ঢাকা: জীবনের ভয়ংকর অভিজ্ঞতাকে পরাস্ত করে দৃঢ় প্রত্যয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন ধর্ষণের শিকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্রীটি। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বেডে শুয়েই পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছেন তিনি। সাহসী এই শিক্ষার্থী তার পরিবার, সহপাঠী ও শিক্ষকদের স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছেন, ১২ জানুয়ারি বিভাগের চূড়ান্ত পরীক্ষায় তিনি অংশ নেবেন। শ্রেণিকক্ষে ক্লাসমেটদের পাশে বসেই পরীক্ষা দেওয়ার প্রত্যয়ও ব্যক্ত করেছেন তিনি। এ জন্য যত তাড়াতাড়ি সম্ভব হাসপাতাল থেকে তাকে ছাড়পত্র দেওয়ার অনুরোধ করেছেন তিনি।
এদিকে একটি সূত্র জানিয়েছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ধর্ষণের ঘটনায় অভিযুক্তকে চিহ্নিত করা গেছে। সম্ভাব্য সেই ধর্ষক এখন নজরদারিতে রয়েছে। যে কোনো সময় তাকে গ্রেপ্তার করা হবে। তার বাসা রাজধানীর কুড়িল এলাকায়। এরপর তাকে বা তার ছবি ঘটনার শিকার ছাত্রীকে দেখিয়ে নিশ্চিত করা হবে। এর মধ্যে তার ছবিও সংগ্রহ করা হয়েছে। গতকাল বিকেলে সম্ভাব্য এ ধর্ষককে ধরতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা কুড়িল বাজার এলাকার একটি বাসায় অভিযান চালিয়েছেন। তবে তাকে গ্রেপ্তার করা গেছে কিনা, তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। গত রাত ১টা পর্যন্ত পুলিশ বা র্যাবের কোনো কর্মকর্তা তাকে গ্রেপ্তারের বিষয় স্বীকারও করেননি। অবশ্য র্যাবের একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে, খুব অল্প সময়ের মধ্যেই জড়িত ধর্ষককে আইনের আওতায় নেওয়া সম্ভব হবে। আজ সকালের মধ্যে গ্রেপ্তারের বিষয়ে আনুষ্ঠানিক ঘোষণাও আসতে পারে।
ধারণা করা হচ্ছে, চিহ্নিত ব্যক্তি একজন পেশাদার অপরাধী। গাড়ি চালানোর আড়ালে সে নানা ধরনের অপরাধ করে থাকে। তবে এসব তথ্যের ব্যাপারে পুলিশ, ডিবি বা র্যাবের কর্মকর্তাদের আনুষ্ঠানিক কোনো ভাষ্য পাওয়া যায়নি।
এ ব্যাপারে র্যাব মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ সমকালকে বলেন, ধর্ষণের ঘটনায় জড়িত কাউকে গ্রেপ্তারের ব্যাপারে বলার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়নি। তবে অল্প সময়ের মধ্যে জড়িত ধর্ষককে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হবে।
গত রাতে র্যাব-১-এর অধিনায়ক লে. কর্নেল শাফি উল্লাহ বুলবুল বলেছেন, তারা অন্তত তিনজনকে শনাক্ত করে নজরদারিতে রেখেছেন। তাদের মধ্যে নিশ্চিতভাবেই ধর্ষকদের একজন রয়েছে। গ্রেপ্তারের পর জিজ্ঞাসাবাদ, ভিকটিমের শনাক্ত এবং আলামত বিশ্নেষণের পর ধর্ষকের বিষয়ে নিশ্চিত করে বলা যাবে। পরীক্ষার প্রস্তুতি যাতে নিতে পারেন, সে জন্য এরই মধ্যে হাসপাতালেই শিক্ষার্থীর কাছে বই ও নোট পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। তিনি প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছেন। তার দৃঢ় ও অদম্য মনোভাবে শিক্ষক, সহপাঠীরা আনন্দিত। লড়াই করে নতুন জীবন শুরু করার যে ইচ্ছাশক্তি তিনি দেখাচ্ছেন, তা অনুকরণীয় বলে জানিয়েছেন তারা। মেধাবী ওই শিক্ষার্থীর মা-বাবাও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জানিয়েছেন, তার মেয়ে
নির্ধারিত দিনেই পরীক্ষায় অংশ নেবে। তার মধ্যে অদম্য সেই প্রাণশক্তি রয়েছে। এদিকে ধর্ষককে দ্রুত গ্রেপ্তারের দাবিতে প্রতিবাদী নানা কর্মসূচিতে গতকালও উত্তাল ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস।
প্রযুক্তিগত তদন্তে শনাক্ত এক তরুণ :ডিবির দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, তারা ঘটনা জানার পরই ছায়াতদন্ত শুরু করেন। মামলার আনুষ্ঠানিক দায়িত্ব পাওয়ার পর জোরালো তদন্ত শুরু হয়। আলামত বিশ্নেষণ, ঘটনার শিকার ছাত্রীর ভাষ্য ও প্রযুক্তিগত তদন্তে এক তরুণকে শনাক্ত করা হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, সে-ই ধর্ষক। তাকে গ্রেপ্তার করা গেলে সব কিছু বেরিয়ে আসবে। ডিবি ছাড়াও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অন্য সংস্থাগুলোও ধর্ষককে শনাক্ত করে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চালাচ্ছে।
র্যাব সূত্র জানিয়েছে, র্যাবের গোয়েন্দারা সম্ভাব্য ধর্ষক হিসেবে এক ব্যক্তিকে শনাক্ত করেছেন। তার অবস্থান নিশ্চিত হয়ে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। গ্রেপ্তার করা গেলে নিশ্চিত হওয়া যাবে শনাক্ত হওয়া ব্যক্তিই ধর্ষক কিনা।
মামলার এজাহারে বলা হয়, ধর্ষণকারীর উচ্চতা পাঁচ ফুট চার ইঞ্চি। গায়ের রং শ্যামলা। মাথার চুল ছোট। পরনে ছিল জিনসের পুরোনো ফুলপ্যান্ট। গায়ে ছিল কালো রঙের ফুলহাতা জ্যাকেট। তার পায়ে স্যান্ডেল ছিল। ঢাবির ওই শিক্ষার্থীর ব্যাগ, দুই হাজার টাকা ও মোবাইল ফোন নিয়ে যায় সে। অজ্ঞাতপরিচয় ওই ধর্ষকের বয়স ২৫-৩০ বছরের মধ্যে। ওই ব্যক্তি তার গলা চেপে ধরে। এতে ওই ছাত্রী অচেতন হয়ে পড়েন। এরপর তাকে ধর্ষণ করা হয়। এর আগে ওই ছাত্রীকে মারধরও করা হয়। এদিকে ২৮ জানুয়ারির মধ্যে এ ঘটনায় দায়ের মামলায় প্রতিবেদন জমা দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন সিএমএম আদালত।
আশপাশের ফুটেজ পুলিশের হাতে :ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীকে কুর্মিটোলার যে ঝোপের ভেতর ধর্ষণ করা হয়েছে, এর আশপাশের অন্তত দুটি সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ পেয়েছে পুলিশ। এ ছাড়া ওই এলাকার আর কোনো সিসিটিভি ক্যামেরায় ঘটনা ধরা পড়েছে কিনা, তা যাচাই করা হচ্ছে। তবে পুলিশের পাওয়া ফুটেজে ধর্ষকের চেহারা ধরা পড়েছে কিনা বা মেয়েটিকে তুলে নিতে দেখা গেছে কিনা, সে বিষয়ে পুলিশ মুখ খুলছে না। মেয়েটির কাছ থেকে ধর্ষকের বর্ণনা শুনে একটি স্কেচ ম্যাপও তৈরি করা হচ্ছে।
পুলিশের মহাপরিদর্শক ড. মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী বলেন, সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে কুর্মিটোলায় শিক্ষার্থীকে ধর্ষণের ঘটনা তদন্ত করছে পুলিশ। পুলিশের সব ইউনিট অপরাধীকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে।
পুলিশের গুলশান বিভাগের উপকমিশনার সুদীপ কুমার চক্রবর্তী জানিয়েছেন, মেয়েটি যেখানে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন, তার আশপাশের কিছু ভিডিও ফুটেজ তারা পেয়েছেন। সেগুলো যাচাই করা হচ্ছে। তদন্তের স্বার্থে এখনই কিছু বলা যাচ্ছে না।
পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, এ মামলাটির আনুষ্ঠানিক তদন্তের দায়িত্বে রয়েছে ডিবি। তবে তারাও চেষ্টা করছে। সবার একটাই চেষ্টা, ধর্ষককে চিহ্নিত করে দ্রুত গ্রেপ্তার করা।
ডিবি উত্তর বিভাগের ডিসি মশিউর রহমান বলেন, তারা মামলার তদন্ত করছেন। আলামত বিশ্নেষণ ও ঘটনার শিকার মেয়েটির ভাষ্য থেকে ধর্ষকের সম্ভাব্য কিছু তথ্য নিয়েছেন। তাকে শনাক্ত করে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।
দেখলে শিক্ষার্থীও চিনবেন ধর্ষককে :ধর্ষণের শিকার ছাত্রীকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওয়ানস্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে রেখে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। সেখানে গতকাল সকালে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান নাছিমা বেগমের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল তার সঙ্গে কথা বলে। ওই সময় মেয়েটি জানান, ধর্ষককে দেখলে তিনি চিনতে পারবেন। ধর্ষকের কিছুটা শারীরিক বিবরণও দিয়েছেন তিনি।
পরে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান নাছিমা বেগম সাংবাদিকদের জানান, মেয়েটি আসামিকে দেখলেই চিনতে পারবেন বলে তাকে জানিয়েছেন। আসামির স্কেচ করার কাজেও সহায়তা করতে পারবেন। মেয়েটি বলছেন, ধর্ষক মাঝারি গড়নের। তার চুলের ধরন এবং দেখতে কেমন, তাও জানিয়েছেন তিনি।
মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান বলেন, ঘটনার শিকার ছাত্রী সাহসী। দ্রুতই তিনি ট্রমা কাটাতে পেরেছেন। তার সাহসের প্রশংসা করতে হয়।
ধর্ষকের সামনের দুটি দাঁত নেই :ধর্ষকের সামনের দুটি দাঁত ছিল না বলে ওই ছাত্রী তদন্ত সংশ্নিষ্ট কর্মকর্তাদের জানিয়েছেন। গতকাল ওসিসিতে একাধিক তদন্ত দল তার সঙ্গে কথা বলে।
ওসিসির সমন্বয়ক ডা. বিলকিস বেগম জানান, মেয়েটির সঙ্গে পুলিশের অনেক কর্মকর্তা বিস্তারিত কথা বলেছেন। তদন্ত দল সম্ভাব্য ধর্ষকের বেশকিছু ছবিও দেখিয়েছেন। ওই সময় মেয়েটি জানিয়েছেন, ধর্ষকের সামনের দুটি দাঁত ছিল না।
ছাত্রী তদন্ত দলকে বলেছেন, ধর্ষক হঠাৎ এসে তার গলা টিপে উঁচু করে ধরে নিয়ে যায়। তিনি প্রতিরোধের চেষ্টা করলে পাশের ঝোপের মধ্যে নিয়ে পেটে লাথি ও বুকে ঘুষি মেরে ফেলে দেয়। ধর্ষক একপর্যায়ে তার নাম জানারও চেষ্টা করে।
শিগগিরই হাসপাতাল ছাড়বেন :ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওসিসির একটি সূত্র জানিয়েছে, রোববার গভীর রাতে ওই ছাত্রীকে হাসপাতালে ভর্তির পর তিনি মানসিকভাবে একেবারেই বিপর্যস্ত ছিলেন। তার মধ্যে ভয়াবহ আতঙ্ক ভর করেছিল। তার শারীরিক আঘাত ছাড়াও শ্বাসকষ্ট ছিল। কিন্তু সোমবারের পর থেকে তিনি দ্রুতই এসব কাটিয়ে উঠছেন। তার সেবায় নিয়োজিত হাসপাতাল কর্মীদের তিনি বলেছেন, তাকে ঘুরে দাঁড়াতে হবে। তিনি পরাজিত হতে চান না।
গতকাল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ কে এম নাসির উদ্দিন জানিয়েছেন, সাত সদস্যের চিকিৎসক বোর্ড চূড়ান্তভাবে ওই ছাত্রীর মধ্যে এখন খুব একটা ট্রমা পাচ্ছেন না। মেয়েটি মানসিকভাবে যথেষ্ট হতাশাগ্রস্ত ছিলেন। ওসিসির মনোচিকিৎসক তাকে নানা পরামর্শ দিয়েছেন। এখন ওই শিক্ষার্থী দ্রুত স্বাভাবিকতার দিকে এগোচ্ছেন। তার মানসিক শক্তি দ্রুত বাড়ছে।
পরিচালক বলেন, চিকিৎসক বোর্ড পরামর্শ দিলে দু-একদিনের ভেতরে তাকে হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র দেওয়া হবে।
ডা. বিলকিস বেগম জানিয়েছেন, মেডিকেল বোর্ডের সদস্যরা ওই ছাত্রীর কাছে কোনো সমস্যা আছে কিনা কিংবা কী সমস্যা হচ্ছে, তা জানতে চেয়েছিলেন। তখন তিনি বলেছেন, তার গলায়, বুকে ও পেটে কিছুটা ব্যথা রয়েছে। ডায়াগনস্টিক প্রতিবেদন অনুযায়ী তার চিকিৎসা চলছে। অবস্থা আগের চেয়ে অনেক উন্নতি হয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সাদেকা হালিম বলেন, একাই সে পরিস্থিতি মোকাবিলা করেছে। আবার হাসপাতালে এ অবস্থায়ই পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছে। মেয়েটির সাহস প্রশংসার যোগ্য ।