ঢাকা: ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচনকে সামনে রেখে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বৈঠক হয়েছে। সেখানে ইসি ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। সবার উপস্থিতিতে অন্যদের পাশাপাশি নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদারও এই গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে কথা বলেছেন। মাহবুব তালুকদার বলেন, চট্টগ্রাম-৮ আসনের সাম্প্রতিক উপনির্বাচনে সবগুলো কেন্দ্রে ইভিএম ব্যবহার করা হয়। এতে ২২ দশমিক ৯৪ শতাংশ ভোট পড়েছে। একাদশ জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম বিহীন ব্যালট পেপারে যে ২৯৪টি আসনে ভোট হয়েছে, ভোটের হার যেখানে ছিল শতকরা ৮০ ভাগ, সেখানে ইভিএম ব্যবহারে ২৯ দশমিক ৩৮ শতাংশ ভোট পড়েছে। এর কারণ ইভিএম নিয়ে ভোটারদের মনে আছে ভীতি। অন্যদিকে ইভিএমে জাল ভোট প্রদান প্রতিহত করা এক বিরাট সমস্যা।
বুথ দখল করে বা গোপন কক্ষে গিয়ে জাল ভোট প্রদানের ঘটনা অবশ্যই প্রতিহত করতে হবে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও অন্যান্য নির্বাচন কর্মকর্তাদের সম্মিলিতভাবে গোপন কক্ষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা আবশ্যক। বর্তমান সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার কমিশনের জন্য এক অগ্নিপরীক্ষা। নির্বাচনে ভোটারদের উপস্থিতি বৃদ্ধিও একান্ত অপরিহার্য। এ জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর সহযোগিতা একান্তভাবে কাম্য। ঢাকা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের সাফল্যের ওপর নির্ভর করছে এই যন্ত্রটির ভবিষ্যত। এই নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার প্রশ্নবিদ্ধ হলে শুধু নির্বাচন নয়, ইভিএম যন্ত্রটির ভবিষ্যতও অনিশ্চিত হয়ে যেতে পারে। আমার মতে যে কোনো নির্বাচনে শতকরা ৫০ ভাগ ভোট না পড়লে নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। এজন্য বিশ্বের অনেক দেশে ৫০ শতাংশের কম ভোট পড়লে পুনরায় ভোট গ্রহণ করা হয়। ইভিএম সম্পর্কে আমার বক্তব্যের বটম লাইন হলো, ইভিএম-এ যদি ৫০ শতাংশ ভোট না পড়ে, তাহলে ব্যালট পেপারে পুনরায় ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হওয়া উচিত। এজন্য নির্বাচনি বিধি-বিধান পরিবর্তন প্রয়োজন হতে পারে। ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের নির্বাচন বর্তমান নির্বাচন কমিশনের কার্যকালের সর্বাধিক গুরুত্বসম্পন্ন নির্বাচন। এই নির্বাচন জাতীয় নির্বাচনের চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। একজন প্রার্থী তো সংসদ সদস্যের পদ ত্যাগ করে এই নির্বাচনে মেয়র পদে প্রার্থী হয়েছেন। নির্বাচনকে ঘিরে রাজধানীবাসীর উৎসুক্য ও উদ্বেগ অন্তহীন। দেশবাসী ও বিশ্ববাসীর দৃষ্টি এই নির্বাচনের দিকে নিবন্ধ। নির্বাচন গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার একমাত্র অবলম্বন। সংবিধানের রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি গণতন্ত্র ও মানবাধিকার অংশে বলা হয়েছে- প্রশাসনের সকল পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হইবে। এজন্য অবাধ সুষ্ঠু নিরপেক্ষ আইনানুগ নির্বাচনের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধি নির্বাচন এত গুরত্বপূর্ণ। যারা সত্য মূল্য না দিয়ে অবৈধভাবে নির্বাচিত হন, তাদের দ্বারা প্রশাসনে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হতে পারে না। সংবিধানের প্রতিটি নির্দেশ প্রজাতন্ত্রের সকল নাগরিকের পরিপালন বাধ্যতামূলক। আমরা সম্ভবত আত্মসমালোচনা বিমুখ। কেন নির্বাচন নিরপেক্ষ শুদ্ধ ও স্বচ্ছ হয় না, এ প্রশ্নের উত্তর আত্মজিজ্ঞাসার কারণেই আমাকে খুঁজতে হয়েছে। আমার অভিজ্ঞতা হচ্ছে, নির্বাচন কমিশন আইনত স্বাধীন কিন্তু বাস্তবক্ষেত্রে সেই স্বাধীনতা নির্বাচন প্রক্রিয়ার কাছে বন্দী। এই বন্দীত্ব থেকে মুক্তির একমাত্র উপায় নির্বাচন প্রক্রিয়ার সংস্কার। তবে সংস্কার কার্যক্রম সার্বিকভাবে নির্বাচন কমিশনের উপর নির্ভর করে না। অনেক সময় রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের স্বার্থে সংস্কার করতে চায়, জনগণের স্বার্থে নয়। দলীয় স্বার্থে সংস্কার কার্যক্রম কখনও সচল কখনও অচল করে রাখা হয়। এহেন সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া হলেও সংস্কার কার্যক্রম অবারিত হয়ে উঠতে পারে না। আমার আত্মজিজ্ঞাসার আর একটি বিষয় আপনাদের সঙ্গে শেয়ার করতে চাই। ঢাকা দুই সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে কয়েকটি সংঘর্ষের ঘটনা ছাড়া এ পর্যন্ত প্রার্থী ও ভোটারদের মধ্যে প্রচারাভিযানে যে সংযোগ সাধন দেখা যাচ্ছে, তাতে জনগণের নির্বাচনমুখীনতার বিষয়ে আমি খুবই আশাবাদী। কিন্তু আমার জিজ্ঞাসা, ঢাকা মহানগরী জুড়ে এখন নির্বাচনের যে উৎসাহ উদ্দীপনা পরিলক্ষিত হচ্ছে, বিগত একাদশ জাতীয় নির্বাচনে তার কিছুই দৃশ্যমান হয়নি কেন? জাতীয় নির্বাচন কি এই স্থানীয় নির্বাচনের চেয়ে কোনো অংশে কম গুরুত্বপূর্ণ ছিল? এই অবস্থা কি নির্বাচন প্রক্রিয়া বা নির্বাচন ব্যবস্থার কোনো সংকট থেকে উদ্ভুত? এ প্রশ্নের জবাব আমাদের খুঁজতে হবে ভবিষ্যতের নির্বাচনকে অবাধ সুষ্ঠু নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য করার স্বার্থেই। নির্বাচন ব্যবস্থাপনার নেতিবাচক দিকগুলো পর্যালোচনা করে, আগামী জাতীয় নির্বাচনে যাতে তার পুনরাবৃত্তি না ঘটে, সে বিষয়ে সচেতন থাকা প্রয়োজন।