থেকে আহরণ করেন প্রাকৃতিক কয়লা, নুড়ি পাথর। পাথর তুলতে আসা চাঁন মিঞা চাচা জানান আগের মত আর পাথর পাওয়া যায় না। কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন ,এখন আর আগের মত পাহাড়ী ঢল আসে না। তার অর্থ হচ্ছে উৎস স্থলে ঢল বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে।

শুষ্ক মৌসুমে গণেশ্বরীকে অনেকটা সমুদ্রসৈকতের মতো মনে হয়। ইচ্ছা জাগলে প্রাণ খুলে হাঁটাও যায় নদীতে। আমি আগেই বলেছি গনেশ্বরী নদীটি ভারতের মেঘালয়ের একটি গারো পাহাড় থেকে উৎপত্তি। আর এ নদীর পানির উৎস পাহাড়ী ঢল। আর পাহাড়ী ঢল উৎপত্তিস্থলে বাঁধাপ্রাপ্ত হওয়ার কারণে  এবং আমাদের বৈরী আচরনে নদীাটি আজ নিশ্চিহ্ন হওয়ার পথে এক পা দু পা করে এগিয়ে যাচ্ছে। ফলে তীরবর্তী মানুষ নানা ভাবে ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। তাদের চাওয়া একটাই আগামী প্রজন্মের সুরক্ষার জন্য যাতে নদীটি রক্ষা করা হয়। নদীটি উৎপত্তিস্থল থেকে বিভিন্ন পথ অতিক্রম করে নেত্রকোনা শহরের পূর্বধলার কাছাকাছি জাঞ্জাইলে কংস নদীতে গিয়ে মিশেছে।চলার পথে হেশ্বরী,কংস,ঘোড়াউৎরা ,সুরমা নদীসহ আরো অনেক নদীকে পানি দান করেছে এই গণেশ্বরী।
######################
লেখক:মো. মনির হোসেন
নদী পরিব্রাজক,লেখক,গবেষক ও সংগঠক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *