ঢাকা:আবারও রাজনৈতিক টালমাটাল পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে বাংলাদেশে। রাজধানী ঢাকায় পুলিশ
সব ধরনের প্রতিবাদ কর্মসূচি নিষিদ্ধ ও বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়াকে তার কার্যালয়ে আটকে রাখার পর নতুন করে সৃষ্টি হয়েছে এ অবস্থা। এ অবস্থায় প্রান্তসীমায় দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ। ভিন্নমতাবলম্বীদের শক্ত হাতে দমন করা হচ্ছে। কার্যালয়ে খালেদাকে রাত কাটাতে বাধ্য করা হচ্ছে। নাটোরে তার দল বিএনপি’র দুই কর্মীকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে সোমবার সকালে। শাসক দল সমর্থক ও পুলিশের সঙ্গে বিএনপি সমর্থকদের সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ছে দেশব্যাপী। কার্যত পুরো দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়েছে ঢাকাকে। ‘গণতন্ত্রের বিজয়’ ও ‘গণতন্ত্র হত্যা দিবস’কে কেন্দ্র করে ফের উত্তপ্ত রাজধানী ঢাকা সহ গোটা বাংলাদেশ। গতকাল বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে এসব কথা লেখা হয়েছে বিদেশী মিডিয়ায়। এ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী পত্রিকা লিখেছে, নাটোরের স্থানীয় পুলিশ প্রধান নাটোরে দু’জন মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছেন। তবে তিনি দাবি করেন, ওই দুই কর্মীর মৃত্যুর জন্য কারা দায়ী, তা তিনি জানেন না। এদিকে সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও খালেদা জিয়া ও তার সহযোগীরা সোমবারের মহাসমাবেশ করার চেষ্টা করেন। গত বছর অনুষ্ঠিত বিরোধী দলের অংশগ্রহণবিহীন বিতর্কিত নির্বাচনের এক বছর পূর্তি উপলক্ষে এ সমাবেশ ডাকা হয়েছিল। বেগম জিয়া বলেন, কেবল আমিই অবরুদ্ধ নই, পুরো দেশই এখন অবরুদ্ধ। রোববার রাতে এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, মানুষ আমার সঙ্গে আছে এবং সে কারণেই সরকার ভীত। ৬৯ বছর বয়সী সাবেক এ প্রধানমন্ত্রী দ্বিতীয় দিনের মতো নিজের কার্যালয়ে রাত কাটাতে বাধ্য হন। পুলিশ রাতে তার কার্যালয়ের সামনের রাস্তায় বালুভর্তি ট্রাক রেখে ব্যারিকেড সৃষ্টি করে। বেগম জিয়ার সমর্থক কর্মীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ ঘটে। এক পর্যায়ে তারা রাস্তায় শুয়ে পড়েন। এ সময় অন্তত এক ডজন নেতাকর্মী আটক হয়েছে বলে দাবি পুলিশের। পুলিশ বলছে, বেগম জিয়াকে গৃহবন্দি হয় নি। পুলিশ মুখপাত্র মুনিরুল ইসলাম বলেন, তার নিরাপত্তার জন্য আমরা ব্যবস্থা বাড়িয়েছি। কিন্তু বেগম জিয়ার সহযোগীরা বলছেন, সরকার অবৈধভাবে প্রতিবাদ সভায় যেতে তাকে বাধা দিচ্ছে। সোমবার কয়েকশ’ সশস্ত্র পুলিশ বেগম জিয়ার কার্যালয়ের সামনে বেষ্টনী তৈরি করে। অন্তত ১০টি বালুভর্তি ট্রাক, পুলিশ ভ্যান ও সাঁজোয়া যান দিয়ে রাস্তা আটকে দেয়া হয়। এদিকে সাবেক প্রেসিডেন্ট বদরুদ্দোজা চৌধুরী বলেন, গণতন্ত্রকে অবদমিত করে রাখার জন্য এটি একটি স্বৈরতান্ত্রিক পদক্ষেপ। তিনি বেগম জিয়ার কার্যালয়ে প্রবেশ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু পুলিশের বাধায় ফিরে যেতে বাধ্য হন। বেশ কয়েকটি বাসে রোববার প্রতিবাদকারীরা আগুন দেয়। সারা দেশে পুলিশের সঙ্গে কর্মীদের সংঘর্ষ ঘটেছে। রোববার বিকালে সকল ধরনের সভা-সমাবেশ অনির্দিষ্টকালের জন্য পুলিশ নিষিদ্ধ ঘোষণা করার পরই শুরু হয় সংঘর্ষ। দূরপাল্লার বাস, ট্রেন ও লঞ্চ স্থগিত করে দেয়া হয়। ঢাকাকে সারা দেশ থেকে অনেকটা বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়। বাস মালিকরা বলছেন, প্রশাসন তাদেরকে চাপ প্রয়োগ করে সকল ধরনের সেবা বন্ধ করে দিয়েছে। তারা ভয় পাচ্ছেন, সারা দেশ থেকে হাজারো কর্মী হয়তো রাজধানীর দিকে আসতে পারে। তবে পুলিশ এ ধরনের চাপ প্রদানের কথা অস্বীকার করেছে। তাদের দাবি, সহিংসতার কারণে যানবাহন চলছে না। এদিকে বিএনপি ও এর সহযোগী দলসমূহ সোমবার সারা দেশে তাদের ভাষায় ‘গণতন্ত্র হত্যা দিবস’ পালন করার ঘোষণা দিয়েছিল। গত বছর অনুষ্ঠিত ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনের এক বছর উপলক্ষে এ কর্মসূচির ঘোষণা দেয়া হয়েছিল। বিএনপি গত বছরের নির্বাচন বয়কট করেছিল। তারা সে সময় বলেছিল, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রশাসনের উপর তার ক্ষমতা প্রয়োগ করছিলেন, যাতে নির্বাচনে তার দল অবৈধ সুবিধা পায়। তবে হাসিনা এ সমস্ত অস্বীকার করেন। গত সপ্তাহে বেগম জিয়া সরকারকে নতুন করে মধ্যবর্তী নির্বাচন দেয়ার দাবি জানান। এছাড়া বিরোধীদলীয় রাজনৈতিক কর্মীদের মুক্তি দেয়ার আহ্বানও জানান তিনি। তবে সরকার এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে। শাসক দল আওয়ামী লীগের মুখপাত্র মাহবুবুল আলম হানিফ বলেন, বিরোধী দল অরাজকতা সৃষ্টি করতে চায়। গত বছর নির্বাচনকালীন খালেদা জিয়াকে তার ঘরে আবদ্ধ করার ব্যাপারে সরকারের সমালোচনা করেছিল মানবাধিকার সংগঠনগুলো। সরকার বলছিল, তারা কেবল সহিংসতা রোধের চেষ্টা করেছে। আল জাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়, ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ ও বিরোধী দলীয় নেতাকর্মীদের মধ্যে বিভিন্ন শহরে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়েছে। নিরাপত্তা রক্ষাকারীরা খালেদা জিয়াকে তার কার্যালয় থেকে বের হওয়া প্রতিরোধ করেছে। গত বছরের বিতর্কিত নির্বাচনের প্রথম বার্ষিকী উপলক্ষে খালেদা জিয়া তার সমর্থকদের প্রতি আহ্বান জানান রাজপথে নেমে সরকারকে নতুন নির্বাচন দিতে বাধ্য করার জন্য চাপ সৃষ্টি করতে। নাটোরে আওয়ামী লীগের সমর্থকদের সঙ্গে সংঘর্ষে বিএনপির দু’কর্মী নিহত হয়েছেন। ঢাকা ও অর্ধ ডজন শহরে পুলিশ ও আওয়ামী লীগ সমর্থকদের সঙ্গে সংঘর্ষ হয়েছে বিএনপি’র। সুপ্রিম কোর্ট চত্বরে বিক্ষোভ করেছেন কয়েক শ’ বিএনপিপন্থি আইনজীবী। রোববার থেকে পুলিশ প্রধান বিরোধী নেতা খালেদা জিয়াকে তার কার্যালয়ে অবরুদ্ধ করে রেখেছে। আল জাজিরার তানভির চৌধুরী ঢাকা থেকে জানিয়েছেন, শনিবার রাত থেকে খালেদা জিয়াকে তার গুলশান কার্যালয়ে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছে। নারী পুলিশ কর্মকর্তা সহ পুলিশ সদস্যদের মোতায়েন করা হয়েছে কার্যালয়ের বাইরে। ঢাকা পুলিশের মুখপাত্র মাসুদুর রহমান বলেন, প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলগুলো থেকে পাল্টা সমাবেশের ঘোষণার ফলে সহিংসতার শঙ্কায় আমরা নিষেধাজ্ঞা জারি করেছি। রাজধানীর উদ্দেশে সকল বাস ও ফেরি যাত্রা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। কার্যত পুরো দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়েছে ঢাকাকে। দেশ থেকে হাজারো বিরোধী কর্মীরা ঢাকায় আসতে পারে- এমন আশঙ্কায় এটা করা হয়েছে বলে মন্তব্য করেন পরিবহন পরিচালনাকারীরা। রাজধানীতে বিরোধী দলের প্রধান সদর দপ্তরে শনিবার মধ্যরাতে তালা ঝুলিয়ে দেয় পুলিশ। এছাড়া, নিকটবর্তী রাস্তাগুলোতে ব্যারিকেড দিয়ে রাখা হয়। আন্তর্জাতিক মানবাধিকারবিষয়ক আইনজীবী টবি ক্যাডম্যান আল জাজিরাকে বলেন, বাংলাদেশে গণতন্ত্র ভেঙে পড়েছে। তিনি বলেন, দেশটি গণতন্ত্র থেকে অনেক দূরে। আর কর্তৃপক্ষ যে কোন প্রকার প্রতিবাদ, সমালোচনা বন্ধ করার চেষ্টা করেছে। খালেদা জিয়ার সহকারী শিমুল বিশ্বাস জানান, গাড়িতে করে বাইরে যাওয়ার চেষ্টা করা সত্ত্বেও দলীয় কার্যালয়ে খালেদা জিয়াকে রাত অতিবাহিত করতে বাধ্য করা হয়েছে। খালেদা জিয়াকে জোরপূর্বক তার কার্যালয়ে আটক রাখার বিষয়টি অস্বীকার করেছেন পুলিশ ইন্সপেক্টর ফিরোজ কবির। তিনি এএফপিকে বলেন, আমরা তাকে অবরুদ্ধ করিনি, শুধুমাত্র তার নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে। তিনি কার্যালয় থেকে যাচ্ছেন না।
আনন্দবাজার পত্রিকা জানায়, সোমবার দুপুর পর্যন্ত সংঘর্ষে প্রাণ গিয়েছে ২ জনের। আহতের সংখ্যাও অনেক। আটক করা হয়েছে বিরোধী দলের প্রায় ৩০০ নেতাকর্মীকে। এরই পাশাপাশি, অবরুদ্ধ বিরোধী নেত্রী খালেদা জিয়ার কার্যালয়ের বাইরে আরও বাড়ানো হয়েছে পুলিশি নিরাপত্তা। ওই কার্যালয়ে আসা-যাওয়ার রাস্তাটি কার্যত বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। সরকার যদিও এ ক্ষেত্রে বিরোধী নেত্রীর নিরাপত্তার বিষয়টিকেই গুরুত্ব দিচ্ছে বলে দাবি করেছে। ওদিকে ৪ঠা জানুয়ারি বার্তা সংস্থা পিটিআই লিখেছে, কার্যালয়ে খালেদাকে রাত কাটাতে বাধ্য করা হয়েছে। নির্বাচনের বর্ষপূর্তিতে অফিসে বাংলাদেশ পুুলিশ অবরুদ্ধ করে রেখেছে তাকে। এক বছর আগে অনুষ্ঠিত বিতর্কিত নির্বাচনের প্রথম বর্ষপূর্তি ৫ই জানুয়ারি। ওই নির্বাচনকে প্রহসনের নির্বাচন আখ্যায়িত করে সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী তা বর্জন করেছিলেন। ওই রিপোর্টে আরও বলা হয়, বিএনপি’র গুলশানের অফিসে যাওয়ার রাস্তার দু’দিকে ট্রাক দিয়ে তা বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। কাছাকাছি অবস্থান করছে সশস্ত্র ট্রাক, জল কামান ও র্যাবের সদস্যরা। শনিবার দিবাগত রাতে একই রকম ঘটনা ঘটেছে নয়া পল্টনে বিএনপি’র প্রধান কার্যালয়ে। পুলিশ সেখানে তালা ঝুলিয়ে দিয়েছে। এর আগে ওই অফিস থেকে সব নেতাকর্মীকে সরিয়ে দেয়া হয়। তুলে নিয়ে যায় বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীকে। পুলিশ তাকে একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে গেছে। সেখানে তাকে পেটের সমস্যার চিকিৎসা দেয়া হচ্ছিল। এর মধ্য দিয়ে বিএনপির দুটি অফিসই অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছে। বার্তা সংস্থা এপি লিখেছে, নির্বাচনের বর্ষপূর্তিকে সামনে রেখে বাংলাদেশ প্রান্তসীমায় দাঁড়িয়ে। রাজধানীতে পুলিশ সব ধরনের র্যালি নিষিদ্ধ করেছে। বিরোধী দলীয় নেতাকে তার অফিস থেকে বের হতে দেয়া হচ্ছে না। তাকে প্রতিরোধ করা হচ্ছে। অন্যদিকে সারা দেশে বিরোধী দলের অনেক নেতাকর্মীকে আটক করা হয়েছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বর্তমানে বিএনপি প্রধান খালেদা জিয়াকে পুলিশ তার অফিসে কর্ডন করে রেখেছে শনিবার দিবাগত রাত থেকে। তবে কর্তৃপক্ষ বলেছে, তার নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে। অনলাইন ডয়চে ভেলে লিখেছে, ভিন্নমতাবলম্বীদের শক্ত হাতে দমন করছে বাংলাদেশ। ‘বাংলাদেশ অথরিটিজ ক্লাম্প ডাউন অন ডিসেন্ট অ্যাহেড অব ইলেকশন অ্যানিভারসারি’ শীর্ষক ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রধান বিরোধীদলীয় নেত্রীকে তার অফিসে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছে। সোমবার বিতর্কিত নির্বাচনের প্রথম বর্ষপূর্তি। বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ বলছে, রাজনৈতিক পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে যে উত্তেজনা বিরাজ করছে তা নিরসনের চেষ্টা করছে তারা। ঢাকা পুলিশের এক মুখপাত্র মাসুদুর রহমান বলেছেন, সহিংসতার আশঙ্কায় সব রাজনৈতিক দলের সভা-সমাবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে।