আজ ইতিহাসে স্মৃতির পাতা খুলবে এক নক্ষত্র ইতির

Slider জাতীয় রাজনীতি

ঢাকা: একজন রহমত আলী। গ্রামের মেঠো পথ থেকে উঠে আসা শিশু কি ভাবে হয়ে উঠে রাজদরবারের সদস্য, সেই কাহিনীর ইতি ঘটবে আজ। আজ চিরনিদ্রায় শায়িত হবেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সাবেক মন্ত্রী পরিষদ সদস্য ও সাবেক আইন প্রণেতা এ্যাডভোকেট রহমত আলী। বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের পূর্ব ইতিহাসের স্বাক্ষী ছিলেন রহমত আলী। আজ তার দাফনের মধ্য দিয়ে শেষ হলো ইতিহাসের একটি জীবন্ত অধ্যায়। আর এরই মধ্যে ইতিহাসে খোলা হবে রহমত আলীর স্মৃতির অধ্যায়। এ্যাডভোকেট রহমত আলী আওয়ামীলীগের কেন্দ্রিয় কমিটিতে ছিলেন, ছিলেন গাজীপুর জেলার সভাপতিও। সংসদ নির্বাচনের পর অনেকবার তার নামও এসেছে রহমত আলী স্পিকার হচ্ছেন, রাষ্ট্রপতি হচ্ছেন। এই কারণে গাজীপুর জেলার শ্রীপুরের সন্তান রহমত আলী জাতীয়ভাবে কত বড় মাপের লোক ছিলেন, ইতিহাস তারই স্বাক্ষী দেয়।

১৯৪৫ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর শ্রীপুর উপজেলার বর্তমান পৌর সভার ১নং ওয়ার্ডের বড়বাড়ি সম্ভ্রান্ত কৃষক পরিবারে জন্ম উজ্জ্বল নক্ষত্র এডভোকেট রহমত আলীর। বাবা মো. আছর আলী ছিলেন পেশায় কৃষক মা শুক্কুরজান বিবি ছিলেন গৃহিণী।

স্কুল জীবনের শুরু থেকে রহমত আলী ছিলেন খুব মেধাবী। তাই উচ্চ শিক্ষা নিতে বেগ পেতে হয়নি কোন দিন। রহমত আলী শ্রীপুর পাইলট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্র থাকাকালীন সময়ে রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই শ্লোগান দেন।

১১ বছর বয়সে শ্রীপুর পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালীন সময়ে ১৯৬২ সালের ১৭ এপ্রিল হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশনের বিরুদ্ধে বক্তব্য দেন তিনি। এডভোকেট রহমত আলী ১৯৬২ সালে ভালুকা উপজেলার বাটাজোর বিএম হাই স্কুল থেকে মেট্রিকুলেশন পাশ করেন। ১৯৭২ সালে শ্রীপুর স্নাতক মহাবিদ্যালয় থেকে মানবিক শাখায় দ্বিতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ হন। ১৯৭৪ সালে শ্রীপুর মহাবিদ্যালয় থেকে বিএ পাশ করে ১৯৮০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন।

কৃষকের ঘরে জন্ম হলেও তিনি আইন বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। লেখা পড়া শেষ করে পেশা হিসেবে বেছে নেন আইন। এভাবে সমাজের নিরীহ নির্যাতিত মানুষকে সেবা করে শুরু হয় তার কর্মময় জীবন।

মহান মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, সাবেক প্রতিমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা মণ্ডলীর সদস্য অ্যাডভোকেট রহমত আলী আওয়ামীলীগের বড় নেতাদের হাত ধরে যোগ দেন আওয়ামীলীগের রাজনীতিতে। শুরু হয় তার দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবন।

এরপর থেকে এই নেতাকে আর কখনও পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি জীবনের সর্বশেষ গন্তব্যে পৌঁছাতে। কারণ ওনার মনে প্রাণে ছিলো মানুষের সেবা করার স্বপ্ন। আর মনের বিতর লালিত স্বপ্ন পূরণ করতে আরোও সুযোগ করে দেন বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ।

বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ থেকে মনোনয়ন নিয়ে ১৯৯১ সালে প্রথম বারের মত সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এডভোকেট রহমত আলী। নির্বাচিত হওয়ার পর একটি দিনও বসে থাকেন নি তিনি।
লেগে যান কাজে কি ভাবে অবহেলিত জনপদ শ্রীপুরকে আধুনিক শ্রীপুর হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা যায়। স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, মসজিদ, মন্দির, বিশ্ব বিদ্যালয়সহ শত শত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন উন্নয়নমূল্লক কাজে হাত দেন তিনি।

একে একে অবহেলিত জনপদ শ্রীপুরকে বাংলাদেশের বুকে সর্বোচ্চ স্হানে পৌছে দিতে জীবেন শেষ দিন পর্যন্ত কাজ করে গেছেন এই সমাজ সংস্কারক।

রহমত আলী সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর্বে শ্রীপুর উপজেলার রাস্তাঘাট গুলোর অবস্থা ছিলো খুবই বেহাল। এই রাস্তা গুলো সংস্কারের জন্য একে একে হাত দেন সব রাস্তায়। উপজেলার সাথে সকল ইউনিয়নের মানুষের যোগাযোগ নিশ্চিত করতে সড়ক গুলোকে প্রশস্ত করেন। রাস্তা ঘাট প্রশস্ত হওয়ার পর উপজেলার সাথে শুরু হয় বিভিন্ন ইউনিয়নের মানুষের যোগাযোগ। এতে করে ব্যবসার প্রসার বৃদ্ধি পেতে থাকে।

এরপর রহমত আলী শ্রীপুর উপজেলার সাথে অনন্য উপজেলার মানুষের সংযোগ স্থাপনের জন্য বিভিন্ন নদীতে বেশ কয়েকটি বড় সেতু নির্মাণ করে পাশ্ববর্তী উপজেলা ভালুকা, গফরগাঁও, কাপাসিয়া, কালীগঞ্জে, কালিয়াকৈরের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করে ব্যবসার দ্বার উন্মোচিত করে দেন। এতে করে তিনি ঘুরিয়ে দেন বাংলাদেশের অর্থনীতির চাকা।

এই মহান মানুষটি বাংলাদেশ জাতীয় সংদের ৫বার জনগণের ভোটে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। বাংলাদেশের সরকারের পল্লী উন্নয়ন সমবায় প্রতিমন্ত্রীরও দায়িত্বে পালন করেন পাঁচ বছর। আর মন্ত্রী থাকাকালীন সময়ে শুধু নিজের সংসদীয় এলাকা নয় পূরো বাংলাদেশ উন্নয়নের ছোঁয়া ছিলো রহমত আলীর।

পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, (১৬ ফেব্রুয়ারী রবিবার ) সকাল সাড়ে ৭টায় রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ তিনি করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর। তিনি স্ত্রী, দুই ছেলে ও এক মেয়ে রেখে গেছেন।

দীর্ঘদিন ধরে ডায়াবেটিস ও কিডনি রোগে ভুগছিলেন রহমত আলী। এর আগে কয়েক দফা থাইল্যান্ডের বামরুনগ্রাদ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। অবস্থার কিছুটা উন্নতি হলে গত ২৮ জানুয়ারি দেশে আনা হয় তাঁকে। তবে অবস্থার অবনতি হলে ওইদিনই তাঁকে রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে লাইফ সাপোর্টে ছিলেন তিনি।

দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে অনেকবার কারাবরণ করেছেন রহমত আলী। ১৯৮৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠকরত অবস্থায় ড. কামাল হোসেনের বাসা থেকে তাঁকে চোখ বেঁধে ক্যান্টমেন্টে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে নির্যাতন চালিয়ে তাঁর ১৭টি দাঁত, ডান হাত ও বুকের একটি হাঁড় ভেঙে ফেলে হয়।

গাজীপুর-৩ আসন থেকে একাধারে পাঁচবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন রহমত আলী। তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নির্বাচন উপকমিটি, বাংলাদেশ কৃষক লীগ ও গাজীপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। অসুস্থতার কারণে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলের মনোনয়ন চাননি তিনি।

রহমত আলীর বড় ছেলে ড. এম জাহিদ হাসান একজন পদার্থবিজ্ঞানী। তিনি বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত। মেঝ ছেলে জামিল হাসান দুর্জয় আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয়। একমাত্র মেয়ে রুমানা আলী টুসী জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত নারী আসনে সংসদ সদস্য। তাঁর মৃত্যুতে বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন শোক প্রকাশ করেছে।

রোববার মরহুমের প্রথম জানাজা শঙ্কর জামে মসজিদে, দ্বিতীয় জানজা বিকেল ৪টায় জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজা, মাগরিববাদ এলিফ্যান্ট রোডের বায়তুল মামুর জামে মসজিদ প্রাঙ্গণে রহমত আলীর জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। গককাল বাদ জোহর সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে চতুর্থ জানাজা শেষে তাঁর মরদেহ হিমঘরে রাখা হয়। আজ মঙ্গলবার বীর মুক্তিযোদ্ধা এড. রহমত আলীর জানাজার নামাজ গাজীপুর রাজবাড়ি মাঠে সকাল ১০ ঘটিকায়, ভবানীপুর মুক্তিযোদ্বা ডিগ্রী কলেজ মাঠে সকাল ১১:৩০ ঘটিকায় ও শ্রীপুর মুক্তিযোদ্ধা রহমত আলী সরকারি কলেজ মাঠে বিকাল ৩ ঘটিকায় অনুষ্ঠিত হবে। অতঃপর পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হবে এই জনপ্রিয় নেতাকে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *